ডেস্ক রির্পোট:- স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনসহ পুলিশ সংস্কারে একগুচ্ছ প্রস্তাব তৈরি করেছে পুলিশ সদর দপ্তর। এতে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পুলিশের সব সদস্যের কর্মকাণ্ড নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ ও তদারকি নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। প্রাথমিক খসড়ায় মানবাধিকার সুরক্ষা, পেশাদারিত্ব ও দক্ষতা বাড়ানো, সংস্কারের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনুসরণীয় নীতি (বেস্ট পলিসি) গ্রহণ, কর্মসময় ৮ ঘণ্টা নির্ধারণ, পিআরবিসহ বিভিন্ন আইন ও বিধির প্রয়োজনীয় সংশোধন, বিভিন্ন ইউনিটের প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বাড়ানোসহ বিভিন্ন ধরনের প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছে। সর্বোপরি ২০০৭ সালের প্রস্তাবিত অধ্যাদেশের আলোকে পুলিশের সংস্কার চান বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
পুলিশসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলোতে সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত ১১ সেপ্টেম্বর ৬টি কমিশন গঠন করে।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জননিরাপত্তা বিভাগের সাবেক সচিব সফর রাজ হোসেনকে। সংস্কারের অগ্রগতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পুলিশ পরিচালিত হয় আইন ও বিধির আলোকে। এই আইন অনেক ব্যাপক। আমি নিজেও অনেক আইন জানি। আর যেগুলো আছে সেগুলো সংগ্রহ করেছি। আমি ব্যক্তিগতভাবেও আইনগুলো নিয়ে পড়াশোনা করছি। অংশীজনেরও মতামত নিচ্ছি। আইন ও বিধির দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘ব্রিটিশ আমলের আইনের কিছু ধ্যান-ধারণা বাদ দিয়ে কীভাবে জনবান্ধব পুলিশ হতে পারে, সেদিকে জোর দেওয়া হচ্ছে। জুলাই-আগস্টে পুলিশের যে ভূমিকা দেখা গেছে, ভবিষ্যতে যাতে সেরকম আর না ঘটে, তা নিশ্চিত করা লক্ষ্যে কাজ চলছে। চেষ্টা করছি, সংস্কারের মাধ্যমে যাতে জনকল্যাণমুখী হয় পুলিশ।’
সম্প্রতি সচিব কমিটির সভায় প্রধান উপদেষ্টা প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে প্রয়োজনীয় সংস্কার পরিকল্পনা প্রণয়ন করে সেটা দাখিল ও বাস্তবায়নের জন্য ‘ম্যাচিং অর্ডার’ দেন। সে পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের প্রশাসন-১ শাখা থেকে জরুরি ভিত্তিতে নির্ধারিত ছকে আইজিপিকে তথ্য পাঠাতে নির্দেশ নেওয়া হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি কাজী জিয়া উদ্দিন স্বাক্ষরিত প্রস্তাবিত পুলিশ সংস্কার পরিকল্পনা সম্পর্কে ৮ পাতার একটি লিখিত প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘পুলিশ সংস্কার পরিকল্পনা একটি চলমান কার্যক্রম এবং এ সংক্রান্তে ভবিষ্যতে অধিকার আলোচনা পর্যালোচনার সুযোগ রয়েছে।’
পুলিশ সদর দপ্তরের প্রস্তাবিত পুলিশ সংস্কারের লক্ষ্যে ‘জনপ্রত্যাশা ও পুলিশ সংস্কার: পরিবর্তনের পথনকশা’ শীর্ষক পরিকল্পনায় আইনি কাঠামো সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব তৈরি করা হয়। এতে সংস্কার বিষয়ে বলা হয়েছে—‘সংবিধিবদ্ধ স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন করা, পুলিশ অ্যাক্ট ১৮৬১ ও পুলিশে রেগুলেশন অব বেঙ্গল (পিআরবি)-এর প্রয়োজনীয় সংশোধন, বিশেষায়িত ইউনিটের বিধিবিধান প্রয়োজনীয়তার নিরিখে সংশোধন করা, জনপ্রত্যাশা পূরণে যুগোপযোগী ও নতুন আইনি বিধি প্রণয়ন করা।’ এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে যে ফল পাওয়া যাবে, তা হচ্ছে ‘পুলিশের অধিকতরও জবাবদিহি নিশ্চিত হবে ও মানবাধিকার সুরক্ষিত হবে। দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে পুলিশি কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে দেশের জনশৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে এবং দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ পুলিশ কর্তৃক এ সংক্রান্ত প্রাক-প্রস্তুতি চলছে। বিশেষ করে পুলিশ সংস্কার সংক্রান্ত ইউএনডিপির সহায়তায় প্রস্তুত করা পুলিশ অধ্যাদেশ ২০০৭-এর প্রস্তাবনা বর্তমান প্রেক্ষাপটের আলোকে প্রয়োজনীয় সংশোধন করার বিষয়টি বিবেচনার জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হয়েছে।’
পুলিশে জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘পুলিশ সদস্যদের সার্বিক কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ ও সে অনুযায়ী পুলিশের কার্যক্রমকে যথাযথ তদারকির মাধ্যমে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।’
পেশাদারিত্ব ও দক্ষতা বৃদ্ধি
পেশাদারিত্ব ও দক্ষতার বৃদ্ধির বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘মানবাধিকার, জেন্ডার, পুলিশের অপারেশনাল ও প্রশাসনিক কার্যক্রম সংক্রান্তে অধিকতর উন্নতমানের প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা, অপরাধ তদন্তে বিশেষ প্রশিক্ষণ ও তদারকি ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, বাংলাদেশ পুলিশের বিভিন্ন বিশেষায়িত ইউনিটের (বিশেষ শাখা, ট্যুরিস্ট পুলিশ, নৌ-পুলিশ, অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ), রেলওয়ে পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ, সিআইডি, পিবিআই ইত্যাদি) পেশাদারিত্ব ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ কার্যক্রম গ্রহণ করা। বিশ্ব শান্তিরক্ষায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণের নিমিত্তে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ কার্যক্রম গ্রহণ করা। কমিউনিটি ও বিট পুলিশিং সংক্রান্ত কার্যক্রম অধিকতর গতিশীল করা; পুলিশ সংস্কার কার্যক্রমে অংশীজনকে সম্পৃক্ত করা; ট্রান্সন্যাশনাল ও অর্গানাইজড ক্রাইম নিয়ন্ত্রণে (বিশেষ করে কাউন্টার টেররিজম, মাদক, মানব পাচার ও আর্থিক অপরাধ) কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। সাইবার ক্রাইম ও অন্যান্য টেক-বেইজড অপরাধ দমেন লজিস্টিকস সুবিধাদি বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণ জোরদার করা; তথ্য বিভ্রান্তি ও গুজব নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া ও এ সংক্রান্ত দেশীয় ও বৈশ্বিক অন্যান্য বেস্ট পলিসি অনুসরণ করা।’
এটি বাস্তবায়ন করা গেলে একটি সুপ্রশিক্ষিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে পুলিশ দেশ ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। পাশাপাশি জনবান্ধব পুলিশ হিসেবে সমসাময়িক বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ড রোধের মাধ্যমে জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে জনমনে স্বস্তি আনতে সক্ষম হবে।
প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি
প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘বৈষম্যহীনভাবে সততা, দক্ষতা ও যোগ্যতাকে প্রাধান্য দিয়ে প্রশাসনিক ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনাকে (নিয়োগ, পদায়ন, পদোন্নতি ও প্রণোদনা ইত্যাদি) স্বচ্ছ ও আধুনিক যুগোপযোগী করা, বৈষম্য নিরসনে সরকারের অনুমোদনের মাধ্যমে পুলিশের (পুলিশ ও নন-পুলিশ কর্মচারী) অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন গাইড লাইন, পলিসি, ডকুমেন্টস প্রস্তুত বা সংশোধন (নিয়োগ, পদোন্নতি, পদায়ন, প্রশিক্ষণ, জনবল বৃদ্ধি, পুলিশ ও নন-পুলিশ সদস্যদের কল্যাণ ইত্যাদি) করা। বাংলাদেশ পুলিশের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ইউনিটের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা (মানবসম্পদ ও লজিস্টিক) বৃদ্ধি করা। বিভাগীয় ও ক্ষেত্রবিশেষে জেলা পর্যায়ে ফরেনসিক ল্যাব স্থাপন করা, বাংলাদেশ পুলিশের বিভিন্ন বিশেষায়িত ইউনিটের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানো, বিশেষায়িত সাইবার ইউনিট, পরিবেশ পুলিশসহ সময়ের প্রয়োজনে অন্যান্য বিশেষায়িত ইউনিট গঠনের মাধ্যমে পুলিশের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানো। ৯৯৯ ইউনিটের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা (মানবসম্পদ ও লজিস্টিক) বাড়ানো, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, ডিপ্লোমেটিক জোন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা দেওয়াসহ দেশের দুর্যোগপূর্ণ সময়ে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ও অপরাধ দমনে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানো, আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা গড়ার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানো, ডাটাবেজ ভিত্তিক আধুনিক লজিস্টিক ব্যবস্থাপনা ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা; জেন্ডারবৈষম্য নিরসনের লক্ষ্যে নারী পুলিশের সংখ্যা বৃদ্ধি ও যথোপযুক্ত কর্মপরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানো; গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও সরকারি কার্যক্রম পরিচালনা (জিআর-সিআর মামলা তদন্ত, গাড়ি সহযোগে অপরাধের ঘটনাস্থল পরিদর্শন, নিয়মিত নাইট পেট্রোল, অ-শনাক্ত লাশ ব্যবস্থাপনা, কমিউনিটি মিটিং, সৌজন্যমূলক আপ্যায়ন; আসামি কোর্টে পাঠানো ও আপ্যায়ন ইত্যাদি) এবং জনপ্রত্যাশার আলোকে পুলিশের সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে পুলিশের বাজেট বৃদ্ধি করা ও এ সংক্রান্ত দেশীয় ও বৈশ্বিক আইন ও বেস্ট প্র্যাকটিস অনুসরণ করা।’
এ বিষয়টি বাস্তবায়ন হলে পুলিশের সক্ষমতা বহুলাংশে বৃদ্ধি করবে, যা জনপ্রত্যাশা পূরণে অধিকতর সহায়ক হবে বলে মন্তব্য করা হয়েছে।
কল্যাণ সংক্রান্ত কার্যক্রম
পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের সংখ্যা বাড়ানোর মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত দৈনিক ৮ ঘণ্টা কর্মসময় নির্ধারণ, সরকারি দায়িত্ব পালন ও নিয়মমাফিক ছুটি প্রাপ্তির বিষয়টি সদয় বিবেচনা করা, পুলিশের ওভারটাইম ডিউটির ক্ষেত্রে যৌক্তিকভাবে আর্থিক প্রণোদনা দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট বাড়ানো, যথাযথ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ঝুঁকি বিবেচনায় বাংলাদেশ পুলিশের কর্মরত সব সদস্যের জন্য ঝুঁকিভাতা নিশ্চিত করা। পুলিশে কর্মরত সদস্যদের শারীরিক মানসিক সুরক্ষার নিমিত্তে কেন্দ্রীয় ও মাঠ পর্যায়ে পুলিশ হাসপাতালের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো। সরকারি দায়িত্ব পালনকালে নিহত ও আহত পুলিশ সদস্যদের জন্য তাৎক্ষণিক আর্থিক ও সুচিকিৎসা প্রদানের জন্য বিশেষ বাজেট বরাদ্দ রাখা। বিভিন্ন পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের জন্য আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, নারী পুলিশ সদস্যদের জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ সুসংহতকরণ, বিশেষ অবস্থা ব্যতিরেকে চাকরিজীবী স্বামী-স্ত্রীর কর্মস্থল একই জায়গায় থাকার সরকারি নির্দেশনা যথাযথভাবে প্রতিপালন করা, বদলিজনিত কারণে পুলিশ সদস্যদের সন্তানদের পড়াশোনা যাতে বাধাগ্রস্ত না হয় সে জন্য কেন্দ্রীয়, বেসরকারি স্কুলে পুলিশ সদস্যদের সন্তানদের ভর্তি/পড়াশোনা অব্যাহত রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করা। এতদসংক্রান্ত দেশীয় ও বৈশ্বিক বেস্ট প্র্যাকটিস অনুসরণ করা।
প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়িত হলে পুলিশের প্রত্যেক সদস্যের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষিত হবে। একই সঙ্গে সদস্যদের কর্মস্পৃহা ও কর্মদক্ষতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে, যা তাদের জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে একটি জনবান্ধব পুলিশ হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে বিশেষ সহায়ক হবে।
এ বিষয়ে আরও বলা হয়েছে, বাস্তবতার নিরিখে অন্যান্য পেশার মতো পুলিশ সদস্যদের ৮ ঘণ্টা ডিউটি রোস্টার বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। অতিরিক্ত ডিউটি, নিরাপত্তা ঝুঁকি, শারীরিক মানসিক চাপ, স্বল্প পরিসরের আবাসন ব্যবস্থা ইত্যাদি সমস্যা নিরাসন এখন সময়ের প্রত্যাশা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন পরবর্তী সময়ে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে অবস্থানরত সদস্যদের মধ্যে জোরালোভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। এসব বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সার্বিক সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।