সৃষ্টিলগ্ন থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইতিহাস বলে, প্রায় ২০ কোটি বছর আগে এ অঞ্চলে বিদ্যমান টেথিস সাগরের তলদেশ থেকে হিমালয় পর্বতমালার উত্থানের সময় শুরু হওয়া গিরিজনি আন্দোলনের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে সারি সারি পাহাড় সৃষ্টি হয়েছে। সভ্যতা বিকাশের শুরুতে বাংলার হরিকল জনপদ নিয়ে গঠিত ছিল চট্টগ্রাম। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সম্পদ সমৃদ্ধ অঞ্চল চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকা। ভারত মহাসাগরের প্রবেশ পথে বঙ্গোপসাগরের উপকূল থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থিত এ অঞ্চল। বাংলাদেশের এই বৃহৎ পাহাড়ি এলাকার উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের অংশবিশেষ, পূর্বে মিজোরাম এবং দক্ষিণ-পূর্বে মায়ানমার মিলিয়ে তা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্ট্র্যাটেজিক অঞ্চল তৈরী করেছে।
এছাড়াও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও কৃষি সম্পদের পাশাপাশি প্রাকৃতিক গ্যাস, জ্বালানি তেল, ইউরেনিয়াম, মহামূল্যবান প্লাটিনামসহ বিভিন্ন খনিজ ধাতু এবং অন্যান্য মূল্যবান খনিজ সম্পদ এ অঞ্চলে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। পারমাণবিক চুল্লির অপরিহার্য জ্বালানি ইউরেনিয়ামের মজুদ থাকার এক সম্ভাবনাময় এলাকা এটি। ফলে এখান থেকে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের চোখ এড়ায়নি। গত কয়েক দশক থেকে বাংলাদেশেরই এই পার্বত্য অঞ্চলের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীভুক্ত কিছু লোক বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী তৎপরতা ও ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমে লিপ্ত রয়েছে।
বাংলাদেশে বসবাসরত নৃ-গোষ্ঠী বা উপজাতির সংখ্যা ৪৬। এরমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট ১২টি উপজাতি বাস করে। উপজাতিদের সবাই বহিরাগত। এরা বিভিন্ন কারণে নিরাপদ আশ্রয় লাভের সন্ধানে তিব্বত, চীন, মায়ানমার এবং ভারতের বিভিন্ন পাহাড়ী অঞ্চল থেকে অনধিক ৪০০ বছর আগে বাংলাদেশের ভূখণ্ড পার্বত্য চট্টগ্রামে আসে। নৃতাত্ত্বিক বিচারে এরা সবাই মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। এ অঞ্চলে বসবাসরত উপজাতিরা ভূমিজ সন্তান নয়। তবুও কিছু সংখ্যক গণবিচ্ছিন্ন নেতা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য এই শান্তিপূর্ণ নীরব অঞ্চলকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ছড়িয়ে দিতে চাইছে।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর ভারতের কলকাতার একাডেমি অফ ফাইন আর্টসে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি, মানবধিকার লঙ্ঘনসহ একাধিক অভিযোগে আলোচনা সভার আয়োজন হয়। একাডেমির কনফারেন্স হলে অল ইন্ডিয়া রিফিউজি ফ্রন্ট এবং ক্যাম্পেইন এগেইনস্ট এট্রসিটিজ অন মাইনোরিটিজ ইন বাংলাদেশ এর উদ্যোগে ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন হিউম্যান রাইটস ভায়োলেশন এন্ড ইমপ্লিমেন্টেশন অভ চিটাগাং হিল ট্রাক্টস একর্ড শীর্ষক কনফারেন্সে উপস্থিতিদের মধ্যে আলোচিত মুখগুলো হলো ভারতের ত্রিপুরা ও মেঘালয়ের সাবেক রাজ্যপাল ও ক্ষমতাসীন বিজেপি নেতা তথাগত রায়, বিজ্ঞানী ড. যিষ্ণু বসু, অল ইন্ডিয়া রিফিউজি ফ্রন্টের জয়েন্ট কনভেনার সুজিত শিকদার, সিএইচটি পিস ক্যাম্পেইন গ্রুপের নেতা এবং কথিত জুম্মল্যান্ড রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রী দাবি করা করুণালংকার ভিক্ষু, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ-সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার, পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল কমিটির সভাপতি প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক উত্তম কুমার চক্রবর্তী প্রমুখ।
সভায় চট্টগ্রাম কেন্দ্রীক বাংলাদেশ সরকারের অবস্থানকে রীতিমত তুলোধুনো করেন সভায় উপস্থিত অতিথিরা। বক্তাদের দাবি পার্বত্য শান্তি চুক্তির ২৫ বছর অতিবাহিত হলেও শান্তি চুক্তির অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাস্তবায়িত হয় নাই, বিশেষ করে মূল বিষয়গুলো এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। এদিন তারা একপ্রকার ভারত সরকারের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকারকে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপ দেয়ার আহ্বান জানান। পার্বত্য চট্টগ্রাম ইস্যুটিকে ভারতীয় গণমাধ্যমে তুলে ধরার মাধ্যমে জনমত গঠন করার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি তারা বলেন, জুম্ম জনগণের চলমান আন্দোলনকে শক্তিশালী করার জন্য সর্বাত্মক সহায়তা প্রদান করার আহ্বান জানানো হবে ।
এটা অত্যন্ত দুঃখের এবং নিন্দনীয় বিষয় যে ভারতের মতো বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রে এত খোলাখুলিভাবে পার্শ্ববর্তী দেশের একটি অমিমাংসিত স্পর্শকাতর বিষয়ে আলোচনা সভা হচ্ছে। সম্প্রতি কানাডার অভ্যন্তরে ভারত বিরোধী খালিস্থানি আন্দোলনের বিরুদ্ধে কানাডা সরকারের ভূমিকা নিয়ে ভারত প্রকাশ্যেই বিরোধিতার করেছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতি অনেকটা পাল্টে গিয়েছে এই ঘটনার পর। ঠিক এই সময়ে ভারতের মাটিতে প্রকাশ্যে বাংলাদেশ নিয়ে এমন ষড়যন্ত্রের সভা উল্টো ভারতের দিকেই আঙুল তুলবে। শীঘ্রই ভারত সরকার এ বিষয়ে পদক্ষেপ না নিলে প্রশ্নবিদ্ধ করবে তাদের কূটনীতিক শিষ্টাচারকে।
মণিপুরকাণ্ডের সমাধান খুঁজতে ভারতকে কম কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছে না। সেখানে মেইতি এবং কুকিদের যে বিরোধপূর্ণ অবস্থান তা সহজে মিটবে বলেও আশা করা যায় না। ভারতের এ ঘটনা কেবল জাতিগত বিদ্বেষ বলে চিহ্নিত করলে ভুল হবে। এখানে অবশ্যই জাতির সাথে সাথে ধর্মীয় উসকানির গন্ধ পাওয়া যাবে।
মণিপুরকে ঘিরে খ্রিষ্টান একটা বলয় আছে। মণিপুরের উত্তরে নাগাল্যান্ড। সেখানে খ্রিষ্টানদের সংখ্যা ৮৯ ভাগ। দক্ষিণে মিজোরাম, সেখানে ৮৭ ভাগ মানুষ খ্রিষ্টান। পাশেই মিয়ানমারের চিন প্রদেশ। সেখানে ৮৫ ভাগ বাসিন্দা খ্রিষ্টান। মণিপুরের কুকিরা এখনকার রাজ্যের প্রায় ২২ হাজার বর্গকিলোমিটার (৬০ ভাগ এলাকা) নিয়ে যে আলাদা রাজ্য চাইছে, সেটা যে আরেকটি খ্রিষ্টান অধ্যুষিত রাজ্য হবে। কুকিদের দাবি, মণিপুর থেকে আলাদা হয়ে কুকিপ্রধান একটি নতুন স্বায়ত্বশাসিত রাজ্য। কাছেই মেঘালয়ে প্রায় ৭৫ শতাংশ, অরুণাচলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ খ্রিষ্টানরা আছে ৩০ শতাংশের উপরে। বাংলাদেশের এই অঞ্চলেও উপজাতিদের বেশিরভাগ খ্রিষ্টান। যদি বৈশ্বিক চাপে একটা খ্রিষ্টান অধ্যুষিত এলাকা তৈরী করা যায় তবে দক্ষিণ এশিয়ার বিশাল একটা অঞ্চলে খ্রিষ্টান প্রাধান্য তৈরি হবে।
ভারতের লক্ষ্য যদি হয় এদের আশ্রয়-সহযোগিতা করে বাংলাদেশের এই অঞ্চলসহ বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকা জুড়ে একক আধিপত্য বিস্তার করা, তবে সেটা হবে খাল কেটে কুমির আনার মতো। ভারতের অখন্ডতা রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে। ভবিষ্যত নিয়ে ওয়াকিবহাল হয়ে বা না হয়ে যারা এই কাজ করছে, তারা আদতে নিজের দেশের মানচিত্রে কুড়াল মারার পাঁয়তারা করছে। তবে আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি, বাংলাদেশ ও ভারতের কিছু অতি-উৎসাহী নাগরিকই বাংলাদেশি উপজাতিদের এই হেন কার্যে মদদ দিচ্ছে। বুঝতে হবে, তাদের এই কাজে সাহায্য করা মানে ভারত বাংলাদেশসহ মায়ানমারের বৃহৎ এলাকাজুড়ে দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন ধর্মীয় বলয় সৃষ্টির মাধ্যমে আরেকটি ভূখণ্ড জন্ম দেওয়ার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করা।
সবরকম সুবিধা ভোগ করা সত্ত্বেও উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর জন্য চাকমা প্রভাবিত পৃথক রাজ্য ‘জুমল্যান্ড’ প্রতিষ্ঠার বায়না ধরেছে একদল চতুর দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রকারী। তাদের দাবি, বাঙালি উচ্ছেদ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমির ওপর উপজাতিদের একচ্ছত্র অধিকার, কর্তৃত্ব ও মালিকানা দিতে হবে। এটি সংবিধান বিরোধী, মৌলিক অধিকার বিরোধী, দেশবাসীর অধিকার হরনের শামিল। তাই বাংলাদেশ সরকার কখনই এ দেশের ৯৮ শতাংশ বাঙালির বিরুদ্ধে গিয়ে তাদের এ পৃথক রাজ্য ‘জুমল্যান্ড’ গড়ার পরিকল্পনায় সায় দেবে না।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক অধিকার
সূত্র: ঢাকা টাইমস