রাঙ্গামাটি:- পার্বত্য দুই জেলা খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে বৃহস্পতি ও শুক্রবার সংঘাতের পর গতকালের পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত ছিল। নতুন করে সংঘাত না হলেও পরিবহন ধর্মঘট ও অবরোধে স্থবির ছিল পাহাড়ের জনজীবন। চলাচল করেনি স্বল্প ও দূরপাল্লার কোনো যান। ছাড়েনি পণ্যবাহী কোনো গাড়িও। থমথমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে দুই জেলার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও বিভিন্ন রাজনৈতিক-আঞ্চলিক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন তিন উপদেষ্টা। পাহাড়ে নতুন করে অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম। পাহাড়ে অশান্তির পেছনে বাইরে ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন উপদেষ্টা এএফ হাসান আরিফ। এদিকে শুক্রবার দুপুরে রাঙ্গামাটি শহরে পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন। রাঙ্গামাটির জেলা প্রশাসক মোশারফ হোসেন খান স্বাক্ষরিত গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
ওদিকে, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে সংঘটিত ঘটনায় প্রশাসনের নির্লিপ্ততার অভিযোগ এনে শনিবার সকাল থেকে পুরো পার্বত্যাঞ্চলে ৭২ ঘণ্টার সড়ক ও নৌপথ অবরোধ কর্মসূচি পালন করছে ইউপিডিএফ’র নেতৃত্বাধীন পাহাড়িদের একাংশ। অপরদিকে নিজেদের গাড়ি ভাঙচুর ও চালকদের কুপিয়ে রক্তাক্ত করাসহ ব্যাপকহারে চাঁদাবাজি বন্ধের দাবিতে রাঙ্গামাটি থেকে সবধরনের পণ্য ও যাত্রীবাহী যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণরূপে বন্ধ রেখেছে রাঙ্গামাটির মোটরমালিক সমিতির নেতৃত্বাধীন অন্যান্য পরিবহন সংগঠনগুলো।
পূর্বপরিকল্পিতভাবে সামপ্রদায়িক ঘটনা ঘটিয়ে উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি, তারপর প্রশাসনের ১৪৪ ধারা জারি, পাহাড়ি চুক্তিবিরোধী সংগঠনের ৭২ ঘণ্টার অবরোধ, শহরের একমাত্র যানবাহন অটোরিকশাসহ সকল প্রকার যাত্রী ও পণ্যবাহী যানবাহন চলাচল বন্ধের ফলে রাঙ্গামাটির জনজীবন দুর্বিষহ উঠে উঠেছে। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর আতঙ্কের মধ্যেই রাঙ্গামাটিবাসী পার করছেন প্রতিটি মুহূর্ত। পরিস্থিতির উত্তরণে অত্রাঞ্চলের অধিবাসীদের মাঝে সৃষ্ট আস্থার সংকট নিরসনে শনিবার দুপুরে রাঙ্গামাটিতে সরজমিন পরিদর্শনে আসেন অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম তিন উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন সরকারের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল।
রাঙ্গামাটি সেনা রিজিয়নের প্রান্তিক হলে রাঙ্গামাটির রাজনৈতিক দলগুলোসহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ ও সকল পর্যায়ের স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন তারা।
স্থানীয় নেতৃবৃন্দ বলেছেন, পাহাড়ে সামপ্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটবে এমনটি ঘটনার আরও অন্তত ৯দিন আগেই আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা নিশ্চিত হয়। সিআইয়ের ওয়েব সাইটে এমন তথ্য প্রকাশ করা হয় গত ১১ই সেপ্টেম্বর। এরপর ১২ই সেপ্টেম্বর ঢাকাস্থ আমেরিকান দূতাবাস কর্তৃপক্ষ প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানায়- সারা দেশের পরিস্থিতির উন্নতির কথা জানিয়ে সেই বিজ্ঞপ্তির শেষে পার্বত্য চট্টগ্রামে যেকোনো মুহূর্তে পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে তার নাগরিকদের অত্রাঞ্চল এড়িয়ে চলার সতর্কবার্তা দেয়।
এই ঘটনার ৯ দিন পর খাগড়াছড়িতে মামুন নামের এক যুবককে নির্মমভাবে হত্যা করে সেটির ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে সামপ্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটানো হয়। এই ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই বিভিন্ন স্থান থেকে অন্তত ৫ হাজার পাহাড়ি যুবক এনে বৈষম্যবিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে রাঙ্গামাটি শহরে শুক্রবার সকালে অতর্কিতভাবে মিছিল বের করে প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা বনরূপায় মসজিদে হামলা করে পেট্রোল পাম্পসহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয়।
এই ঘটনায় স্থানীয় বাঙালিরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নিয়ে ইউপিডিএফ-এন নেতৃত্বাধীন বৈষম্যবিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের ধাওয়া দিলে উভয়পক্ষই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। বাঙালিদের বিক্ষুব্ধ একটি অংশ মসজিদে হামলার ঘটনায় বিক্ষুব্ধ হয়ে কাঁঠালতলীর একটি মন্দিরে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে। এ ছাড়াও সংঘর্ষের সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের বেশ কয়েকটি গাড়িসহ রাঙ্গামাটি শহরের হ্যাপীর মোড়, বনরূপা এলাকায় ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। এতেই রাঙ্গামাটিতে উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বর্তমানে পুরো রাঙ্গামাটিতেই থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে।
স্থবির খাগড়াছড়ি: এদিকে পাহাড়ি-বাঙালি সামপ্রদায়িক সংঘাতে স্থবির হয়ে পড়েছে খাগড়াছড়ি। বৃহস্পতিবার দীঘিনালা ও খাগড়াছড়ি সদরে সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় এখনো থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। শহরে অভ্যন্তরীণভাবে কিছু সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও মোটরসাইকেল চলাচল করলেও দূরপাল্লা ও আঞ্চলিক সড়কের সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। খাগড়াছড়ি থেকে ছেড়ে যায়নি ঢাকা ও চট্টগ্রামগামী কোনো যানবাহন। বিভিন্ন প্রান্তে আটকে আছে কাঁচামাল বহনকারী গাড়ি। খাগড়াছড়ি বাজারে দোকানপাট খোলা থাকলেও ক্রেতাশূন্য দিন কাটছে ব্যবসায়ীদের। এখনো পাহাড়ি-বাঙালিদের মনে বিরাজ করছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। গতকাল সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দেখা গেছে সুনসান নীরবতা। খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে সংঘর্ষে প্রাণহানি ও অগ্নিসংযোগের প্রতিবাদে এবং এসব ঘটনায় দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দাবিতে শুক্রবার খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানে ৭২ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচির ডাক দেয় ‘বিক্ষুব্ধ জুম্ম ছাত্র-জনতা’ নামে একটি সংগঠন। সেই কর্মসূচির অংশ হিসেবে শনিবার সকাল থেকে চলছে সড়ক অবরোধ। সরজমিন দেখা গেছে, বাজারের বিভিন্ন রাস্তার মুখে অবস্থান নিয়েছে পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা। এ ছাড়া শহরের শাপলা চত্বর, চেঙ্গী স্কয়ার, স্বনির্ভর, জিরো মাইল এলাকাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে মোড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি দেখা গেছে। এদিকে পাহাড়ে সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি পুনরুদ্ধারে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। গতকাল বিকাল সোয়া ৪টায় খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে এ মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়ের উপদেষ্টা এএফ হাসান আরিফ, পার্বত্য উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা, চট্টগ্রাম ২৪ ডিভিশনের এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল মাইনুর রহমান, খাগড়াছড়ি রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরীফ মো. আমান হাসান, খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান, খাগড়াছড়ি পুলিশ সুপার আরেফিন জুয়েল সহ ঊর্ধ্বতন কর্মকতারা উপস্থিত ছিলেন। এতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ ও বিভিন্ন উপজাতি সমপ্রদায়ের লোকজন মতামত প্রদান করেন।