ডেস্ক রির্পোট:- আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘমেয়াদে অন্যায়ভাবে বন্ধ করে দেওয়া গণমাধ্যমগুলো আবারও চালু হচ্ছে। দৈনিক আমার দেশ, চ্যানেল ওয়ান, ইসলামিক টিভি, সিএসবি, দিগন্ত টিভিসহ কয়েকটি গণমাধ্যম চালুর প্রস্তুতি চলছে। ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এসব গণমাধ্যম ফের চালুর প্রক্রিয়া শুরু হয়। ইতোমধ্যেই দৈনিক দিনকাল পুরোদমে প্রকাশনায় ফিরেছে। দর্শক ও পাঠকদের সামনে আসতে এরই মধ্যে কয়েকটি গণমাধ্যম পুরোদমে তৎপর রয়েছে। আইনি প্রক্রিয়া শেষ করে আবারও আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে কেউ কেউ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাঠকদের সামনে হাজির হতে বেশ জোরেশোরে তৎপরতা শুরু করেছে বিগত সরকারের রোষানলে বন্ধ হয়ে যাওয়া পাঠকপ্রিয় পত্রিকা আমার দেশ। পত্রিকা ফের প্রকাশের জন্য ইতোমধ্যেই ডিসি অফিস, ডিএফপি ও স্পেশাল ব্রাঞ্চের ক্লিয়ারেন্সসহ সবকটি ছাড়পত্র সম্পন্ন হয়েছে। দাপ্তরিক কাজগুলোও শেষ হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। আগামী মাসের প্রথম দিকেই তুরস্ক থেকে দেশে ফিরছেন পত্রিকাটির আলোচিত ও নির্যাতিত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। দেশে ফিরে আইনি লড়াই করবেন তিনি। তার স্ত্রী পারভীন সুলতানা ইতোমধ্যেই দেশে ফিরেছেন।
নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্রে জানা গেছে, শেখ হাসিনার ছেলে ও তার সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের লুটপাট এবং যুদ্ধাপরাধ মামলা নিয়ে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের স্কাইপে কেলেঙ্কারি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের জেরে আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ করে দেয় আওয়ামী লীগ সরকার। একই সঙ্গে পত্রিকাটির নিজস্ব ছাপাখানাও সিলগালা করে দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় পুরো প্রেসটি একটি পরিত্যক্ত স্থাপনায় পরিণত হয়েছে। লুটপাট হয়ে গেছে সব যন্ত্রপাতি। তার কোনো কিছুই আর ব্যবহার উপযোগী নেই। সেজন্য পত্রিকাটি আল-ফালাহ প্রিন্টিং প্রেস থেকে ছাপানোর জন্য ইতোমধ্যেই একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। আপাতত পুরানা পল্টনের একটি অস্থায়ী কার্যালয় থেকে দাপ্তরিক কার্যক্রম চললেও কারওয়ান বাজারে একটি অফিস দেখা হয়েছে। ডিসেম্বর মাসেই পত্রিকাটি আবারও পাঠকের সামনে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে সব ধরনের প্রস্তুতি চলছে।
দিগন্ত টিভি: রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পালাবদলে ১১ বছর পর সম্প্রচারে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে মার্জিত ও দর্শকপ্রিয় চ্যানেল দিগন্ত টেলিভিশন। ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচি কেন্দ্র করে ব্যাপক সহিংসতার পরদিন ‘বিদ্বেষ ও গুজব ছড়ানো এবং দায়িত্বজ্ঞানহীনতার’ অভিযোগে দিগন্ত টেলিভিশন ও ইসলামিক টিভির সম্প্রচার ‘সাময়িকভাবে’ বন্ধ করে দেয় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। দিগন্ত টিভি বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়ে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছিলেন, ‘দিগন্ত টেলিভিশনসহ দু-একটি টেলিভিশন ঘটনাকে (হেফাজতে ইসলামের আন্দোলন) উসকে দিচ্ছে। এসব চ্যানেল বিদ্বেষ ও গুজব ছড়ানোর মাধ্যমে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়ে চরম অপরাধ করেছে। তাই তথ্য মন্ত্রণালয় বাধ্য হয়ে প্রচলিত আইনে এ ধরনের গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে।’
দিগন্ত টিভির বিরুদ্ধে দেওয়া সাময়িক এ নিষেধাজ্ঞা প্রায় একযুগেও শেষ হয়নি। নানা চেষ্টা-তদবিরের পরও চ্যানেলটি চালু করতে ব্যর্থ হয় কর্তৃপক্ষ। তবে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত ৮ আগস্ট সাময়িক ওই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে। বিটিআরসি থেকে ফ্রিকোয়েন্সি বরাদ্দের অনাপত্তিপত্রও দেওয়া হয়েছে। চ্যানেলটি চালু করতে ইতোমধ্যেই দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশন বৈঠকও করেছে।
দিগন্ত টিভি চালুর বিষয়ে চ্যানেলটির প্রধান বার্তা সম্পাদক জিয়াউল কবির সুমন বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট সরকারের রোষানলে পড়ে চ্যানেলটি বন্ধের পর এ প্রতিষ্ঠানের অন্তত ছয়জন কর্মী হতাশায় মৃত্যুবরণ করেছেন। অনেকেই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। স্বৈরাচার পতনের পর চ্যানেলটি চালুর বিষয়ে দেশ-বিদেশে দর্শকদের চাপ বাড়ছে। প্রতীক্ষার প্রহর গুনছেন অগণিত দর্শক। তবে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় চ্যানেলটির সব যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে গেছে। এ ছাড়া সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন প্রযুক্তি যুক্ত হয়েছে। এসব প্রযুক্তি সংযোজন করে চ্যানেলটি চালু করতে খানিকটা সময় লাগতে পারে।’
একটি সূত্র জানায়, দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের ৩৮ জন পরিচালক থাকলেও সরকারের রোষানলে পড়ে প্রায় সবাই নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে বাধ্য হন। মাত্র তিন-চারজন পরিচালক চ্যানেল এবং তাদের মালিকানায় থাকা নয়া দিগন্ত পত্রিকাটির খোঁজখবর নিতেন। তবে সরকার পতনের পর থেকে অনেক পরিচালক সক্রিয় হচ্ছেন। নতুন করে অনেকেই পরিচালনা বোর্ডে আসতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। এ বিষয়ে দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের চেয়ারম্যান শিব্বির মাহমুদ বলেন, চ্যানলটি চালুর জন্য প্রতিদিনই দর্শক ও শুভানুধ্যায়ীদের কাছ থেকে ফোন পাচ্ছি। তাদের সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণে চেষ্টা করে যাচ্ছি। ইতোমধ্যেই কয়েকটি বৈঠকও হয়েছে। আমরা চাচ্ছি আগামী দু-তিন মাসের মধ্যে এটি চালু করতে। তবে কারিগরি বিষয় থাকায় সেটি চালু করতে একটু সময় লাগছে।
ইসলামিক টিভি: ইসলামিক টিভিও চালুর প্রস্তুতি চলছে। সেই লক্ষ্যে দাপ্তরিক কাজকর্ম চলছে। চ্যানেলটির স্বত্বাধিকারী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ভাই ও ফেনী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সাঈদ ইস্কান্দারের স্ত্রী নাসরীন সাঈদ বিষয়টি দেখভাল করছেন। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান প্রতিবেদক রফিকুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, দর্শকপ্রিয় চ্যানেলটি চালুর বিষয়ে প্রস্তুতি চলছে। আপাতত দাপ্তরিক কাজগুলো সেরে নেওয়া হচ্ছে।
চ্যানেল ওয়ান: সরকারের রোষানলে ২০১০ সালের ২৭ এপ্রিল বন্ধ করে দেওয়া হয় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বন্ধু ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন মামুনের মালিকানাধীন চ্যানেল ওয়ান। টেলিভিশন সম্প্রচারের জন্য যন্ত্রপাতি আমদানি করে সেগুলো অবৈধভাবে বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগ এনে এ চ্যানেলটি বন্ধ করে আওয়ামী লীগ সরকার। সরকার পতনের পর দীর্ঘ কারাভোগ শেষে সম্প্রতি জেল থেকে মুক্তি পান গিয়াস উদ্দিন মামুন।
চ্যানেল ওয়ানের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের সাবেক এক কর্মী বলেন, প্রতিষ্ঠানটি চালুর বিষয়ে কাজ শুরু করেছে মালিকপক্ষ। সেজন্য তারা আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আইনি প্রক্রিয়া শেষে সম্প্রচারে আসতে একটু সময় লাগবে। ইতোমধ্যেই সাবেক কর্মীরা ‘গেট টুগেদার’ করেছেন। তাদের কারও কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে মালিকপক্ষ।
সিএসবি: ওয়ান ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বন্ধ হওয়া নিউজভিত্তিক চ্যানেল ‘সিএসবি’ চালুর বিষয়েও কথাবার্তা চলছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিবার বিষয়টি দেখভাল করছে। প্রতিষ্ঠানের একজন সাবেক কর্মী জানান, চ্যানেলটি চালুর অংশ হিসেবে খুব শিগগির সাবেক কর্মীদের নিয়ে একটি ‘গেট টুগেদার’ আয়োজন করা হবে।
দিনকাল: এদিকে আওয়ামী লীগের চাপের মুখে বন্ধ হয়ে যাওয়া দৈনিক দিনকাল প্রায় দেড় বছর পর আবারও প্রকাশনায় ফিরেছে। গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে পুরোদমে প্রকাশিত হচ্ছে পত্রিকাটি। প্রায় দেড় বছর আগে পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল করে দেন ঢাকার জেলা প্রশাসক। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর নতুন অন্তর্বর্তী সরকার সেই ডিক্লারেশন ফিরিয়ে দিলে ফের পাঠকদের কাছে ফিরে এসেছে পত্রিকাটি।