ডেস্ক রির্পোট:- কোটা সংস্কার দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমাতে সারা দেশে বিপুলসংখ্যক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৬ জুলাই থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত অন্তত ৫৮০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। নির্বিচার এই হত্যাকাণ্ডে চরমভাবে ক্ষুব্ধ সর্বস্তরের ছাত্র-জনতা। শুরু থেকেই সব হত্যার বিচার দাবি জানিয়ে আসছেন তারা। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা, সেনাপ্রধানসহ দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা। দায়ের করা হচ্ছে একের পর এক হত্যা মামলা। সংক্ষুব্ধরা ইতোমধ্যেই ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেছেন। এ ছাড়া বিতর্কিত অনেক পুলিশ ও র্যাব কর্মকর্তাকেও এসব মামলার আসামি করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘সংবিধান সবার বিচার পাওয়ার নিশ্চয়তা দিয়েছে। যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, সবকটির বিচার হবে। নির্যাতন হলেও বিচার হবে। এটাই স্বাভাবিক। যারা নির্দেশদাতা ছিলেন, যারা নির্দেশ পালন করেছেন—সবার বিরুদ্ধেই মামলা হতে পারে। এখন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো হত্যা ও নির্যাতনের মামলা করতে পারে। আবার রাষ্ট্রও একটা উদ্যোগ নিচ্ছে, গণহত্যার অভিযোগে বিচার করার। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে সেটার বিচার হবে। সেখানে যেসব হত্যার বিচার হবে, সেগুলোর আর সাধারণ আদালতে বিচার করা যাবে না। কারণ একই অপরাধের দুবার বিচার করা যায় না। তবে পৃথকভাবে সাধারণ আদালতেও কোনো মামলা করা হলে তার বিচার করতে কোনো বাধা নেই।’
জানা গেছে, সারা দেশেই আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাকর্মী, মন্ত্রী-এমপি, স্থানীয় নেতাসহ বিতর্কিত অনেক পুলিশ ও র্যাব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলার প্রস্তুতি চলছে। গতকাল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে গণহত্যারও একটি অভিযোগ আনা হয়েছে। আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে এই গণহত্যার বিচার হবে। হত্যা ও গণহত্যার দায়ে ফেঁসে যেতে পারেন শেখ হাসিনাসহ তার দলের অনেক শীর্ষ নেতা। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাও এসব মামলায় ফাঁসতে পারেন বলে মনে করছেন আইন বিশেষজ্ঞরা।
মন্তব্য চাওয়া হলে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্তরা এখন চাইলেই মামলা করতে পারবেন। শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী, আন্দোলন চলাকালে সারা দেশে ঘটে যাওয়া প্রতিটি হত্যার বিচার করা সম্ভব হবে। সেক্ষেত্রে বিতর্কিত কর্মকর্তা ও ক্ষমতাসীন যারা ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষ থেকে মামলা করতে হবে। ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকজন পৃথক হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এর আগে তো থানা-পুলিশ ও আদালত চালু ছিল না। তাই একটু বিলম্বে দায়ের হলেও এসব মামলার মেরিট নষ্টের কোনো সুযোগ নেই। এ ছাড়া বিগত সরকারই সাক্ষ্য আইন সংশোধন করে ডিজিটাল অ্যাভিডেন্স গ্রহণ করার সুযোগ করে দিয়েছে। ফলে এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ ইলেকট্রনিক মাধ্যমে অনেক হত্যাকাণ্ডের তথ্যপ্রমাণ রয়েছে। এসব তথ্যপ্রমাণ কাজে লাগানো যাবে। সরকার চাইলে প্রতিটি হত্যার বিচার করা সম্ভব হবে।’
জানা গেছে, এরই মধ্যে ঢাকায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুটি হত্যা মামলা হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীতে কলেজছাত্র ফয়জুল ইসলাম হত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে কাফরুল থানায় মামলা রেকর্ড করার আদেশ দিয়েছেন আদালত। এ মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ অন্তত আটজন সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও এমপিকে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া আসামি করা হয়েছে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, ঢাকার পুলিশ কমিশনার, অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন-অর রশিদ, র্যাবের মহাপরিচালক হারুন অর রশিদসহ অন্তত ছয়জন পুলিশ কর্মকর্তাকে। এ মামলায় ছাত্রলীগ-যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতাকেও আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া নাম উল্লেখ না করে স্থানীয় আওয়ামী লীগের ৫০০ থেকে ৬০০ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে আবু সায়েদ নামের এক মুদি দোকানিকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা, সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ সাতজনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ এজাহার হিসেবে রেকর্ড করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। গত মঙ্গলবার আদালত এই আদেশ দেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি চলাকালে গত ১৬ জুলাই ঢাকা কলেজের সামনে সংঘর্ষে দুজন নিহত হন। তাদের একজন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী সবুজ আলী (২৬) এবং অন্যজন হকার মো. শাহজাহান (২৬)। এ ঘটনায় নিউমার্কেট থানায় দুটি হত্যা মামলা হয়েছে। এর মধ্যে শাহজাহান হত্যার ঘটনায় ইন্ধনদাতা হিসেবে আনিসুল হক ও সালমান এফ রহমানকে গত মঙ্গলবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গতকাল বুধবার এই মামলায় তাদের ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
এ ছাড়া রাজধানীর বাইরেও হত্যা মামলা দায়ের শুরু হয়েছে। এর মধ্যে ফেনীর মহিপালে গত ৪ আগস্ট গুলি করে অটোরিকশাচালক মো. সবুজকে হত্যার ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। ফেনী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারীসহ ৬৫ জনের নাম উল্লেখ করে গত মঙ্গলবার মামলাটি করা হয়। এ মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের অজ্ঞাত আরও ৪০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় দেশের অন্তত ৫০টি জেলায় সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা ঘটে। বেশিরভাগ জায়গায় বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে মূলত সংঘর্ষে জড়ান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও দলটির সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। লাঠিসোটা ও দেশি অস্ত্রের পাশাপাশি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আন্দোলনকারীদের প্রতিরোধে রাস্তায় নেমেছিলেন সরকার-সমর্থকরা। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করে। বেআইনিভাবে অনেক গুলি চালায়। সংঘর্ষের কয়েকদিনে আহত হন হাজার হাজার ছাত্র-জনতা। এসব ঘটনায় কমপক্ষে ৫৮০ জনের মৃত্যু হয়।
সর্বশেষ গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। ওই দিনই ছাত্র আন্দোলন চলাকালে সব হত্যাকাণ্ডের বিচার করা হবে বলে আশ্বস্ত করেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।কালবেলা