ডেস্ক রির্পোট:- বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। গত কয়েক সপ্তাহে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে তোপের মুখে পড়ে পদত্যাগে বাধ্য হয়ে দেশ থেকে পালিয়েছেন তিনি। ক্ষমতায় টিকে থাকতে মরণ কাঁমড়েও শেষ রক্ষা হলো না তার। ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করতে শিক্ষার্থীদের নিহত করতে পিছপা হননি তিনি। দেশ জুড়ে চালিয়েছেন গণগ্রেপ্তার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে পদত্যাগে বাধ্য করেছে দেশের ছাত্রজনতা। অনলাইন বিবিসিতে এসব কথা লিখেছেন আনবারাসান ইথিরাজন ও তেসা ওং।
এতে আরও বলা হয়, ৭৬ বছর বয়সী হাসিনা সোমবার একটি সামরিক হেলিকপ্টারে ভারতে পালিয়ে যান। এর আগে তিনি পদত্যাগ করেছেন বলে জানান বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে গোটা দেশে বিক্ষোভের ঝড় শুরু হয়েছিল। এদিন সকাল থেকেই শিক্ষার্থীদের দেওয়া কর্মসূচী ‘লং মার্চ টু ঢাকাকে’ কেন্দ্র করে লাখ লাখ মানুষ জড়ো হয় রাজধানী ঢাকায়।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা নেতার জন্য এভাবে পদত্যাগ এবং দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া অপ্রত্যাশিত। কিছু দিন আগেও কেউ এমন কথা ভাবতে পারেনি। তিনি ২০০৯ সাল থেকে টানা ২০২৪ সালের আগস্টের কিছুদিন পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। সবমিলিয়ে তিনি প্রায় বিশ বছর দেশ শাসন করেছেন। সম্প্রতি বছরগুলোতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশটির অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে তার কৃতিত্ব রয়েছে।
হাসিনা একজন গণতন্ত্রপন্থী আইকন হিসেবে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন। তবে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসর পর থেকেই তার বিরুদ্ধে স্বৈর শাসনের অভিযোগ ওঠে। ক্ষমতায় থাকাকালীন তিনি দেশের সকল বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন চালিয়েছেন। ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কর্মীদের গণহারে গ্রেপ্তার সহ গুম ও খুন করেছে তার প্রশাসন।
এ বছরের জানুয়ারিতে নিজের অধীনে নির্বাচন করে তিনি টানা চতুর্থবার ক্ষমতায় বসেন। বিরোধী দলগুলো এবারের নির্বাচনকে বয়কট করে। কেননা তারা হাসিনার প্রশাসনের ওপর অনাস্থার কথা জানায়। বিরোধী দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রাম করেছে। তবে হাসিনা সে দাবি মেনে নেননি। তিনি তার সরকারের অধীনেই নির্বাচনে বাধ্য করার চেষ্টা করেন।
শেখ হাসিনা ১৯৪৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার রক্তে রাজনীতি বিদ্যমান। তার পিতা শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের একজন জাতীয় নেতা। যাকে বাংলাদেশের ‘জাতির পিতা’ বলে সম্বোধন করা হয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট হন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৫ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের পর স্বপরিবারে হত্যাকান্ডের শিকার হন তিনি। সেসময় শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহেনা দেশের বাইরে ছিলেন। তার পরিবারের সকলে নিহত হওয়ার পর বেশ কয়েক বছর ভারতে অবস্থান করে ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের নেতা নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা। তিনি সাবেক সেনাপ্রধান ও পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের পতনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সেসময় তিনি বিরোধী দলগুলোকে সাথে নিয়ে দেশে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। যারফলে খুব দ্রুতই তিনি দেশের জনগণের ভালোবাসা অর্জনে সক্ষম হন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ক্ষমতায় এসেই তিনি ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানি-বন্টন চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এছাড়া দেশের ভিতরে উপজাতীদের বিদ্রোহ ঠেকাতে একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করার জন্য বেশ প্রশংসা পান। তিনি সেসময় ভারতের সঙ্গে বেশ কিছু বাণিজ্যিক চুক্তির জন্য ব্যাপক সমালোচিত হন। ধারণা রয়েছে যে এই কারণেই তিনি ২০০১ সালের নির্বাচনে বিশাল ব্যবধানে হেরে যান।
পরবর্তীতে ২০০৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত দুই বছর সেনা শাসনের পর পুনরায় বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসেন শেখ হাসিনা। ২০০১ সালের পর বেশ কয়েকবার গুপ্তহত্যার চেষ্টার শিকার হন তিনি। তবে ভাগ্য ভালো থাকায় বেঁচে যান। তাকে তখন জোরপূর্বক নির্বাসনে পাঠানোরও চেষ্টা করা হয় এবং তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয়। যাইহোক তিনি ওই সময়টাতে বেশ লড়াই করে টিকে ছিলেন বলে বিবিসির খবরে উল্লেখ রয়েছে।
তবে ২০০৯ সালে হাসিনার ক্ষমতায় আসার পরপরই দেশে বিডিআর বিদ্রোহ হয়। এরপর তিনি বিরোধী দলগুলোর ওপর দমন-পীড়ন শুরু করেন। গণহারে গ্রেপ্তার করেন বিরোধী নেতাকর্মীদের। এছাড়া তার সময়ে অনেক মানুষ গুম হয়েছে, যাদের খোঁজ আজও মেলেনি। অনেককে খুন করা হয়েছে, যার বিচার করেননি হাসিনা। এছাড়া একসময় তিনি নিজে তত্ত্ববধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলন করলেও তার আমলে বিরোধী দলের এই দাবি মেনে নেননি। এতে তার সময়ে হওয়া সকল নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ ওঠে। বাংলাদেশে তার অধীনে ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যা ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। এছাড়া হাসিনার শাসনামলে তার দলের নেতাকর্মীরা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়া একমাত্র বাংলাদেশি ও অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বিচারিক হয়রানি করার অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। এ বছরের শুরুতে ড. ইউনূসকে শাস্তি হিসেবে জেল দেয়া হয়েছে। নোবেল জয়ী এই অর্থনীতিবিদের বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা দিয়েছে প্রশাসন। হাসিনার আমলে ব্যাপক আর্থিক দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদ। সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে এবং তাকে যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ করা হয়।
দেশের এমন পরিস্থিতির মধ্যে গত জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের আন্দোলন শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি কোটা ব্যবস্থার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সাথে বৈষম্য করা হচ্ছে। যার ফলে তারা কোটা সংস্কারের আন্দোলন শুরু করেন। তবে শুরু থেকেই সরকার এ বিষয়টিকে ভালোভাবে নেয়নি। পুলিশ ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমানোর চেষ্টা করেন হাসিনা। একসময় তিনি নিজের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকেও শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমাতে রাস্তায় নামার নির্দেশ দেন। পুলিশ এবং ছাত্রলীগের সহিংস হামলায় নিহত হন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এরপর শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছাত্রজনতার আন্দোলনে রূপ নেয়। এরপরই পুরো দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। পুলিশ এবং ছাত্রলীগের গুলিতে তিন শতাধিক মানুষ নিহত হন। গ্রেপ্তার করা হয় দশ হাজারের বেশি মানুষকে। এছাড়া আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন কয়েক হাজার ছাত্রজনতা। এই পরিস্থিতিতে দেশে গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি হয়। ছাত্ররা হাসিনার পদত্যাগের দাবি করেন। দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্ররা লং মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি দিলে সোমবার সকাল থেকেই রাজধানীতে জড়ো হতে থাকে লাখ লাখ মানুষ। পরিস্থিতি সামাল দিতে সামরিক বাহিনী রাস্তায় থাকলেও তা উপেক্ষা করে ছাত্রদের কর্মসূচিতে যোগ দিতে থাকে। যাতে পরিস্থিতির ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারায় হাসিনার প্রশাসন এবং তিনি সোমবার একটি সামরিক হেলিকপ্টারে করে ভারতে পালিয়ে যান। পতন হয় হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের।