ডেস্ক রির্পোট:- শুক্রবার সকাল থেকেই মনটা ছটফট করছিল চার সন্তানের জননী মোমেনা বেগমের (৫৫)। দুপুর থেকে মনের ভেতর যেন দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে শুরু করে। আতঙ্কগ্রস্ত মোমেনা বেগম শহরে অবস্থানরত বড় ছেলে জাকির হোসেন (৩৬)-এর বিপদের আশঙ্কায় ফোন দেন তাকে। বাবা তুমি এখন কোথায় জানতে চাইলে সে অফিসেই আছে বলে মাকে জানায়। মোমেনা বেগম ছেলেকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, বাবা আজ তুমি কোথাও বের হবা না, তোমার বড় রকমের বিপদ হবে। ছেলে মাকে কোথাও বের না হওয়ার আশ্বাস দিয়ে কথা বলতে বলতেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সেই গুলির শব্দ শুনে মায়ের হৃদয় খান খান হয়ে যায়। মুহূর্তের মাঝেই ফোনে কথা বলা বন্ধ হয়ে যায়। মায়ের আর বুঝতে বাকি থাকে না তার ছেলের আয়ু ফুরিয়ে এসেছে। প্রাণপ্রিয় ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় মোমেনা বেগম বিলাপ করে সোমবার কথাগুলো বলছিলেন।
গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলা থেকে প্রায় ২০ কি.মি দূরবর্তী বারিষাব ইউনিয়নের চরদুর্লভখা গ্রামের তরুণ উদ্যোক্তা জাকির হোসেন গত ১৯শে জুলাই শুক্রবার আড়াইটার সময় রাজধানীর আব্দুল্লাহপুর এলাকায় পুলিশের গুলিতে আহত হন বলে তার পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রায় ১৪ ঘণ্টা পর তার মৃত্যু হয়। তিনি ওই গ্রামের দরিদ্র কৃষক মো. আ. সামাদের বড় ছেলে।
নিহত জাকির হোসেনের পিতা আ. সামাদ (৬৫) জানান, ভিটেমাটিসহ সর্ব সাকুল্যে দেড় বিঘার মতো জমি রয়েছে তার। অভাবের সংসারে দুই ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে খুব কষ্টে দিন কাটছিল তার। পিতার কষ্ট লাঘব করতে এসএসসি পাসের পর ২০০৩ সালে তৈরি পোশাক কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন জাকির। কঠোর পরিশ্রম আর মেধার পরিচয় দিয়ে কয়েক বছর আগে সহকারী প্রোডাকশন ম্যানেজার হিসেবে পদোন্নতি পান গাজীপুর সদরের ভাওয়াল মির্জাপুর এলাকায় একটি তৈরি পোশাক কারখানায়। মাস ছয়েক আগে এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে ছোট পরিসরে ‘কাজী ভিআইপি গার্মেন্ট’ নামে একটি পোশাক তৈরির কারখানা গড়ে তুলেন তিনি। গত শুক্রবার দুপুরে কারখানার জন্য গাজীপুরের কোনাবাড়ি এলাকা থেকে জরুরি কিছু মালামাল কিনেন। পরে একজন বায়ারের ফোন পেয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে উত্তরা এলাকায় যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে আব্দুল্লাহপুর এলাকায় গিয়ে গাড়ি থেকে নেমে অন্য গাড়িতে ওঠার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সে সময় সেখানে পুলিশ ও জনতার ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলাকালে হঠাৎ পর পর দুটি গুলি এসে তার বুকে ও পেটে লাগলে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন জাকির হোসেন। আশপাশের জনগণ তাকে উদ্ধার করে উত্তরার বাংলাদেশ আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে আশঙ্কাজনক অবস্থায় কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করেন। খবর পেয়ে তার স্বজনরা তাকে দ্রুত সেখানে নিয়ে গেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০শে জুলাই শনিবার ভোর চারটার সময় তার মৃত্যু হলে পরদিন রোববার রাত দশটার সময় জানাজা শেষে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
জাকির হোসেনের স্ত্রী জান্নাতুন নাঈম (২৯) জানান, শুক্রবার সকালে তিনি বাসা থেকে সকালের খাবার খেয়ে বের হওয়ার সময় অফিসেই থাকবেন বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু শিফমেন্টের তাগাদার কারণে হঠাৎ করেই টঙ্গী গিয়েছিলেন জরুরি কিছু মালামাল কিনতে। বিকালে তিনি অফিসের লোকজনের কাছে তার স্বামীর গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর শুনতে পান। এ সময় হাসপাতালে ছুটে গেলেও স্বামীকে বাঁচানো সম্ভব হয় নি। এখন ছয় বছর ও দুই বছর বয়সী দুটি ছেলেকে নিয়ে কীভাবে সংসার চালাবেন তার কোনো কূলকিনারা ভেবে পাচ্ছেন না। তিনি তার স্বামী হত্যার সঠিক বিচার ও ক্ষতিপূরণ দাবি করেন।মানবজমিন