ডেস্ক রিপোট:- দেখামাত্র গুলির নির্দেশ অবিলম্বে প্রত্যাহার, সারা দেশে পুরোপুরি ইন্টারনেট চালু এবং প্রতিবাদীদের বিরুদ্ধে একটি বিশেষ বাহিনী এবং আধা সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার বন্ধের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সিনিয়র পরিচালক দেপ্রোসে মুচেনা। সংগঠনটির ওয়েবসাইটে দেয়া বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, কারফিউ চলাকালে দেখামাত্র গুলির নির্দেশ এবং ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া হবে না ভবিষ্যতে- এ বিষয়ে নিশ্চয়তা দিতে হবে। একই সঙ্গে তিনি নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের হাতে সব রকম মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ নিরপেক্ষভাবে এবং পক্ষপাতিত্বহীনভাবে তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন। বলেছেন, এর জন্য যারা দায়ী হবেন তাদেরকে জরুরি ভিত্তিতে পূর্ণাঙ্গ জবাবদিহিতায় আনতে হবে। ২৫শে জুলাই দেয়া বিবৃতিতে আরও বলা হয়, সংগঠনটি বাংলাদেশে কোটা সংস্কারের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতার বিশ্লেষণ করেছে।
এতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার কোটা বিরোধী আন্দোলন দমনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর বেআইনিভাবে শক্তি প্রয়োগ অব্যাহত রেখেছে। প্রায় ছয়দিন সরকার ইন্টারনেট সেবা বন্ধ রেখে গোটা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে বলেও উল্লেখ করেছে অ্যামনেস্টি। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা বিশ্লেষণ করেছে আন্তর্জাতিক ওই মানবাধিকার সংগঠন। বিভিন্ন ভিডিও এবং ছবির মাধ্যমে দেশের ক্রমবর্ধমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের কথা জানিয়েছে তারা। সংস্থাটির ক্রাইসিস এভিডেন্স ল্যাব বিক্ষোভ দমনের সময় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রাণঘাতী অস্ত্র বেআইনি ব্যবহারের তিনটি ঘটনার ভিডিও যাচাই করেছে।
এসব যাচাই- বাছাইয়ের পর অ্যামনেস্টি তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। সংগঠন বাংলাদেশ পুলিশের বিরুদ্ধে আন্দোলন দমনে বেআইনিভাবে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ করেছে।
বিবৃতিতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সিনিয়র পরিচালক মুচেনা আরও বলেন, কয়েক দিনে বাংলাদেশ থেকে যেসব ভিডিও এবং ছবি সংগ্রহ করা হয়েছে তাতে ক্রমাগত ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। বাংলাদেশ সরকার এবং র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) অতীত মানবাধিকার রেকর্ড ভয়াবহ উল্লেখ করে মুচেনা বলেন, বিক্ষোভ দমনে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে এবং ইন্টারন্টে বন্ধ করে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণের অনুপস্থিতিতে বিক্ষোভকারীদের অধিকার সঙ্কুচিত করা হয়েছে।
বিক্ষোভকারীদের নিহতের সঠিক সংখ্যা সহ নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত সকল মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত পরিচালনা করা উচিত বলে মনে করে অ্যামনেস্টি। মুচেনা বলেন, তদন্তে যাদেরকে দায়ী পাওয়া যাবে, তাদের সবাইকে জবাবদিহিতার আওতায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। এছাড়া পুলিশের বেআইনি শক্তি প্রয়োগের ফলে যারা হতাহত হয়েছেন তাদের পরিবারকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষতিপূরণ দেওয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। এতে বলা হয়, ১৮ই জুলাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেখ আশাবুল ইয়ামিন নামে একজন বিক্ষোভকারীর ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। তিনি মিলিটারি ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির ছাত্র। ঢাকার কাছে সাভারে একটি বাস স্টেশনের কাছেই বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। সে সময় তিনি আহত ও পরে নিহত হন। প্রথম ভিডিওতে দেখা যায়, আর্মার্ড পারসোনেল ক্যারিয়ার (এপিসি) ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক ধরে চালানো হচ্ছে। তার উপরে অচেতন পড়ে আছেন ইয়ামিন। দ্বিতীয় ভিডিওতে দেখা যায়, বাহু ধরে ইয়ামিনের দেহ উঁছু করার চেষ্টা করছেন একজন কর্মকর্তা। অন্য একজন তার পা ধরেন। ভয়াবহভাবে তার দেহ ওই যান থেকে নামানো হয়। এ সময় তার দেহ নিচে পড়ে ইয়ামিনের মাথায় আঘাত লাগে। চূড়ান্ত দফায় ভিডিওতে দেখা যায় এপিসি’ থেকে পুরো রায়ট গিয়ারে রয়েছেন দু’জন কর্মকর্তা। তাদের সামনে পড়ে থাকা ইয়ামিনের দেহের দিকে তাকিয়ে আছেন বলে মনে হয়। শেষ পর্যন্ত কর্মকর্তারা ইয়ামিনের দেহ মাটি থেকে টেনে তোলেন। তা টেনে নিয়ে যান রাস্তায় সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতার ওপর দিয়ে। কর্মকর্তারা যেপাশে দাঁড়ানো তার ঠিক উল্টো পাশে নিয়ে ফেলে রাখেন তাকে। রাস্তায় ইয়ামিনের দেহ ফেলে রেখে চলে যায় এপিসি। খবরে বলা হয়, ক্ষত থাকার কারণে পরের দিন ইয়ামিন মারা যান। এই তিনটি ভিডিও যাচাই করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। ১২ জন নিরাপত্তা কর্মকর্তার কাউকেই ইয়ামিনের চিকিৎসায় এগিয়ে যেতে দেখা যায়নি। নিরপেক্ষ ফরেনসিক পরীক্ষক ডেরিক পন্ডার এসব পরীক্ষা করে ইয়ামিনের বুকে ক্ষত থাকার প্রমাণ পেয়েছেন। তিনি অ্যামনেস্টিকে বলেছেন, সম্ভবত ছররা গুলি তার বামপাশের বুকে বিদ্ধ হয়েছে। এজন্য তিনি মারা গেছেন। আইন প্রয়োগকারীদের ছররা গুলি ছোড়া মারাত্মকভাবে বৈষম্যমূলক বলে মনে করে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
১৮ই জুলাইয়ের আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, ঢাকায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের খুব কাছ থেকে ভিতরে কাঁদানে গ্যাস ছুড়ছেন। এসব ভিডিও যাচাই করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। এরপর অ্যামনেস্টি বলেছে, পুলিশের অ্যাকশন ছিল বেআইনি এবং অপ্রয়োজনে শক্তির ব্যবহার। আইন প্রয়োগকারীরা কখনোই একটি আবদ্ধ স্থানে কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে পারে না, যেখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কোনো পথ নেই, রাসায়নিক ক্রিয়া দেখা দিতে পারে তাতে। স্থানীয় খবরে দাবি করা হয়েছে, ওইদিন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কাঁদানে গ্যাসে আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৩০ জন।
২০শে জুলাই থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও ক্লিপ ছড়িয়ে পড়েছে। তাতে দেখা যায় বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে একে- প্যাটার্নের অ্যাসল্ট রাইফেল থেকে গুলি ছুড়ছেন একজন কর্মকর্তা। সাত সেকেন্ডের এই ভিডিও যাচাই করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। তা ধারণ করা হয়েছে রামপুরা ডিআইটি রোডে একটি ব্যাংকের সামনে থেকে। এতে দেখা যায়, এপিসি’র সঙ্গে পুলিশ এবং বিজিবি’র কিছু কর্মকর্তা দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের একজন অফ-স্ক্রিন টার্গেটের দিকে চাইনিজ টাইপ ৫৬-১ অ্যাসল্ট রাইফেল তাক করে আছেন এবং দুই রাউন্ড গুলি করছেন। সমাবেশে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার যথাযথ নয়। যদি হামলায় মৃত্যুর হুমকি বা গুরুতর আহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে, শুধু তখনই এসব ব্যবহার করা যায়।