ডেস্ক রির্পোট:- বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) বিজ্ঞপ্তি থেকে চূড়ান্ত ফল পর্যন্ত সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সময় লেগে যাচ্ছে তিন থেকে চার বছর। করোনা মহামারির স্থবিরতাও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পিএসসিকে বেশ ভুগিয়েছে। পরীক্ষকদের খাতা দেখায় বিলম্বসহ বিভিন্ন কারণে বিসিএস শেষ করতে দেরি হচ্ছে। তবে পিএসসির কিছু পদক্ষেপের কারণে বিসিএস শেষ করার সময় কমে আসতে শুরু করেছে। বিগত বছরে দুটি বিসিএসের ফল প্রকাশ করেছিল পিএসসি। চলতি বছর দুটি এবং আগামী বছর আরও দুটি বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতে চায় কমিশন।
এ ছাড়া ২০২৬ সাল থেকে বছরে একটি বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সেটি শেষ করার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে সরকারের সংবিধিবদ্ধ সংস্থাটি।
পিএসসি সূত্রে জানা গেছে, গত বছর ৪১তম ও ৪৩তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করেছে পিএসসি। কমিশন এখন তিনটি বিসিএস নিয়ে কাজ করছে। এর মধ্যে একটি বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ শেষে মৌখিক পরীক্ষা চলছে। দ্বিতীয়টির লিখিত পরীক্ষা হলেও ফল প্রকাশ হয়নি এবং অন্যটির প্রিলির ফল শেষে লিখিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। ৪০, ৪১ ও ৪৩তম বিসিএসের প্রতিটি শেষ করতে পিএসসির সময় লেগেছে তিন থেকে সাড়ে তিন বছর। এ সময়টা কমিয়ে আনার চেষ্টাই করে যাচ্ছে পিএসসি।
পিএসসি থেকে জানা গেছে, ৪০তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে ২০১৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হয়েছে ২০১৯ সালের ৩ মে। একই বছরের ২৫ জুলাই প্রিলির ফল প্রকাশিত হয়েছে। ২০২০ সালের ৮ ও ৯ মার্চ লিখিত পরীক্ষা শেষে ফল প্রকাশ হয়েছে ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি। পরের মাসের ১৬ তারিখ মৌখিক পরীক্ষা (ভাইভা) শুরু হয়েছে। ২০২২ সালের ৩০ মার্চ চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করেছে পিএসসি। অর্থাৎ, এই বিসিএস শেষ করতে সময় লেগেছে সাড়ে তিন বছর। এদিকে, ৪১তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি হয়েছে ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর। ২০২১ সালের ১৯ মার্চ প্রিলি পরীক্ষার পর একই বছরের ২ আগস্ট ফল প্রকাশ করা হয়েছে। ওই বছরেরই ২৯ নভেম্বর লিখিত পরীক্ষা নিয়ে ফল প্রকাশ করা হয়েছে ২০২২ সালের ১০ নভেম্বর। ২০২৩ সালের ৫ মার্চ থেকে ২৬ জুন মৌখিক পরীক্ষা শেষে ওই বছরের ৬ আগস্ট চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এই বিসিএস শেষ করতে সময় লেগেছে ৩ বছর ৮ মাস। অন্যদিকে, ৪৩তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি হয়েছে ২০২০ সালের ৩০ নভেম্বর। ২০২১ সালের ২৯ অক্টোবর প্রিলি পরীক্ষা শেষে ফল প্রকাশিত হয় ২০২২ সালের ২০ জানুয়ারি। ওই বছরের ২৪ জুলাই থেকে লিখিত শুরু হয়েছে। ফল প্রকাশ হয়েছে ২০২৩ সালের ২০ আগস্ট। এরপর ৩ সেপ্টেম্বর থেকে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত হয়েছে মৌখিক পরীক্ষা। চূড়ান্ত ফল প্রকাশ হয়েছে ওই বছরেরই ২৬ ডিসেম্বর। এই বিসিএস শেষ করতে পিএসসি সময় নিয়েছে তিন বছর।
আরও জানা গেছে, ৪৪তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি হয়েছে ২০২১ সালের ৩০ নভেম্বর। ২০২২ সালের ২৭ মে প্রিলি পরীক্ষার পর ফল প্রকাশ হয়েছে ওই বছরের ২২ জুন। লিখিত পরীক্ষাও শুরু হয়েছে একই বছরের ২৯ ডিসেম্বর। ফল প্রকাশ হয়েছে চলতি বছরের ৩ এপ্রিল। মৌখিক শুরু হয়েছে গত ৮ মে, চলবে ৩১ জুলাই পর্যন্ত। বিগত সময়গুলোতে বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষার পর দেড় থেকে আড়াই বছরের মধ্যে চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হয়েছে। সে ধারাবাহিকতায় আগামী সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরে এই বিসিএসের ফল প্রকাশ হতে পারে। তাতে এই বিসিএস শেষ করতে সময় লাগবে তিন বছরেরও কম। অন্যদিকে, ৪৫তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি হয়েছে ২০২২ সালের ৩০ নভেম্বর। ২০২৩ সালের ১৯ মে প্রিলি পরীক্ষার পর ফল প্রকাশ হয়েছে ৬ জুন। লিখিত পরীক্ষা হয়েছে চলতি বছরের ২৩ থেকে ৩১ জানুয়ারি। এই পরীক্ষার ফল আগস্টের শেষদিকে বা সেপ্টেম্বরের শুরুতে হতে পারে। এরপর মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে ডিসেম্বরের মধ্যেই চূড়ান্ত ফল প্রকাশ হতে পারে বলে জানিয়েছে পিএসসি সূত্র। সব ঠিক থাকলে দুই বছরের মধ্যেই ৪৫তম বিসিএসের ফল প্রকাশ হতে পারে।
জানা গেছে, ৪৬তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি হয়েছে ২০২৩ সালের ৩০ নভেম্বর। প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হয়েছে চলতি বছরের ২৬ এপ্রিল। এরপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে মাত্র ১৩ দিনের মাথায় গত ৯ মে প্রিলির ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এই বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা আগামী ২৮ আগস্ট শুরু হবে, চলবে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।
পিএসসি সূত্র বলছে, প্রতি বছরের ৩০ নভেম্বর বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি হচ্ছে। গত তিন বছর একই তারিখে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে। সে হিসেবে এ বছরের নভেম্বরে ৪৭তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি হবে। আগামী বছরের প্রথমার্ধে, মানে ছয় মাসের মধ্যে ৪৬তম বিসিএসের ফলও হয়ে যাবে। বাকি সময়টায় ৪৭তম বিসিএসের কার্যক্রম চলবে এবং সেপ্টেম্বরের মধ্যেই এই বিসিএসের কার্যক্রমও শেষ করতে চায় পিএসসি।
বিগত কয়েকটি বিসিএসে মৌখিক পরীক্ষার পরে দেড় থেকে দুই মাসের মধ্যে চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করেছে পিএসসি; ৪৪তম বিসিএসেও সেই সময় একই থাকবে কি না—জানতে চাইলে পিএসসি চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন বলেন, আমরা অন্য বিসিএসগুলোর তুলনায় ৪৪তম বিসিএসের ফল আরও কম সময়ে প্রকাশের চেষ্টা করছি। পাশাপাশি চলতি বছরের মধ্যেই ৪৫তম বিসিএসের ফল প্রকাশের চেষ্টাও চলছে। সে কারণে ৪৫তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফল আগস্টের শেষদিকে বা সেপ্টেম্বরের শুরুতে দেওয়ার চেষ্টা করছি। চলতি বছরই দুটি বিসিএস শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা আগামী বছরের শুরুতে ৪৬তম বিসিএসের ফল প্রকাশের চেষ্টা করব। আগের বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় আগামী ৩০ নভেম্বর ৪৭তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হবে। আগামী বছরের সেপ্টেম্বরে আমার অবসরের আগেই ৪৭তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশের সর্বোচ্চ চেষ্টাও করব।
তিনি আরও বলেন, বিসিএসে সময় কমে এসেছে। এক বছরের মধ্যেই বিসিএস শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে পদের চাহিদা দেরি করে আসাসহ বিভিন্ন কারণে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন নাও হতে পারে। তবে একটি বিসিএস ২০ মাসের আগে শেষ করতে পারলেই সেটি রেকর্ড।
বিসিএস নিয়ে নতুন পরিকল্পনা: এদিকে, মান বাড়াতে বিসিএস পরীক্ষার পদ্ধতি ও মূল্যায়নে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে পিএসসি। ৪৬তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা থেকে শুরু হবে এর বাস্তবায়ন। পাশাপাশি বিসিএসের সময় কমিয়ে আনার জন্যও কিছু উদ্যোগ নিয়েছে সংস্থাটি।
পিএসসি সূত্র জানিয়েছে, ৪৬তম বিসিএস থেকে লিখিত পরীক্ষায় উত্তরগুলো প্রশ্নের ক্রমানুসারে লিখতে হবে। এই পদ্ধতি বাস্তবায়িত হলে পরীক্ষার্থীদের খাতা পিএসসি কার্যালয়ে বসেই দেখবেন পরীক্ষকরা। পরীক্ষকদের খাতা দেখার আগে প্রশ্নের উত্তরপত্রও সরবরাহ করা হবে। নতুন পদ্ধতিতে খাতা দেখার জন্য দ্বিতীয় ও তৃতীয় পরীক্ষকের প্রয়োজন হবে না।
এ বিষয়ে পিএসসি চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন বলেন, পরীক্ষক পিএসসি কার্যালয়ে এসে খাতা দেখলে খাতা দেখার মান ভালো হবে এবং সময়ও বাঁচবে। আগে যেখানে ছয় থেকে সাত মাস সময় লাগত, তা কমে আসবে দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে। এর ফলে জটটা কমে যাবে। আবার একই সঙ্গে একেকজন পরীক্ষক একেকভাবে খাতা দেখার সুযোগও পাবেন না। পাইলটিং হিসেবে ৪৫তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার গণিত বিষয়ের খাতা পিএসসি কার্যালয়ে দেখা হয়েছে বলে জানান চেয়ারম্যান।
সূত্র জানিয়েছে, পিএসসিতে বর্তমানে ১৭ জন সদস্য আছেন। পিএসসির নতুন আইন অনুযায়ী সংস্থাটিতে সর্বাধিক ২০ সদস্য নিয়োগ দেওয়া যাবে। বাকি তিনটি পদ পূরণে সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছে পিএসসি। এ বিষয়ে পিএসসি চেয়ারম্যান বলেন, বোর্ড কম থাকায় ভাইভা নিতে দেরি হয়, যে কারণে সুপারিশ প্রক্রিয়ায়ও বিলম্ব হয়ে যায়। পিএসসিতে কয়েকটি সদস্য পদ খালি রয়েছে। সেগুলো পূরণে আমরা সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছি। এই পদগুলো পূরণ হলে বোর্ডের সংখ্যা বাড়বে। এতে আরও বেশি পরিমাণ বোর্ডে ভাইভা নেওয়া যাবে। ফলে ভাইভার সময় কমে আসবে।
তিনি আরও বলেন, আমার হাতে একসঙ্গে ছয়টা বিসিএস ছিল। সেটিকে আমরা কমিয়ে এনেছি। গত বছর একসঙ্গে দুটি বিসিএসের ফল দেওয়া হয়েছে। বছরে দুটি বিসিএসের ফল যেহেতু দিতে পেরেছি, একটা কেন পারব না? আমাদের পরিকল্পনা বছরে একটি বিসিএস শেষ করা।
বিসিএসের প্রার্থী বাছাই করা হয় তিন ধাপে। ধাপগুলো হলো—প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা। প্রথম ধাপে ২০০ নম্বরের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় ধাপে প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণরা মোট ১১০০ নম্বরের (জেনারেল ও টেকনিক্যাল ক্যাডারের জন্য) লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন। তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের ২০০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর চূড়ান্ত ফল ঘোষণা করা হয়।কালবেলা