ডেস্ক রির্পোট:- ‘সাত দিনের মইদ্দে (মধ্যে) এক দিন রান্দিছি (রান্না করেছি), খুব অভাব, খুব কষ্টের মইদ্দে আছি। গত পরশু দিন রান্দিছি, আর রান্দাবাড়ি করি নাই। বানের পানি বাড়তে বাড়তে টঙ (চৌকি) তলায় যায়, চুলা তলায় যায়, একেবারেই রান্দন যায় না। এহন ঘরে রান্দার মতো কিছু নাই, আইজ আর চুলায় আগুন জ্বালাই নাই। সকালে কয়ডা চিড়া খাইছি।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন বৃদ্ধ জমিলা খাতুন।
তার সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে স্বামী শাহ জামাল বলেন, ‘সাত-আট দিন ধরে বন্যার পানির মইদ্দে টঙ পাইতা আছি। টঙ তলায় জায়গা, আবার উঁচা কইরা দিই। খাবার পানির খুব কষ্ট, পানি কল তলায় গেছে তাও কষ্ট কইরা ওই পানিই খাই। কোথাও যাওয়ার মতো নৌকা নাই, কেউ খোঁজ-খবরও নেয় নাই। সকালে চাইড্ডা চিড়া খাইছি, এহনো পর্যন্ত কিছু খাই নাই, আমরা দুই বুড়া-বুড়ি এইভাবেই আছি।’
জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার বন্যাকবলিত সাপধরি ইউনিয়নের যমুনার দুর্গম দ্বীপচর নামারচর। এই চরের ৬৫ বছর বয়সী কৃষক শাহ জামাল ও ৫০ বছর বয়সী জমিলা খাতুন দম্পতি এখনো অবস্থান করছেন তাদের নিজ ঘরে। আশপাশের বেশির ভাগ মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে গেলেও তারা থেকে গেছেন বন্যার পানিতে নিমজ্জিত বাড়িতেই।
বানের পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মাথা গোঁজার চৌকিটিও উঁচু করা হয়েছে। রান্নার জন্য চেয়ারের ওপর পেতে রাখা হয়েছে চুলা, এক সপ্তাহে মাত্র একবার রান্না হয়েছে এই চুলায়। এখন রান্না করে খাওয়ার মতো ঘরে কিছু নেই, তাই গত দুই দিন ধরে চুলায় আগুন জ্বলেনি।
বন্যার পানি আসার পর থেকে তাদের এক বেলাও তৃপ্তির আহার জোটেনি। রান্না না হওয়ায় শুকনো খাবার খেয়ে চলে এই বানভাসীদের জীবন। একই ইউনিয়নের ছিটপাড়া গ্রামের মোস্তফা ও মিনারার তিন সন্তান ও বৃদ্ধ মা মোমেনাসহ বন্যাদুর্গত এলাকার সব মানুষের সকাল থেকে রাত কাটছে এভাবেই। শিশুসহ পরিবার-পরিজন, গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি নিয়ে এক অনিশ্চয়তায় কাটছে তাদের প্রতিটি মুহূর্ত। দূর থেকে নলকূপের পানি সংগ্রহ করে আবার কখনো বন্যার পানি পান করেন তারা। পানিতে ডুবে গেছে রান্নাঘর ও চুলা, ভেসে গেছে জ্বালানি লাকড়ি। নৌকার অভাবে বাজারে যাওয়া হয় না, তাই রান্না করা খাবারের পরিবর্তে চিড়া-মুড়ি খেয়েই কোনোমতে বেঁচে আছেন।
জামালপুরে গত এক সপ্তাহ ধরে চলা বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকায় দুর্গতরা চরম দুর্ভোগে রয়েছেন। উজানের ঢল আর ভারী বৃষ্টিতে নদ-নদী, তীর ও চরাঞ্চল বন্যার পানিতে মিলেমিশে একাকার। দুর্গতদের অনেকেই নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিলেও এখনো অনেকেই অবস্থান করছেন পানিতে নিমজ্জিত বাড়ি-ঘরে। আশ্রয় যেখানেই হোক দুর্গত এলাকায় দেখা দিয়েছে খাবার ও সুপেয় পানির তীব্র সংকট।
জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ, বকশীগঞ্জ, ইসলামপুর, মেলান্দহ, মাদারগঞ্জ ও সরিষাবাড়ী উপজেলার অন্তত ৫০টি ইউনিয়নের দুই লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। বন্যার পানিতে বিভিন্ন আঞ্চলিক সড়ক ও স্থানীয় রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। প্রতিদিন প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। চারদিকে পানি, হাট-বাজার করা বা আশ্রয়ের জন্য কোনো জায়গায় যাওয়া দুর্গতদের জন্য খুবই কষ্টসাধ্য। নলকূপ ও রান্না করার চুলা বন্যার পানিতে ডুবে রয়েছে তাই এই মুহূর্তে দুর্গত এলাকায় দেখা দিয়েছে তীব্র খাদ্য ও সুপেয় পানির সংকট।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন জানান, ইসলামপুর উপজেলার দুর্গম সাপধরি ইউনিয়নে সব ‘আধুনিক সুযোগ-সুবিধা’ সংবলিত একটি আশ্রয়কেন্দ্র চালু রয়েছে। অনেকেই সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণ সরবরাহ করা হচ্ছে। তিনি আরও জানান, জেলার পাঁচটি উপজেলা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুর্গত এলাকার জন্য ৫০০ টন চাল, ১০ লাখ টাকা ও সাড়ে ৪ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ পাওয়া গেছে। ৪৮০ টন চাল আগের বরাদ্দ ছিল, যার সিংহভাগ এরই মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। পর্যাপ্ত ত্রাণ মুজত আছে, দুর্গতদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যা রোধ করা অসম্ভব হলেও দুর্গতদের দুর্ভোগ লাঘব করা সম্ভব। দুর্গম এলাকার বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া ও সব দুর্গতের মাঝে সঠিকভাবে পর্যাপ্ত পরিমাণ ত্রাণ বিতরণের উদ্যোগ গ্রহণের দাবি স্থানীয়দের।খবরের কাগজ