ডেস্ক রির্পোট:- দীর্ঘ এক যুগ ‘পরিত্যক্ত’ থাকা নগরের জাতিসংঘ পার্ককে গড়ে তোলা হচ্ছে ‘সবুজ উদ্যান’ হিসেবে। এ লক্ষ্যে গণপূর্ত অধিদপ্তরের ১২ কোটি ৬৫ লাখ টাকায় গৃহীত প্রকল্পের আওতায় উন্নয়ন করা হচ্ছে পাঁচলাইশে অবস্থতি পার্কটি। প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যে পার্কের দৃষ্টিনন্দন সীমানা প্রাচীর, প্রবেশপথ, হাঁটার জন্য ওয়াকওয়ে’সহ অন্যান্য অবকাঠামোগত কাজ শেষ হয়েছে। গাছ ও ঘাস লাগানো, বসার জন্য বেঞ্চ নির্মাণসহ অল্প কিছু কাজ বাকি আছে। যা টানা বৃষ্টি না হলে চলতি মাসেই শেষ হবে বলে আজাদীকে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। এর আগে পার্কটির বিশাল অংশ অংশজুড়ে সুইমিংপুল নির্মাণ করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। এরপর ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে এ পার্ককে ঘিরে বাণিজ্যিকীকরণের উদ্যোগ নেয় সংস্থাটি। যার অংশ হিসেবে ওই সময় পার্কটির একটি অংশে ‘কমিউনিটি সেন্টার ও গেস্ট হাউস’ নির্মাণে একটি ঠিকদারি প্রতিষ্ঠানকে ২৫ বছরের জন্য ইজারা দেয়ার প্রক্রিয়াও শুরু করে। এ বিষয়ে ২০১৬ সালের ১৬ মে স্থানীয় দৈনিকে জাতিসংঘ পার্কে কমিউনিটি সেন্টার, গেস্ট হাউস’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর নড়েচড়ে বসে সবাই। শুরু হয় আন্দোলন। পার্কটির মালিকানা দাবি করে গণপূর্ত অধিদপ্তর কাজ বন্ধে নোটিশ দেয় চসিককে। উচ্চ আদালতে রিট করে পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকা কল্যাণ সমিতি। এতে আটকে যায় চসিকের উদ্যোগ। পরবর্তীতে পার্কটির উন্নয়নে ২০১৭ সালে প্রকল্প নেয় গণপূর্ত অধিদপ্তর। এতেও আপত্তি দেয় চসিক। শেষ পর্যন্ত গণপূর্তের প্রকল্পেই দৃষ্টিনন্দন পার্ক বা সবুজ উদ্যান হয়ে উঠছে জাতিসংঘ পার্ক। গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নির্মাণ শেষে পার্কটি সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। এখন পর্যন্ত কোনো প্রবেশ ফি নেয়ারও সিদ্ধান্ত হয়নি। এছাড়া পার্ক এলাকায় কোনো দোকানপাট বা বাণিজ্যিক কিছু থাকবে না। বিষয়টিকে সাধুবাদ জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকা কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আবু সাঈদ সেলিম বলেন, গণপূর্ত অধিদপ্তরের সহযোগিতায় জাতিসংঘ পার্ক নির্মল বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠছে। এটি হবে সুন্দর মডেল পার্ক। এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন পর পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকার বাসিন্দারা তাদের অধিকার ফিরে পাচ্ছে। এখানে বাণিজ্যিক স্থাপনা করার যে উদ্যোগ ছিল তার প্রতিবাদ জানিয়েছে পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকা কল্যাণ সমিতি।
নতুন করে নির্মিত জাতিসংঘ পার্কে বাণিজ্যিকীকরণের উদ্দেশে কোনো দোকানপাট নির্মাণ করা হবে কীনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, গণপূর্ত অধিদপ্তর থেকে আমাদের আশ্বস্ত করেছে এখানে কোনো দোকানপাট হবে না। কোনো দোকান হলে আমরা আবার আন্দোলনে যাব। এমনকি পার্কের আশপাশে ব্যক্তিগত উদ্যোগেও যাতে কোনো দোকানপাট নির্মাণ করা না হয় তার ব্যবস্থা নিয়েছি আমরা।
১২ কোটি টাকায় সবুজ উদ্যান : ‘পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকায় আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন জাতিসংঘ সবুজ উদ্যান উন্নয়ন’ শীর্ষক গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রকল্পটি ২০২২ সালের ৪ জুলাই পরিকল্পনা কমিশনে অনুমোদন পায়। তখন প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় ১১ কোটি ৭০ লাখ ১২ হাজার টাকা। পরবর্তীতে তা বেড়ে ১২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা হয়। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত।
প্রকল্পে রয়েছে সীমানা প্রাচীর, অফিস ও টিকেট কাউন্টারসহ প্রবেশ গেইট নির্মাণ, দুই হাজার ৯৪০ বর্গমিটার ওয়াকওয়ে, ৪৪টি আরসিসি বসার সিট এবং ৮ হাজার ৩৩ ঘনমিটার মাটি দিয়ে পার্কের ভূমির উন্নয়ন। এছাড়া পার্কে শিশুদের জন্য খেলাধুলার সরঞ্জাম এবং শরীর চর্চার জন্য হরিজন্টাল বার ও দুইটি মেটাল পারগোলা, টয়লেট ব্লক, ড্রেন, ডাস্টবিন, কম্পাউন্ড লাইট, স্ট্রিট লাইট, পাম্প মোটর, বজ্র নিরোধন, সিসি ক্যামেরা, সোলার সিস্টেম, আরবরিকালচার ও ল্যান্ডস্কেপিং রয়েছে।
গতকাল সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, সীমানা দেয়াল ও ওয়াকওয়ে নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। পার্কের মাঝখানে নির্মাণাধীন ফোয়ারার কাজও শেষের পথে। গণপূর্ত অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের (সার্কেল–১) নির্বাহী প্রকৌশলী কামরুল হাসান খান বলেন, অল্প কিছু কাজ বাকি আছে। টানা বৃষ্টি হওয়ায় কাজ করা যাচ্ছে না। ওয়াকওয়ে’র ফিনিশিং বাকি আছে। এছাড়া বসার জন্য কিছু বেঞ্চ স্থাপন এবং ঘাস লাগানোর কাজ বাকি আছে। চলতি জুলাই মাসের মধ্যেই এসব শেষ হবে।
শারমী নামে মধ্য বয়সী এক নারী নিজেকে পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকার বাসিন্দা পরিচয় দিয়ে বলেন, একসময় পার্কটি অনেক সুন্দর ছিল। গাছপালা ছিল। আমরা এখানে সকালে ও বিকেলে হাঁটতাম। আশেপাশের এলাকা থেকেও লোকজন আসত। সিটি কর্পোরেশন প্রথমে এখানে সুইমিং পোল নির্মাণ করে পার্কটি অর্ধেক শেষ করে দেয়। বাকি অংশটুকুও ধীরে ধীরে পরিত্যক্ত হয়ে যায়। পানিতে ডুবে থাকত। তখন এটি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। দীর্ঘ কয়েকবছর পর এটি আবারও সত্যিকার অর্থে পার্ক হয়ে উঠছে। দেখে ভাল লাগছে।
পার্ক নির্মাণে যত জটিলতা : জাতিসংঘ পার্কটি দুই দশমিক ২৭ একর জায়গার উপর অবস্থিত। ১৯৫৪ সালে চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকাটি বরাদ্দ দেয় গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। ওই সময়ে লে–আউটে পার্কটি ছিল। এরপর ২০০২ সালে চসিক পার্কটির নামকরণ করে জাতিসংঘ পার্ক। শিশু কিশোরসহ বিনোদন প্রেমী মানুষের কাছে এ পার্কটি সে সময় দর্শনীয় স্থান হিসাবে পরিচিতি পায়। কিন্তু দিনে দিনে পার্কটির প্রতি অবহেলা আর অযত্নের চাপ পড়তে থাকে। এতে পার্কটি জৌলুস হারায়। প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পৌঁছে যায়। ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে পার্কে থাকা একটি পুকুরও।
এরপর ২০১২ সালের ৩ ডিসেম্বর জাতিসংঘ পার্কের একটি অংশে সুইমিং পুল নির্মাণের ভিত্তির প্রস্তর করেন তৎকালীন মেয়র এম মনজুর আলম। ২০১৫ সালের জুনে তিন কোটি ৯৪ লাখ টাকায় দুইটি সুইমিং পুল ও জিমনেশিয়াম নির্মাণ কাজ শেষ হয়। যা নতুন করে পার্কটি সাজানোর জন্য ভেঙে ফেলা হয়। এর আগে সুইমিং পুল নির্মাণের সময় চসিকের পক্ষে বলা হয়েছিল, পার্কটির উন্মুক্ত অংশটিও সাজানো হবে। গড়ে তোলা হবে নান্দনিক বিনোদন পার্ক। কিন্তু তা করা হয়নি। ফলে ২০১২ সালে চসিকের সুইমিং পুল নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ থেকেই কার্যত পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল পার্কটি।
পরবর্তীতে ২০১৬ সালে পার্ককে ঘিরে চসিকের বাণিজ্যিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ আটকে যায়। এরপর ২০১৭ সালের ১১ অক্টোবর পার্ককে ঘিরে চসিকের গৃহীত প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং পারিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্যকে চিঠি দেয় স্থানীয় সরকার বিভাগ। তবে আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকায় প্রকল্পের কাজ শুরু করতে পারেনি চসিক।
এর মধ্যে ২০১৭ সালে পার্ক উন্নয়নে প্রকল্প নেয় গণপূর্ত অধিদপ্তর। ওই প্রকল্পের বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়ে একই বছরের ৪ সেপ্টেম্বর চসিকের তৎকালীন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন স্থানীয় সরকার মন্ত্রীকে একটি পত্র দেন। এর কয়েকদিন পর ৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভায়ও চসিক প্রতিনিধি গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পটির বিরুদ্ধে আপত্তি জানান। এতে স্থগিত করা হয় গণপূর্তের প্রকল্পটি।
এরপর ২০১৯ সালের অক্টোবরে চসিকের তৎকালীন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন ও গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সর্ম্পকিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির তৎকালীন সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন পারস্পরিক আলাপে একমত হন, গণপূর্ত মন্ত্রণালয় প্রকল্প বাস্তবায়ন করে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য চসিকে হস্তান্তর করবে। পরের বছর প্রশাসকের দায়িত্ব পালনকালে খোরশেদ আলম সুজন গণপূর্ত অধিদপ্তরকে প্রকল্প বাস্তবায়নে অনাপত্তি পত্র দেন। পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকা কল্যাণ সমিতির করা রিটটিও প্রত্যাহার করা হয়। ফলে গতি পায় গণপূর্তের প্রকল্প।
পরবর্তীতে ২০২১ সালের ২৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত পিইসি (প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি) সভায় গণপূর্তের প্রকল্পটি নিয়ে একাধিক পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়। এরপ্রেক্ষিতে প্রকল্পটি সংশোধন করে গত ১৮ মে পরিকল্পনা কমিশনে প্রেরণ করে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। যা ২০২২ সালের ৪ জুলাই পরিকল্পনা কমিশন চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়। আজাদী