ডেস্ক রির্পোট:- উজানের ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর টানা কয়েক দিনের ভারী বর্ষণের কারণে সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নিলফামারি, গাইবান্ধাসহ বেশ কয়েকটি জেলার নিম্নাঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেছে। এরোই মধ্যে সিলেট শহর পানির নীচে ৭ লাখ লোক পানিবন্দী। সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে কয়েক শত শত গ্রাম বন্যাকবলিত। রংপুর বিভাগের চারটি জেলার চরাঞ্চলগুলো তলিয়ে গেছে পানির নীচে। রংপুরের তিস্তা নদীর কাউনিয়া পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তাসহ প্রধান নদ-নদীর পানি কয়েকটি স্থানে বিপৎসীমার ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে। আগামী কয়েক দিন অবিরাম বর্ষণের সম্ভাবনা থাকায় রংপুর, নীলফামারী, গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামের বন্যা পরিস্থিতি তৈরির আশঙ্কা করা হচ্ছে। অনেকেই বন্যার আভাস পেয়ে গবাদি পশু অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন। নিজেরাও নিরাপদে আশ্রয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
সিলেট : তিনদিনের টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে সিলেটে চলমান দ্বিতীয় দফা বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। চলমান এ বন্যায় মহানগর ও জেলাজুড়ে প্রায় ৭ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। এর মধ্যে শুধু সিলেট নগরীর ২১টি ওয়ার্ডেই প্রায় ৫০ হাজার মানুষ বন্যার কবলে পড়েছে।
২০ দিনের মাথায় দ্বিতীয় দফা বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে সিলেট। ২৭ মে সিলেটে আগাম বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এতে জেলার সব উপজেলার সাড়ে ৭ লাখ মানুষ আক্রান্ত হন। সেই বন্যার পানি পুরোপুরি নামার আগেই ১৫ জুন (শনিবার) আবার বন্যাকবলিত হয় সিলেট।
ঈদের দিন ভোর থেকে সিলেটে শুরু হয় ভারী বর্ষণ, সঙ্গে নামে পাহাড়ি ঢল। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই তলিয়ে যায় মহানগরের অনেক এলাকা। জেলার বিভিন্ন স্থানেও সৃস্টি হয় বন্যা পরিস্থিতি। গত সোমবার বিকেলে বৃষ্টি থামলে ধীরে ধীরে পানি কিছুটা কমে। কিন্তু মঙ্গলবার ভোর থেকে আবার শুরু হয় বৃষ্টি। উজানেও প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। ফলে হু হু করে বাড়তে থাকে সিলেটের সব নদ-নদীর পানি। গতকাল বুধবার ৩টি নদীর পানি ৬ পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, সিলেট মহানগরীসহ ১৩টি উপজেলায় প্রায় ৭ লাখ মানুষ পানিবন্দী রয়েছেন। এর মধ্যে সিলেট মহানগরীর ৪২টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২১টি ওয়ার্ডের ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দী রয়েছেন। জেলা ও মহানগর মিলিয়ে ৬২৭টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এর মধ্যে মহানগরে ৮০টি। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ১৭ হাজার ২৮৫ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। তবে, বেশির ভাগ মানুষ নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে ইচ্ছুক নন। অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন প্রতিবেশীদের উঁচু বাসাবাড়ি বা আত্মীয়-স্বজনের ঘরে। জেলার ১৩টি উপজেলায় ১ হাজার ৩২৩টি গ্রাম বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, গোলাপগঞ্জ, কোম্পানীগঞ্জ, কানাইঘাট ,জকিগঞ্জ, বিশ্বনাথ ও ওসমানীনগর উপজেলা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিলেট কার্যালয় জানিয়েছে, এ সময় সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ৯১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। একই নদীর পানি সিলেট পয়েন্টে বইছে বিপদসীমার ৩৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে। কুশিয়ারা নদীর পানি আমলশীদ পয়েন্টে বিপদসীমার ৪৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। একই নদীর পানি ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে ৯২ ও শেরপুর পয়েন্টে বিপদসীমার ১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। এছাড়া সারি-গোয়াইন নদীর পানি সারিঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ০.৯ সে.মি সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। স্থানীয়রা আশঙ্কা করছেন, সিলেটজুড়ে ২০২২ সালের মতো ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। মহানগরের শাহজালাল উপশহর, যতরপুর, মেন্দিবাগ, শিবগঞ্জ, রায়নগর, সোবহানীঘাট, কালিঘাট, কামালগড়, মাছিমপুর, তালতলা, জামতলা, কাজিরবাজার, মদিনা মার্কেট, আখালিয়া, মেজরটিলা ও দক্ষিণ সুরমা এলাকার লাউয়াই, বরইকান্দি, আলমপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় অনেকের বাসাবাড়িতে গলা পর্যন্ত পানি। নিচু এলাকাগুলোর কলোনি বা বাসাবাড়ি প্রায় পুরোটাই তলিয়ে গেছে বন্যার পানিতে। এতে চরম বিপাকে এসব এলাকার মানুষ। অনেকে গেছেন আশ্রয়কেন্দ্রে, আবার অনেকে নিজের বাসাবাড়ি ছেড়ে যেতে চাচ্ছেন না। অপরদিকে, সিলেট সদর, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও জৈন্তাপুরসহ কয়েকটি উপজেলার গ্রামীণ অনেক রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। অনেক কৃষিজমির ফসল তলিয়ে গেছে, ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, বন্যার সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়গুলোতে কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় ডেডিকেটেড অফিসার নিয়োগের পাশাপাশি প্রতিটি ইউনিয়নে ট্যাগ অফিসার নিয়োগ করা হয়েছে।
সুনামগঞ্জ: ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে সৃষ্ট বন্যায় সুনামগঞ্জের ১২টি উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ঝড়-বৃষ্টি, বজ্রপাতসহ দমকা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে সুনামগঞ্জের ওপর দিয়ে। হাওর অঞ্চলের মানুষের মধ্যে বিরাজ করছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। গতকাল বুধবার সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার জানিয়েছেন, সুনামগঞ্জ পৌর শহরের ষোলঘর পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ৪০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে, ছাতক উপজেলায় বিপৎসীমার ১৪৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে এবং দিরাই উপজেলায় ১৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জে ১০০ মিলিমিটার, লাউড়ের গড়ে ৭৮ মিলিমিটার, ছাতকে ৮৪ মিলিমিটার এবং দিরাইয়ে ৭৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। নদীর পানি কমলেও বর্ষণ অব্যাহত থাকায় পানি বাড়তে পারে। গত তিন ধরে জেলার প্রতিটি উপজেলা বন্যা আক্রান্ত হয়ে সড়ক পানিতে ডুবে যাওয়ায় জেলার সাথে যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। সুরমা নদীর পানি প্রতি মুহূর্তে বৃদ্ধি পাচ্ছে। জেলার পৌর শহরের বিভিন্ন এলাকার ৮০ ভাগ প্লাবিত হয়েছে। সুরমা, যাদুকাটা, চেলাসহ সীমান্তের নদীগুলো দিয়ে পানি ভাটির দিকে প্রবাহিত হওয়ায় তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, মধ্যনগর, বিশ্বম্ভরপুর, ধর্মপাশা, জগন্নাথপুর, দিরাই, শাল্লা, শান্তিগঞ্জ উপজেলা প্লাাবিত হয়েছে। অনেকেই নিজ নিজ বসতবাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্র ও উঁচু স্থানে যাচ্ছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সুনামগঞ্জের ৬৯টি ইউনিয়ন ও দুটি পৌরসভার প্রায় চার লাখের অধিক মানুষ বন্যাকবলিত। এর মধ্যে প্রায় ১২ হাজার ৪৩৯ জন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। পানিতে ডুবে আছে তাহিরপুর-বিশ্বম্ভরপুর-সুনামগঞ্জ সড়ক। ছাতক-গোবিন্দগঞ্জ সড়ক,দোয়ারাবাজার-ছাতক সড়ক, জামালগঞ্জ-সুনামগঞ্জ সড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলায় ৫ হাজার জন, বিশ্বম্ভরপুরে ২২ হাজার, শান্তিগঞ্জে ১৫ হাজার, তাহিরপুরে ১ লাখ ৪০ হাজার, জামালগঞ্জে ১২ হাজার ৬৭০, জগন্নাথপুরে ৩৭ হাজার ৩১০, দিরাইয়ে ৭৮ হাজার ২৫০, শাল্লায় ১১৭, ছাতকে ২ লাখ ও দোয়ারা বাজার উপজেলায় ৫০ হাজার লোক বন্যা কবলিত হয়েছে।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৗশলী মামুন হাওলাদার জানিয়েছেন, আগামী ৬ দিন বৃষ্টি ও মেঘালয় থেকে পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকবে। নিম্নাঞ্চলে পানি বাড়ছে। বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা রয়েছে। সবাইকে সর্তক থাকতে হবে।
শাল্লা উপজেলা (সুনামগঞ্জ) : বন্যা আতঙ্কে দিন-রাত পার করছে সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লা উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমের শুরুতে নদ-নদীগুলোতে পানি বৃদ্ধি পায়।তবে গেল ২০২২ সালের সর্বগ্রাসী বন্যার ভয় যেন কাটছেই না সাধারণ মানুষের। এর পর থেকে হাওর ও নদীতে পানি বৃদ্ধি হতে থাকলে তাদের মনে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। এবছর বন্যা আতঙ্কে হাওরের রাজধানী সুনামগঞ্জে ঈদের আনন্দের পরিবর্তে বিষাদের ছায়া।গতাকাল ১৮ জুন সোমবার জেলা শহর সুনামগঞ্জ সহ বেশ কয়েকটি উপজেলা ভারতীয় ঢলের পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এই আতঙ্ক এখন শাল্লার প্রতিটি ঘরে ঘরে।এদিকে আশঙ্কাজনক ভাবে বাড়ছে নদী ও হাওরের পানি।
উপজেলার আটগাঁও,বাহারা,হবিপুর,শাল্লা ইউনিয়ন ঘুরে দেখা যায়, হাওরে পানিতে টইটুম্বুর। নিচু এলাকার বেশকিছু ঘরবাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে। বেশ কিছু গ্রামে পানি ছুঁইছুঁই অবস্থা। সামন্য বৃষ্টি পাত ও ভারত থেকে নেমে আসা ঢলের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে উপজেলার বেশ কিছু গ্রাম প্লাবিত হবে।ইতোমধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে নীচু জায়গাতে তৈরী করা ঘর বাড়িতে পানি প্রবেশের উপক্রম হয়েছে।মানুষ তাদের ঘরে রাখা ধান,গবাদিপশু, হাঁস-মোরগ ও শিশু কিশোরদের নিয়ে বিপাকে আছেন তারা।কখন জানি বানের জলে বেসে যেত হয় সবকিছু নিয়ে। তাছাড়া ঘরের ভেতরে পানি না ঢুকলেও ঘরবাড়ির আশেপাশে প্রচুর পরিমাণে পানি থাকায় খুব আতঙ্কে দিন পার করছেন হাওর পাড়ের মানুষেরা।
মৌলভীবাজার : মৌলভীবাজারে গত কয়েক দিনের টানা ভারী বর্ষণে ভারতের ত্রিপুরা ও আসাম থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে ৬টি উপজেলায় বন্য দেখা দিয়েছে। পানিবিন্ধ রয়েছেন ৬ উপজেলার প্রায় ২ লাখ মানুষ। জেলার সবকটি নদীর পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যা কবলিত এলাকার অধিকাংশ রাস্তা তলিয়ে গেছে। আঞ্চলিক সড়কের অনেক স্থানে পানি উঠেছে। বাড়ি ঘর ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তলিয়ে গেছে। অনেকেই আবার নিজের বাড়ি-ঘর রক্ষায় সেচ্ছাশ্রমে বাঁধের উপর বালির বস্তা ফেলছেন।
মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, গতকাল বুধবার দুপুর ১২টায় মনু নদীর পানি শহরের চাঁদনীঘাট এলাকায় বিপদসীমার ২১ সেন্টিমিটার, কুশিয়ারা নদী শেরপুর পয়েন্টে বিপদসীমার ১৮ সেন্টিমিটার, ধলাই নদীর পানি বিপদসীমার ৫ সেন্টিমিটার ও জুড়ী নদীর পানি বিপদসীমার ২০২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
জেলা প্রশাসন উর্মি বিনতে সালাম জানান, বন্যায় জেলার ৬ উপজেলা মৌলভীবাজার সদর, রাজনগর, কুলাউড়া, জুড়ী, বড়লেখা ও শ্রীমঙ্গল উপজেলার ৩৭ ইউনিয়নের ৪৩২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্ধি রয়েছেন প্রায় ২ লাখ মানুষ। ৯৮টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ ৫৭১টি পরিবার আশ্রয় কেন্দ্রে উঠেছেন।
শাল্লায় বন্যা আতঙ্কে লক্ষাধিক মানুষ।
রংপুর : রংপুরে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গতকাল বুধবার বেলা ১১টায় কাউনিয়া উপজেলার তিস্তা রেলসেতু এলাকায় তিস্তার পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করে। সেখানে রাতের মধ্যে পানি আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। রংপুরের পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানায়, আগামী ২৪ থেকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মাঝারি ও ভারী বৃষ্টি হতে পারে। এ সময় তিস্তার পানি আরও বাড়তে পারে। গত মঙ্গলবার মধ্যরাতে রংপুরে ২২১ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।
রংপুর পাউবোর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আহসান হাবিব বলেন, পানি বাড়ার আশঙ্কায় তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে দেওয়া হয়েছে।
জেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানরা জানান, তিস্তার নদীর পানি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় জেলার গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলার নদী–তীরবর্তী এলাকায় বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় নদীপাড়ের বাসিন্দারা সতর্কাবস্থায় আছেন।
গঙ্গাচড়ার লক্ষ্মীটারী ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল্লাহেল হাদী বলেন, তিন দিন ধরে নদীর পানি বাড়ছে। আকাশের পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, নদীর পানি আরও বাড়বে।
তিস্তা নদী–তীরবর্তী কোলকোন্দ, নোহালী ও আলমবিদিতর ইউনিয়নের বাসিন্দারা বন্যার ঝুঁকির মধ্যে আছেন বলে জানান সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানরা।
পাউবোর ডালিয়া ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আসফাউদদ্দৌলা বলেন, তিস্তা নদীর পানি কয়েক দিনের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। বধুবার সকাল ছয়টায় পানি বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। সন্ধ্যার পর পানি কিছুটা বাড়তে পারে, তবে বিপৎসীমা অতিক্রম করার আশঙ্কা কম।
নীলফামারী : নীলফামারীর তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পানি কমতে থাকে। তবে বৃষ্টি না থামায় নদীর পানি যেকোনো সময় বিপৎসীমা অতিক্রম করে লোকালয় প্লাবিত করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন নদী–তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দারা। জেলা পাউবোর ডালিয়া ডিভিশনের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সূত্র জানায়, লালমনিরহাট জেলার দোয়ানীতে অবস্থিত তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে আজ সকাল ৬টায় তিস্তার পানি প্রবাহিত হয় ৫১ দশমিক ৯৫ মিটার। গতকাল সকাল ৯টায় ৩ সেন্টিমিটার কমে ৫১ দশমিক ৯২ মিটার এবং দুপুর ১২টায় আরও ৪ সেন্টিমিটার কমে ৫১ দশমিক ৮৮ মিটার দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ওই পয়েন্টে তিস্তা নদীর বিপৎসীমা ৫২ দশমিক ১৫ মিটার। সন্ধ্যা ছয়টার পর পানি কিছুটা বাড়ার আশঙ্কা আছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. রবিউল ইসলাম বলেন, ‘পানি বৃদ্ধি পেলেও চরাঞ্চলের বাড়িঘরে এখনো পানি ওঠেনি। তবে যেকোনো সময়ের মধ্যে পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।’
নীলফামারী জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। গতকাল সকালে লালমনিরহাট জেলার দোয়ানীতে অবস্থিত তিস্তা ব্যারাজ পয়েণ্টে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ২০ সেণ্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামে প্রধান নদ-নদীগুলোর মধ্যে তিস্তা নদী ও দুধকুমার নদের পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গতকাল সকাল ৯টায় পাটেশ্বরী পয়েন্টে দুধকুমার নদের পানি বিপৎসীমার ৫ সেন্টিমিটার এবং কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এ ছাড়া অন্য নদ-নদীর পানি বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। দুধকুমার নদের পানি বেড়ে নাগেশ্বরী উপজেলার চর লুচনী ও টেপারকুঠি এলাকায় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
দুধকুমার নদের পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করায় তীব্র স্রোতের তোড়ে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ঘোগাদহ ইউনিয়নের চরে ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। এক সপ্তাহের ভাঙনে কয়েকটি পরিবার ভিটেমাটি হারিয়ে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাঠে ঠাঁই নিয়েছে। ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে রসুলপুর মাদরাসা ও বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের দুটি সোলার পাম্পসহ দুই শতাধিক পরিবার।
কুড়িগ্রাম বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সহকারী প্রকৌশলী আলমগীর হোসেন বলেন, গত বছর বরেন্দ্রের সেচ প্রকল্পের সোলার পাম্প দুটি দুধকুমার নদের ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছিল। তারা পাউবোর সেচপাম্প দুটি রক্ষার জন্য চিঠি দিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ বছরও সেচপাম্প দুটি ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছে।
নাগেশ্বরী উপজেলার বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের ৪ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এ উপজেলার চর লুচনী, আনন্দবাজার, টেপারকুঠি, বিষ্ণুপুর গ্রাম, আনন্দবাজার, বন্ধুবাজার ও কালীগঞ্জ ইউনিয়নের ঢেপঢেপি, কৃষ্ণপুর, নামাপাড়া, নুনখাওয়া ইউনিয়নের কাঠগিরিরচর ও ফকিরপাড়া গ্রাম প্লাবিত হওয়ায় স্থানীয় লোকজন ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন। তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে থাকায় রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙ্গা বুড়িরহাট স্পার বাঁধ ভাঙনের ঝুঁকির মুখে।
গাইবান্ধা : গাইবান্ধার সব নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে জেলার চারটি নদ-নদী ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট, তিস্তা ও করতোয়ার পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় তিস্তার পানি বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্য তিনটি নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
গাইবান্ধা পাউবোর নিয়ন্ত্রণকক্ষের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ফুলছড়ি উপজেলার তিস্তামুখঘাট পয়েন্টে ৪৮ সেন্টিমিটার, ঘাঘট নদের পানি জেলা শহরের নতুন ব্রিজ পয়েন্টে ৫০ সেন্টিমিটার, করতোয়ার পানি গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার চকরহিমাপুর পয়েন্টে ৬ সেন্টিমিটার এবং তিস্তার পানি সুন্দরগঞ্জ উপজেলাসংলগ্ন কাউনিয়া পয়েন্টে ৩৯ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। মঙ্গলবার দুপুর ১২টা থেকে গতকাল বুধবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত এই পরিমাণ পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে গত ২৪ ঘণ্টায় তিস্তার পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। এ নদীর পানি বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
অন্যদিকে নদীর পানি বৃদ্ধির কারণে গাইবান্ধা সদর উপজেলার কামারজানি, ঘাগোয়া, ফুলছড়ি উপজেলার এরান্ডাবাড়ি, ফজলুপুর, কঞ্চিপাড়া ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলার তারাপুর, হরিপুর ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকতে শুরু করেছে।
জানতে চাইলে গাইবান্ধা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী হাফিজুল হক বলেন, পানি বৃদ্ধির কারণে নদী–তীরবর্তী চরাঞ্চলে পানি ঢুকতে শুরু করেছে। তবে আপাতত বড় বন্যার আশঙ্কা নেই।ইনকিলাব