ডেস্ক রির্পোট:- বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দেশে ফেরানো প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া বক্তব্য রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। হঠাৎ করেই সরকারপ্রধানের এমন কঠোর অবস্থান নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা চলছে।
প্রায় ১৬ বছর সপরিবারে যুক্তরাজ্যে বাস করছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠপুত্র ওয়ান-ইলেভেন সরকারের আমলে ২০০৮ সালে দেশ ছাড়েন। বিএনপির পক্ষ থেকে বরাবরই বলা হয়েছে, চিকিৎসার জন্য বিদেশে অবস্থান করছেন তারেক রহমান। যদিও ২০১২ সালে তিনি ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেন। এক বছরের মধ্যেই তার এই আবেদন মঞ্জুর করে দেশটির সরকার। বিএনপিও বিষয়টি স্বীকার করেছে। এরই মধ্যে দেশে একাধিক মামলায় সাজা হয়েছে তারেকের। তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে সাজা কার্যকরের চেষ্টা চলছে বলেও বিভিন্ন সময় জানিয়েছে সরকার।
সর্বশেষ গত রোববার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে এনে শাস্তি কার্যকর করা তার সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার। গণভবনে কোটালীপাড়া উপজেলার নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি বলেন, ‘এখন একটাই কাজ, ওই কুলাঙ্গারটাকে (তারেক রহমান) নিয়ে আসা। দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা ও গ্রেনেড হামলা মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি, দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন; সেজন্য আমরা নিয়ে আসব। ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের কাছে আমরা সেই আবেদন করব যে, ওখান থেকে যেন সাজাপ্রাপ্ত আসামি তারেক রহমানকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়। তাকে নিয়ে এসে এ দেশে তার সাজাটা বাস্তবায়ন করতে হবে। সে ব্যবস্থা আমরা সরকারের পক্ষ থেকে নেব।’
প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পর তারেক রহমানকে দেশে ফেরানোর বিষয়টি নতুনভাবে আলোচনায় এসেছে। অনেকেই মনে করেন, সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা বা চিন্তা না থাকলে সরকারপ্রধান হঠাৎ করে এমন বক্তব্য দিতেন না। যদিও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিংবা অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তরে যোগাযোগ করে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, তারেক রহমানের বিষয়ে তারা নতুন কোনো নির্দেশনা পাননি।
যোগাযোগ করা হলে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘আইন-কানুন ভালোভাবে জেনে ব্রিটিশ সরকারের কাছে অনুরোধ করা হবে যে, তারেক রহমান বাংলাদেশের সাজাপ্রাপ্ত ও দণ্ডিত ব্যক্তি, তাকে দণ্ড ভোগ বা আদালতের আদেশ মানার জন্য বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হোক।’
তবে এই প্রক্রিয়া কবে শুরু হবে—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হোম মিনিস্ট্রি (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) বলতে পারবে।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পশ্চিম ইউরোপ ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) অনুবিভাগের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা এই ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কিছু জানি না। বলার মতো কোনো তথ্য এই মুহূর্তে নেই।’
অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। তবে দলটির একাধিক নেতা এ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাদের অভিযোগ, তারেক রহমানকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘বিরোধীদলীয় নেতাদের গ্রেপ্তার করে এবং শাস্তি দিয়ে কিংবা মামলা দিয়ে ঠেকানো যায় না। এটি বহুবার প্রমাণিত হয়েছে। তারেক রহমান গণতন্ত্র ফেরানোর আন্দোলন সফল করেই ‘বীরের বেশে’ দেশে আসবেন।’
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘তারেক রহমানের নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক দক্ষতা সারা দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এতে ভয় পেয়েই সরকার বিচলিত। তারা একের পর এক অপকৌশলের মাধ্যমে তারেক রহমানের নেতৃত্বকে বিতর্কিত করতে চাইছে। কিন্তু এসবে কোনো কাজ হবে না।’
বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের দাবি, তাকে দেশে ফেরত আনার আইনি কোনো পন্থা সরকারের কাছে নেই। তারেক রহমানের অন্যতম আইনজীবী ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদিন বলেন, ‘তারেক রহমানকে দেশে ফেরানোর কথা তো সরকার অনেকদিন ধরেই বলছে। কিন্তু তাকে আনার কোনো বিধান আইনে নেই। এরপরও তারা কীসের ভিত্তিতে বলছে, তা বুঝতে পারছি না। এর আগে আইনমন্ত্রীও বলেছেন যে, আমরা খুব সহসাই তাকে দেশে এনে সাজা কার্যকর করব। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই তিন টার্মের মধ্যে কোনো কিছুই দেখলাম না।’
তিনি বলেন, ‘কাউকে বিদেশ থেকে আনতে হলে সেই দেশের সঙ্গে চুক্তি থাকতে হয়। সেটা আছে কি না, তা উনারাই ভালো বলতে পারবেন। তবে আমি মনে করি, তারেক রহমানকে কোনোভাবেই আনা সম্ভব নয়। তিনি স্বেচ্ছায় যদি দেশে না আসেন, তাহলে ব্রিটিশ সরকার কীভাবে পাঠাবে? সে বিষয়ে আইন-কানুন আছে বলে তো আমার মনে হয় না। আর যদি ব্রিটিশ সরকারের আইনে থাকে, তাহলে পাঠাতে পারে।’
তারেক রহমান চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন বলেও অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদিন উল্লেখ করেন।
যদিও ২০১৮ সালের ২৪ এপ্রিল নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছিলেন, তারেক রহমান ব্রিটেনে ‘রাজনৈতিক আশ্রয়ে’ আছেন। সে সময় তিনি বলেছিলেন, ‘২০১২ সালে তারেক রহমান ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছিলেন এবং এক বছরের মধ্যেই সেটি গৃহীত হয়েছে। তিনি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বর্জন করেননি। রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র বিভাগে স্বাভাবিক অংশ হিসেবেই তিনি তার পাসপোর্ট জমা দিয়েছেন। বর্তমানে বাংলাদেশে তারেক রহমানের জীবন নিরাপদ নয়। তাই বিশ্বের অসংখ্য বরেণ্য রাজনীতিবিদ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মতোই সাময়িকভাবে বিদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন এবং সংগত কারণেই তা পেয়েছেন।’
অন্যদিকে তারেক রহমানকে দেশে ফেরানোর আইনি পথ তৈরির বিষয়টি বিভিন্ন সময় আলোচিত হয়েছে। ২০২৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ঢাকায় বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের মধ্যকার পঞ্চম কৌশলগত সংলাপ শেষে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেছিলেন, ‘তারেক রহমান রাজনৈতিক আশ্রয়ে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। তারেকসহ সে দেশে পলাতক আসামিদের ফেরাতে বন্দিবিনিময় চুক্তির বিষয়ে কথা হয়েছে। এ বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষরের প্রক্রিয়া চলমান।’
এদিকে তারেক রহমানকে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর রাজনৈতিক অঙ্গনেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে। বিশেষ করে ব্রিটেনের রাজনীতিতে যখন পটপরিবর্তনের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সে সময় প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে অনেকেই অর্থপূর্ণ বলে মনে করছেন। কারণ, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক এরই মধ্যে সে দেশের বর্তমান পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে আগামী ৪ জুলাই নতুন সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন। দেশটিতে টানা ক্ষমতায় থাকা কনজারভেটিভ পার্টি বর্তমানে চরম সংকটের মধ্যে রয়েছে। তাদের জনপ্রিয়তাও তলানিতে। ফলে আসন্ন নির্বাচনে বর্তমান বিরোধী দল লেবার পার্টি বিজয়ী হয়ে দীর্ঘদিন পর সরকার গঠন করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আর ঐতিহাসিকভাবেই লেবার পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক গভীর। তা ছাড়া বঙ্গবন্ধুর নাতনি এবং প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোন শেখ রেহানার কন্যা টিউলিপ সিদ্দিকী লেবার পার্টির এমপি। আগামী নির্বাচনেও তার জয়ের সম্ভাবনা বেশি। সেক্ষেত্রে লেবার পার্টি সরকার গঠন করলে টিউলিপ সিদ্দিকীর মন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। কারণ লেবার পার্টির ছায়া মন্ত্রিসভায় তিনি রয়েছেন। সব মিলিয়ে লেবার পার্টি ব্রিটেনে সরকার গঠন করলে তারেককে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ সহজ হবে বলেই অনেকে মনে করছেন।
তথ্যমতে, এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ২০০৭ সালের ৭ মার্চ তারেক রহমানকে আটক করা হয়। সে সময় তাকে ১৩টি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তাকে রিমান্ডেও নেওয়া হয়। ১৮ মাস পর ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তিনি জেল থেকে বের হন। আট দিন পর ১১ সেপ্টেম্বর তিনি দেশ ছেড়ে যুক্তরাজ্যে চলে যান। সেই থেকে তারেক রহমান সপরিবারে লন্ডনে অবস্থান করছেন। সেখানে থেকেই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, লন্ডনে থাকা তারেক রহমানের বিরুদ্ধে হত্যা, দুর্নীতি ও মানহানির অভিযোগে ৭৫টি মামলা রয়েছে। এরই মধ্যে ছয়টি মামলায় তার সাজা হয়েছে। এর মধ্যে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একই ঘটনায় বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায় তাকে ২০ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সিঙ্গাপুরে অর্থ পাচারের একটি মামলার আপিলে তারেক রহমানকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি ২০ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় তারেকের দণ্ড হয় ১০ বছর। অবৈধ সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে দুদকের মামলায় তারেক রহমানকে ৯ বছর কারাদণ্ড দেন ঢাকার সিনিয়র বিশেষ জজ আদালত। এ ছাড়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কটূক্তি করায় নড়াইলের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত তারেককে দুই বছরের কারাদণ্ড দেন।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী খুরশিদ আলম খান বলেন, ‘বিভিন্ন মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে আদালত তারেক রহমানকে সাজা দিয়েছেন। নিয়ম অনুযায়ী ডিসির মাধ্যমে সরকারের কাছে রায় পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। বাকিটা সরকারের কাজ। তবে যেহেতু যুক্তরাজ্যের সঙ্গে আমাদের এক্সট্রাডিশন ট্রিটি (প্রত্যর্পণ চুক্তি) নেই, সেহেতু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জোরালো ভূমিকা নিলে একটা ফল পাওয়া যেতে পারে। শুধু কাগজে রায় পেয়ে লাভ কী, যদি না সেটি এক্সিকিউট করতে পারি? এখানে সরকারের আরও আগেই জোরালো ভূমিকা রাখা দরকার ছিল। এখন সরকার বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কত দ্রুত ব্রিটিশ সরকারের মনোযোগ আকৃষ্ট করতে পারছে—সেটার ওপর নির্ভর করবে।কালবেলা