কক্সবাজার:- বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে কক্সবাজারে সাগর উত্তাল হয়ে উঠেছে। সকালে সাগরে জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে পাচঁ ছয় ফুট বৃদ্ধি পেয়েছে।
রবিবার (২৬ মে) দুপুরে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় কক্সবাজারের বেশ কিছু নিম্নাঞ্চল পানি প্লাবিত হয়েছে। বিশেষ করে কক্সবাজার সদরের কুতুবদিয়া পাড়া, সমিতি পাড়া, গোমাতলী, পোকখালী, ইসলামপুর, মহেশখালী-কুতুবদিয়াসহ জেলার ২০টি গ্রামে সাগরের জোয়ারের পানি ঢুকেছে। সন্ধ্যায় উপকূল এলাকায় ৬ থেকে ৭ ফুট পানি বৃদ্ধি পেয়ে জলোচ্ছ্বাসের কথা বলেছে আবহাওয়া অফিস।
অন্যদিকে, সেন্টমার্টিন দ্বীপে বাতাসের গতিবেগ বেড়েছে। দ্বীপের বাসিন্দাদের নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নিতে বলা হয়েছে।
রেমালের প্রভাবে সেন্টমার্টিন বঙ্গোপসাগরে পানি বেড়েছে। শনিবার রাতে কয়েকটি গ্রামে পানি ঢুকেছে। দ্বীপের বাসিন্দাদের আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য মাইকিং করা হয়েছে।
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, জোয়ারের সঙ্গে বঙ্গোপসাগরে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। এখনো ধমকা হাওয়া সাগরের পানির উচ্চতা বেশি মনে হচ্ছে। দ্বীপের লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে যেতে মাইকিং করা হয়।
সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে আসা পর্যটকদের নিরাপদে থাকতে বলা হয়েছে। সৈকতে জেলা প্রশাসনের নিয়োজিত বিচকর্মী, ফায়ার সার্ভিস ও লাইফগার্ড কর্মীরা পর্যটকদের সতর্কতার বিষয়ে মাইকিং করছে। তারমধ্যেও অনেকেই সাগরে নামার চেষ্টা করছেন।
সাগর জলে মেয়ে লুবনাকে নিয়ে নেমে পড়েছেন শরীয়তপুরের বাসিন্দা ইয়াছমিন আকতার। তিনি বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় রেমাল দেখতে সদ্য এসএসসি পাস করা মেয়েকে নিয়ে কক্সবাজার এসেছি। সাগর উত্তাল, দেখতে অনেক ভালো লাগছে। ছবি তুলছি, শামুক-ঝিনুক কুড়িয়েছি। আগে কক্সবাজার অনেক আসা হয়েছে। তবে এবার ঘূর্ণিঝড়ের সময় আসা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের সময় কক্সবাজার সাগর কেমন হয় তা দেখতে পেলাম।
শুধু ইয়াছমিন নন, একই সময় সৈকতের লাবণী পয়েন্টে এসেছেন নোয়াখালীর আব্দুর রহিম। তার পরিবারের সদস্য সংখ্যা ১৪ জন। সবাই নেমে পড়েন সাগরের নোনাজলে।
আব্দুর রহিম বলেন, ‘ঢেউ দেখে ভয় লাগছে। কিন্তু খুবই মজা পাচ্ছি। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে এতো বড় বড় ঢেউ হতে পারে আগে জানতাম না। শুধু এসব পর্যটক নয়, সৈকতের প্রতিটি পয়েন্টে ভিড় করেছে কয়েক হাজার পর্যটক। তবে সকাল সাড়ে ৮ টার পর কাউকে নোনাজলে নামতে দিচ্ছে না লাইফ গার্ড কর্মীরা।
সি-সেফ লাইফ গার্ড সংস্থার কর্মী জয়নাল আবেদীন বলেন, ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে কক্সবাজারে ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেত (সবশেষ তথ্য) দেখানো হয়েছে। তাই সাগর উত্তাল রয়েছে। সৈকতের প্রতিটি পয়েন্টে টাঙানো হয়েছে লাল পতাকা। লাল পতাকা মানেই সতর্ক করা, যাতে কেউ সমুদ্রস্নানে না নামে। আমরা কাউকে সৈকতে সমুদ্রস্নানে নামতে দিচ্ছি না।
অন্যদিকে কক্সবাজার বিমানবন্দরে সকাল থেকে সব ধরনের বিমান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া কক্সবাজার টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ রোডের বেশ কয়েকটি পয়েন্টে গাছ ভেঙে পড়ায় এই সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, জেলায় ৬ হাজার ৩৩২ জন মানুষ ৬৩৮টি কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। রবিবার বিকাল ৬টায় বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান। তিনি বলেন, আশ্রয় নেয়া মানুষের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশাপাশি মেডিকেল টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। তবে অধিকাংশ মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে আসতে অনীহা জানাচ্ছে। এখনো অনেকেই অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে।
তিনি আরো বলেন, জেলার কুতুবদিয়া, মহেশখালী, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দরসহ উপকূল ও নিম্নাঞ্চলের ঝুকিপূর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য স্বেচ্ছাসেবকরা মাইকিং করছে। ঘূর্ণিঝড় রেমালের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় কক্সবাজারে ব্যপক প্রস্তুতি নিয়েছে জেলা প্রশাসন।
বিকাল ৫ টার দিকে কক্সবাজার পৌরসভার পৌর প্রিপ্যার্যাটরি উচ্চ বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, ১নং ওয়ার্ডের সমিতি পাড়া, কুতুবদিয়া পাড়া, নাজিরারটেক ও ফদনার ডেইল এলাকার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটে আসছে। তাঁদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যা বেশি। অনেকেই গবাদিপশুও নিয়ে এসেছেন। অনেকেই অভিযোগ করেছেন, বেলা ১২ টা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত কারও কপালে খাবার জুটেনি।
তবে কক্সবাজার পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত মেয়র সালাউদ্দিন সেতু বলেন, কক্সবাজার পৌরসভা ২৩টি আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছে। সেখানে ৬ হাজার মানুষের জন্য রাতের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এদিকে, মহেশখালী পৌরসভার ৮নং ওয়ার্ডে সিকদার পাড়া এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করতে শুরু করে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন বন্যা কবলিত এলাকার মানুষ। এ ছাড়া বন্যা নিয়ন্ত্রণকারী মূল বাঁধের বেশ কিছু এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ায় আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন পাড়ের মানুষ। এ অবস্থায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ টিকিয়ে রাখতে ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে একটানা মেরামতের কাজ করছেন শ্রমিকরা।
মহেশখালী পৌরসভার মেয়র মকসুদ মিয়া জানান, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে ভোর থেকে মহেশখালীতে দমকা হাওয়ার পাশাপাশি গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। নদীতে স্বাভাবিকের চেয়ে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে মহেশখালী বেড়িবাঁধ ভেঙে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন অনেক মানুষ। তাদের সহায়তায় আমাদের পৌরসভার লোক কাজ করছে।
মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মীকি চাকমা বলেন, বেড়িবাঁধের অনেক পয়েন্টে ভেঙে গেছে। পানি প্রবেশ করায় মেরামত করা যাচ্ছে না। জোয়ারের পানি কমলে তা মেরামত করা হবে।
কক্সবাজার আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মো. আব্দুল হান্নান বলেন, ‘এরইমধ্য ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। জোয়ারের পানি ৮ থেকে ১২ ফুট উচ্চতায় প্রবাহিত হয়ে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে।’