ডেস্ক রির্পোট:- কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে অস্থিতিশীল করে তুলছে সশস্ত্র সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি-আরসাসহ ছোট-বড় বহু সন্ত্রাসী গ্রুপ। প্রতিটি ক্যাম্পে রয়েছে এসব গ্রুপের সদস্যদের তৎপরতা। নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে প্রায়ই তারা জড়িয়ে পড়ছে সংঘাতে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পসংলগ্ন পাহাড়ে অস্ত্রধারী এসব সন্ত্রাসী গড়ে তুলেছে গোপন আস্তানা। এসব আস্তানায় মজুত রাখা হয় অস্ত্র ও মাদক। অপহরণের পর ভুক্তভোগীদেরও জিম্মি করা হয় সেখানে।
জানা গেছে, খুন-অপহরণ, মাদক ব্যবসা, অস্ত্র ব্যবসা, ডাকাতি ও লুটপাটসহ অন্তত এক ডজন অপরাধে এসব সন্ত্রাসী জড়িত। এদের অপতৎপরতায় ৩২টি রোহিঙ্গা ক্যাম্প উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। গত দেড় বছরে সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হয়েছেন অন্তত ৮০ জন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত সরকারি সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করায় টার্গেটে পড়ছেন ক্যাম্প ব্যবস্থাপনা কমিটির নেতা, মাঝি ও পাহারারত স্বেচ্ছাসেবকরাও। নিজ নিজ দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকায় শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত মাঝিরা অনৈতিক কার্যকলাপ এবং অনিয়মকে নিরুৎসাহিত করেন। এ কারণে তারা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর টার্গেটে পড়েন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে আরসা, আল ইয়াকিন, আরএসও, ইসলামি মাহাতসহ বেশ কয়েকটি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। এছাড়া রয়েছে ছোট ছোট অনেক সন্ত্রাসী গ্রুপ। অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায় তাদের প্রথম ধাপ। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর পেছনের পাহাড়ে এসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর গোপন আস্তানায় অপহৃত ব্যক্তিকে নিয়ে জিম্মি করে স্বজনদের কাছ থেকে আদায় করা হয় মুক্তিপণ। এছাড়া এসব আস্তানায় পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে সংগ্রহ করা অস্ত্র ও গোলাবারুদ এবং মাদকের চালান মজুত রাখা হয়। গোপন আস্তানাগুলোতে গড়ে তোলা হয়েছে দেশীয় অস্ত্রের কারখানাও। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান শুরু হলে সন্ত্রাসীরা এসব আস্তানায় গা-ঢাকা দেয়।
টেকনাফ-উখিয়ার স্থানীয় বাসিন্দা ও বিশ্লেষকরা বলছেন, সন্ধ্যা হলেই এসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর ভয়ে পুরো এলাকায় ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের ভয়ে স্থানীয়রাও আতঙ্কে থাকেন। এসব অপরাধের সঙ্গে কিছু স্থানীয় দালালের সম্পৃক্ততার সন্ধান মিলেছে। এসব দালালের মাধ্যমে রোহিঙ্গারা অবাধে ক্যাম্প থেকে বের হচ্ছে। ঢুকছে। কেউ কেউ আবার টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে দিচ্ছে। র্যাব জানিয়েছে, বিভিন্ন অপরাধে জড়িত ১১০ জন সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করেছে তারা। তাছাড়া আরসাসহ অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের ধরতে র্যাবের গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। তথ্য পেলেই চালানো হচ্ছে অভিযান।
সূত্র জানায়, সংগঠনটির নেতা মাস্টার মহিবুল্লাহ খুনের পর স্থানীয়দের তৎপরতা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোরতায় কোণঠাসা হয়ে পড়ে আরসা। তাদের কিছু সদস্য দলছুট হয়ে যোগ দেয় বিভিন্ন গ্রুপে। এসব গ্রুপের হয়ে তারা বিভিন্ন ক্যাম্পে অপকর্ম চালিয়ে আসছে। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ২০২৩ সালে খুন হয়েছেন ৬৪ জন। আর চলতি বছরের ১৭ মে পর্যন্ত খুন হয়েছেন ১৬ জন।
র্যাব সূত্র জানায়, কক্সবাজারের উখিয়ায় প্রতিপক্ষের গুলিতে গত সোমবার ভোরে নিহত হয়েছেন উখিয়ার ৪-এক্সটেনশন নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের হেডমাঝি মোহাম্মদ ইলিয়াছ (৪৩)। রোববার রাতে ইলিয়াছ নিজ ঘরে ঘুমিয়েছিলেন। পরদিন ভোরে ১০-১৫ জন মুখোশধারী ঘরের দরজা ভেঙে তাকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর পার্শ্ববর্তী হ্যান্ডিক্যাম্প অফিসের পেছনে নিয়ে তাকে গুলি করে হত্যা করে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তারের জেরে সন্ত্রাসী সংগঠন আরসার সদস্যরা এ খুনের ঘটনা ঘটিয়েছে-এমন তথ্যের ভিত্তিতেই বুধবার লাল পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ আরসার প্রধান সমন্বয়ক ও কমান্ডার শাহনুর ওরফে মাস্টার সলিম ও তার সহযোগী মো. রিয়াজকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় ৫টি গ্রেনেড, ৩টি রাইফেল গ্রেনেড, ১০টি দেশে তৈরি হ্যান্ডগ্রেনেড, ১৩টি ককটেল, ১টি বিদেশি রিভলবার, ৯ রাউন্ড নাইন এমএম পিস্তলের গুলি, ১টি এলজি ও তিনটি ১২ বোরের কার্তুজ উদ্ধার করছে। শাহনুর ওরফে মাস্টার সলিম উখিয়া ১৫ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা আর রিয়াজ উখিয়ার বালুখালি ৮/ডব্লিউ ক্যাম্পের এ/২৩ ব্লকের বাসিন্দা। গ্রেফতার শাহনুর ওরফে মাস্টার সলিম ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করে রোহিঙ্গা ক্যাম্প-১৫তে বসবাস শুরু করে। সে মিয়ানমারে থাকা অবস্থায় আরসার জোন কমান্ডার ছিল। এছাড়া আরসাপ্রধান আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনিয়র দেহরক্ষী হিসাবে দুই মাস দায়িত্ব পালন করেছে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসাবে ২০১৭ সালে আরসার পর মৌলভী আকিজের মাধ্যমে আরসায় পুনরায় যোগদান করে সে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসার হয়ে আধিপত্য বিস্তার, কোন্দল, খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। অস্ত্র চালানোসহ বিভিন্ন বিস্ফোরণের ওপরও পারদর্শী। সে আরসার ক্যাম্প-১৫ এর কমান্ডার হিসাবে নিয়োগ পেয়েছিল। পরে বাংলাদেশে আরসার নেতৃত্ব শূন্য হয়ে পড়ায় সে বাংলাদেশে আরসার প্রধান সমন্বয়ক হিসাবে দায়িত্ব নেয়। মিয়ানমারের সৃষ্ট সংঘর্ষের ফলে লুটকৃত অস্ত্র-গোলাবারুদ বিভিন্ন মাধ্যম থেকে সংগ্রহ করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ত্রাস সৃষ্টি করে। ফলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পুনরায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে মারামারি, সংঘর্ষ ও হত্যার ঘটনা ঘটেছে। তার বিরুদ্ধে তিনটি হত্যা মামলাসহ অন্যান্য অপরাধে একাধিক মামলা রয়েছে। গ্রেফতার রিয়াজ মাস্টার সলিমের সহযোগী হয়ে কাজ করত।
গোয়েন্দা তথ্যমতে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মুখে সন্ত্রাসী সংগঠন আরসা কিছুটা নিষ্ক্রিয় ও নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়লেও নতুন করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। র্যাবের লিগ্যাল মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক আরাফাত ইসলাম জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অপতৎপরতা নিয়ন্ত্রণ করতে স্থানীয় থানাসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে র্যাবের নিবিড় যোগাযোগ রেখে কাজ চলছে। অব্যাহত আছে গোয়েন্দা তৎপরতা। তথ্য পেলেই চালানো হচ্ছে অভিযান। অব্যাহত নজরদারি ও তৎপরতায় আরসা নেতৃত্বশূন্য হলেও বর্তমানে পাশের দেশের অন্তর্ঘাতমূলক ঘটনায় বাংলাদেশে অস্ত্র ও বিস্ফোরক নিয়ে আসছে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী।যুগান্তর