ডেস্ক রির্পোট:- মিজানুর রহমান: রাজনৈতিক অনেক প্রশ্নের জবাব মিলেছে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডনাল্ড লু’র পূর্ব নির্ধারিত ঢাকা সফরে। এমনটাই মনে করছেন পেশাদার কূটনীতিক, বিশ্লেষক তথা রাজনীতি সচেতনরা। বহুল আলোচিত ৭ই জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে রাজনীতিতে অন্তহীন আলোচনা। যুক্তরাষ্ট্র বছর জুড়ে সক্রিয় থাকলেও শেষ সময়ে এসে কেন নীরব থাকলো? নির্বাচনে ভারতের ভূমিকা নিয়ে কূটনীতিক পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীর দাবি সেই প্রশ্নকে আরও জোরালো করেছে। সবমিলে ডনাল্ড লু বা যুক্তরাষ্ট্রের ওই পর্যায়ের দায়িত্বশীল কারও কাছ থেকে কিছু শোনার অপেক্ষায় ছিলেন নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নয় এমন মানুষজন। বিশ্লেষকরা বলছেন, ডনাল্ড লু কার্যত তা-ই করে গেছেন। তার এবারের সফরটি ছিল পিপল সেন্ট্রিক। তিনি দুইদিনে বুড়িগঙ্গার পাড় থেকে তুরাগের পাড় অবদি রীতিমতো চষে বেড়িয়েছেন। সরকারি লোকজন তো বটেই, বিভিন্ন বয়সী, শ্রেণি-পেশার মানুষের মাঝেই ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বড়ত্ব প্রচার নয় বরং তিনি বন্ধুত্বের বার্তা প্রচার করে গেছেন।
নির্বাচন এবং নতুন সরকার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র খানিকটা নমনীয় মর্মে অনেকে বাইরে থেকে সমালোচনা করলেও পেশাদাররা বলছেন এটাই যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বব্যাপী তাদের কূটনীতি এমনই। তারা সব হজম করে, অতীতের তিক্ততাকে পাশ কাটিয়ে সামনে তাকানোর কৌশল জানে। যা ডনাল্ড লু ১৪ই মে থেকে ১৬ই মে বাংলাদেশে করে গেছেন। তাকে একটি বারের জন্য বিচলিত বা অপ্রস্তুত হতে হয়নি। যদিও ঢাকায় তার সফরকালেই রাজনৈতিক নেতৃত্বের তরফে নানা রকম কথাবার্তা বলা হচ্ছিল। সফরকালে তিনি প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ও সিনিয়র সচিব মাসুদ বিন মোমেন এবং পরিবেশমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেছেন। সব বৈঠকেই লু ছিলেন প্রাঞ্জল এবং খোলামেলা। বিশেষ করে তিনি প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার বাসার নৈশভোজে অনেকটা ডিফেন্সিভ মুডে আগ বাড়িয়ে সম্পর্কে আস্থা-বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার বার্তা দেন। যা আড়াই ঘণ্টার ওই আয়োজনে পজিটিভ ভাইভ নিয়ে আসে। তিনি মতবিনিময় করেছেন নাগরিক সমাজ, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব এবং অধিকার কর্মীদের সঙ্গে। সেখানে নিজে থেকে বলেছেন কম, শুনেছেন বেশি। তরুণ সমাজের সঙ্গে বসেও তাদের ভাবনাগুলো শুনেছেন। এত ব্যস্ততার মধ্যে পুরো একটি সন্ধ্যা কাটিয়েছেন সোশ্যাল মিডিয়া এক্সপার্ট তরুণ তুর্কিদের সঙ্গে। তাদের সঙ্গে দই-ফুচকার স্বাদ নিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের নারী ক্রিকেট দলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। জার্সি গায়ে মাঠে নেমে বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য শুভ কামনা জানিয়েছেন।
ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার আগে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন। বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান অপরিবর্তিত থাকবে বলে সাফ জানিয়েছেন। ভারতের মধ্যস্থতা বা তাদের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে ৭ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অবস্থান নরম করেছে মর্মে যে অভিযোগ উত্থাপন করা হয় তা একটি শব্দে ‘হাস্যকর’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়া দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত মার্কিন সহকারী মন্ত্রী ডনাল্ড লু। সেইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে ভারতের চোখে দেখে বলে এ অঞ্চলে যে ধারণা বিদ্যমান সেটাও খণ্ডন করেন। লু বলেন, বাংলাদেশে নিজ স্বার্থ নিজস্ব বিবেচনা বা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে যুক্তরাষ্ট্র। ভারত, চীন কিংবা রাশিয়ার লেন্স দিয়ে নয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশি বন্ধুদের সঙ্গে আমরা সরাসরি আলোচনা করি। তবে এটা সত্য যে, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে আলোচনা হয় এ অঞ্চলের পরিস্থিতি নিয়ে। সেই আলোচনায় শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ- কখনো কখনো বাংলাদেশ প্রসঙ্গও থাকে। প্রথম আলো এবং ইনডিপেনডেন্ট টিভিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের জ্যেষ্ঠ এই কর্মকর্তা র্যাব’র ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি, গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর নৃশংসতার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলমান ছাত্র বিক্ষোভ, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ভবিষ্যৎ, এই অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবসহ নানা বিষয়ে কথা বলেন।
সাক্ষাৎকারে তিনি মোটাদাগে কিছু বিষয় খোলাসা করেন। জানান, ৭ই জানুয়ারির নির্বাচনকে ঘিরে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে যে মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে, তা পাশে সরিয়ে ওয়াশিংটন সামনে এগিয়ে যেতে চায়। এক প্রশ্নের জবাবে লু বলেন, নির্বাচনে সহিংসতা ও ভোটারদের ওপর বলপ্রয়োগ করায় আমরা পুলিশ, সরকারি ও বিরোধী দলের নেতাদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলাম। আমরা আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে অর্থপূর্ণ সংলাপে বসতে বলেছিলাম। আমরা সভা-সমাবেশ ও বাকস্বাধীনতার পক্ষে সোচ্চার ছিলাম। এটা খুবই স্বাভাবিক। সব অঞ্চলেই আমরা এমন করি। বাংলাদেশে এসব মূল্যবোধ বজায় রাখতে আমরা কাজ করে যাবো।
তিনি বলেন, আমাদের সম্পর্কের মাঝে অনেক জটিল বিষয় রয়েছে। গত বছর নির্বাচন নিয়ে যে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা ছিল, তা তো এখন আর গোপন নয়। র্যাব’র নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আমরা কাজ করছি। আমরা সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছি। ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়ন নিয়েও কথা বলছি। শ্রম অধিকারের মতো জটিল বিষয়ে আমরা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বলেছি, জটিল বিষয়ের পাশাপাশি আমরা সহযোগিতার নতুন নতুন ক্ষেত্র খুঁজবো। ইতিবাচক এজেন্ডা নিয়ে কাজ করবো। আমার বিশ্বাস, আমরা যদি ইতিবাচক বিষয় নিয়ে কাজ করি যেমন- যুক্তরাষ্ট্রে যদি বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়ানো হয়, ক্রমবর্ধমান হারে ব্যবসা ও বিনিয়োগ হয়, পরিবেশবান্ধব জ্বালানির জন্য পথ তৈরি করা যায়, যাতে বাংলাদেশের পরিবেশের উন্নতি হয় আর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা যায়; আমরা যদি এ বিষয়গুলো করতে পারি, তবে জটিল বিষয়গুলো সমাধানের পথ সহজ হবে। র্যাব’র বিরুদ্ধে বিদ্যমান মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কোনো অগ্রগতি আছে কি-না? জানতে চাইলে ডনাল্ড লু বলেন, নিষেধাজ্ঞা এখনো বহাল। এক বছর আগে বাংলাদেশ সফরের সময় র্যাব’র বিষয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনের প্রসঙ্গ তুলেছিলাম। গত বছর তাদের সেই প্রতিবেদনে উল্লেখ ছিলো, র্যাব’র হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুম নাটকীয়ভাবে কমেছে। এটা বিরাট ঘটনা। এটা অবশ্যই অগ্রগতি, তবে আমাদের এখনো উদ্বেগ রয়ে গেছে। আমরা দেখছি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্য বিভাগের সদস্যরা এসব অপরাধ করে চলেছেন। তাছাড়া র্যাব’র অতীতের অপরাধের জবাবদিহি নিশ্চিত করা হচ্ছে কি না, সেটাও আমরা দেখতে চাই। লু বলেন, আমরা জানি যে, বাংলাদেশ সরকারের র্যাব’র নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার প্রক্রিয়া নিয়ে ধৈর্যের অভাব আছে। গত বছর বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুম নাটকীয়ভাবে কমে যাওয়ার মাধ্যমে এটা প্রমাণিত যে, র্যাব মানবাধিকার লঙ্ঘন না করেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারে। এক প্রশ্নের জবাবে লু বলেন, বাংলাদেশে মানবাধিকার নিয়ে সমস্যা দেখা দিলে আমরা কথা বলি। কারণ, বাংলাদেশ আমাদের সহযোগী। আমাদের কোনো সমস্যা দেখলেও বাংলাদেশ তা খোলা মনে বলতে পারে। লু বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে বিক্ষোভ দমনকালে পুলিশের অতি উৎসাহী পদক্ষেপ থাকলে তা অবশ্যই তদন্তে ধরা পড়বে এবং অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় আনা হবে। গণতন্ত্রে এটাই হয়।মানবজমিন