ডেস্ক রির্পোট:- দেশে গত ছয় মাসে আড়াই হাজারের বেশি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় শতাধিক ব্যক্তি নিহতের পাশাপাশি আহত হয়েছে সহস্রাধিক। মূলত সামাজিক নানা ইস্যুতে সংঘর্ষের এসব ঘটনা ঘটছে। গত বছর নভেম্বর থেকে চলতি বছর এপ্রিল পর্যন্ত এসব ঘটনা ঘটে। পুলিশ ও বিভিন্ন সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সূত্র জানায়, এলাকার আধিপত্য বিস্তার, নির্বাচনে জয়-পরাজয়, দলীয় কোন্দল, অর্থের অপব্যবহার, ভোটকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের উসকানির কারণে এসব সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ঘিরে পরিস্থিতি আরো নাজুক হওয়ার আশঙ্কা করছে পুলিশ সদর দপ্তর।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গত ২৯ এপ্রিল মাসিক অপরাধ পর্যালোচনাসভায় পুলিশ সদর দপ্তরের পক্ষ থেকে দেশের সব পুলিশ সুপারকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
নির্দেশনায় উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের পাশাপাশি কেউ যেন সামাজিক অস্থিরতাকে ব্যবহার করে গুজব ছড়াতে না পারে সে বিষয়ে সতর্ক নজর রাখতে বলা হয়েছে।
মাসিক অপরাধ পর্যালোচনাসভায় অতিরিক্ত আইজিপি (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) মো. আতিকুল ইসলাম এসব নির্দেশনা দেন। ওই সভায় মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার, রেঞ্জ ডিআইজি ও জেলার পুলিশ সুপাররা অনলাইনে অংশগ্রহণ করেন। পুলিশ সদর দপ্তর প্রান্তে উপস্থিত ছিলেন ডিআইজি (ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট) জয়দেব কুমার ভদ্র ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
পুলিশ ও হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর ১৫ নভেম্বর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে চলতি বছর ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় সংঘর্ষ, সংঘাত, হত্যা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। নির্বাচনী সহিংসতায় এ সময়ে ৭৫২টি ঘটনায় নিহত হয়েছে ১৭ জন। আহত হয়েছে দুই হাজার ৫৩৪ জন। গুলিবিদ্ধ হয়েছে ১০০ জনের বেশি। গৃহ ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে ৪৫০টি।
গাড়ি ও যানবাহন ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে ১০০টি।
প্রতিবেদন অনুযায়ী শুধু জানুয়ারি মাসেই নিহত হয়েছে ১২ জন। এর মধ্যে ১১ জনই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থক। এ ছাড়া তফসিল ঘোষণার পর থেকে ৬ জানুয়ারি নির্বাচনের আগের দিন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জেলায় অন্তত ৩৭৯টি সংঘর্ষের ঘটনায় নিহত হয়েছে সাতজন এবং আহত হয়েছে এক হাজার ৬৮১ জন। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন ২০ জন। একই সময়ে ৫০টির বেশি গৃহ ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। ৪০টির বেশি ভোটকেন্দ্র ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের দিন সহিংসতার ঘটনায় মুন্সীগঞ্জ, বরগুনা ও কুমিল্লায় নিহত হয়েছে তিনজন, আহত হয়েছে ১৫০ জনের বেশি। গুলিবিদ্ধ হয়েছে ১৬ জন। আর পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ৩০ জনের বেশি সাংবাদিক আক্রান্ত হয়েছেন।
প্রতিবেদনে আরো দেখা গেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেষ হওয়ার পরপরই দেশের ৪১ জেলায় সংঘর্ষ ও ভাঙচুরের ঘটনায় সাতজন নিহত আর ৬৯৬ জন আহত হয়েছে। এর মধ্যে ৬০ জনের বেশি গুলিবিদ্ধ, ৪০০টির বেশি গৃহ ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ঝিনাইদহের পোড়াহাটিতে ৫০টি, মাদারীপুরের কালকিনি ও কাউয়াকুড়িতে ১০০টি, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় ৩০টি, সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে ২০টি দোকান, বসতবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।
এ ছাড়া সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার, মানিকগঞ্জের সিংগাইর ও হরিরামপুর, পিরোজপুরের ইন্দুরকানি, নেত্রকোনার কেন্দুয়া, সাতক্ষীরার শ্যামনগর, গাজীপুর, গাইবান্ধা, খুলনার ডুমুরিয়া, নাটোর, নোয়াখালী, মাদারীপুর, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ, ঢাকার ধামরাই, কুষ্টিয়ার দৌলতপুর ও কুমারখালী, মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান ও গজারিয়া, পটুয়াখালীর কলাপাড়া, রাজশাহীর পবা ও পারিলায় সংঘর্ষের ঘটনায় বিভিন্ন দলের সমর্থক ও সাধারণ মানুষসহ সাতজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৬৯৬ জন, গুলিবিদ্ধ হয়েছেন ৬০ জন।
নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর উপজেলা ও স্থানীয় নির্বাচন ঘিরে সংঘর্ষ বেড়েছে। এর মধ্যে চলতি বছর জানুয়ারি থেকে গত ২২ এপ্রিল পর্যন্ত ৬৮৯টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন ৪২ জন। আহত দুই হাজার ৩২৮ জন।
হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির পরিসংখ্যান বলছে, স্থানীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গত মার্চ মাসে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ১৭টি সহিংসতার ঘটনায় তিনটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, আহত হয়েছেন ৯২ জন। আর গত এপ্রিল মাসের ২২ তারিখ পর্যন্ত ৩৭টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন ১১ জন, আহত হয়েছেন ১৬০ জন।
পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি-অপারেশন) আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘নির্বাচন ঘিরে সহিংসতা, হামলা, ভাঙচুর নিয়ন্ত্রণে পুলিশ সতর্ক রয়েছে। যেখানেই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে, সেখানেই পুলিশ উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে।’
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের ১২টি জেলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে মাদারীপুরের কালকিনিতে বেদে সম্প্রদায়ের অন্তত ২০টি ঘরবাড়িতে হামলা করে ভাঙচুরের ঘটনা ঘঠেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে হিন্দু সম্প্রদায়ের ছয়টি বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়েছে। কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে ৫০টি হিন্দু পরিবারকে সাত দিন অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার আরাফাত ইসলাম বলেন, ‘কেউ যাতে গুজব ছড়িয়ে কোনো ধরনের অঘটন ঘটাতে না পারে সে বিষয়ে আমরা সতর্ক আছি।’
অপরাধ বিশ্লেষক মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুলিশ সায়েন্স অ্যান্ড ক্রিমিনোলজি বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, ‘সামাজিক অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে মানুষের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি হবে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর উচিত সংঘর্ষের এসব ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করে জনগণের আতঙ্ক দূর করা।’কালের কন্ঠ