ডেস্ক রির্পোট:- বিরোধী দলগুলোর বর্জনের মধ্য দিয়ে বুধবার অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপের সার্বিক পরিস্থিতির পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ চলছে নির্বাচন কমিশনে (ইসি)। ইসির হিসাবে ১৩৯টি উপজেলায় ভোটের গড় হার ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ। যদিও দিনভর বিভিন্ন গণমাধ্যমে ভোটার উপস্থিতির হতাশাজনক চিত্র তুলে ধরা হয়। সংঘর্ষ, গুলি, ককটেল বিস্ফোরণ, জাল ভোট ও কেন্দ্র দখলের ঘটনাও ঘটেছে বিভিন্ন স্থানে। এতে অন্তত অর্ধশতাধিক লোক আহত হয়। গ্রেপ্তার হন প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং, পোলিং অফিসারসহ অনেকে। উপজেলা নির্বাচনে সর্বনিম্ন ভোটার উপস্থিতির রেকর্ডের মধ্যেই বেশি মাত্রার সংঘাত-সহিংসতা ইসির শীর্ষ কর্তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। পরের তিন ধাপের ভোট নিয়ে নানা শঙ্কায় রয়েছেন তারা। পরবর্তী ধাপগুলোতে ভোট আরও শান্তিপূর্ণ করে কীভাবে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো যায়—সে বিষয়ে করণীয় নিয়ে ভাবছেন তারা।
ইসি সূত্র জানায়, ভোটের দিন রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবন থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল এবং অন্য কমিশনাররা। ভোট মনিটর করেন দায়িত্বপ্রাপ্ত টিমের সদস্যরাও। সকাল থেকেই প্রায় সারা দেশে ভোটার উপস্থিতির করুণ চিত্র উঠে আসে। তবে ভোটারদের উপস্থিতি কম থাকলেও বিভিন্ন উপজেলায় সংঘাত-সহিংসতায় জড়ান প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা। এতে বেশ উদ্বেগ প্রকাশ করেন কমিশনের কর্তারা। ভোট শেষে সার্বিক পরিস্থিতির মূল্যায়নে বসে পড়েন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা।
কমিশনের হিসাবে এ ধাপে ভোটের হার ছিল ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ। এতে অন্য সবার মতো নির্বাচন কমিশনও ‘অসুখী’ মনোভাব প্রকাশ করেছে। ভোট পড়ার এই হারকে ‘কম’ আখ্যা দিয়ে সেজন্য মোটা দাগে পাঁচটি কারণও চিহ্নিত করা হয়েছে। সেগুলো হলো বৈরী আবহাওয়া, অনেক রাজনৈতক দলের ভোটে অংশ না নেওয়া, জনপ্রিয় প্রার্থীর অভাব, ধান কাটার মৌসুম এবং সাধারণ ছুটি থাকায় শ্রমিকরা নিজ এলাকায় চলে যাওয়া।
গতকাল বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর সাংবাদিকদের মোটা দাগে এই পাঁচ কারণের কথা জানান। যদিও ভোটের দিন দুপুর ১২টা পর্যন্ত এ হার ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ছিল বলে জানান ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলম। আর ভোট গ্রহণ শেষে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল গণমাধ্যমে জানান, কোনো কোনো এলাকায় বৃষ্টি-বাদল এবং মানুষ ধান কাটতে ব্যস্ত থাকায় ভোটার উপস্থিতি কম ছিল। তবে ভোটারদের নগণ্য এ উপস্থিতির মধ্যেও সারা দেশে সংঘাত-সহিংসতার ঘটনায় বেশ উদ্বিগ্ন কমিশন।
ইসির তথ্য অনুযায়ী, ১৩৯টি উপজেলার মধ্যে ২২টিতে ইভিএমে ভোট হয়েছে। এসব উপজেলায় ভোট পড়ার হার ৩১ দশমিক ৩১ শতাংশ। আর ব্যালট পেপারে ভোট হওয়া বাকি ১১৭ উপজেলায় ভোটের হার ৩৩ দশমিক ২২ শতাংশ। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ভোট পড়েছে জয়পুরহাটের ক্ষেতলালে ৭৩ দশমিক ১৬ শতাংশ। এ ছাড়া রাঙ্গামাটির কাউখালীতে ৭০ দশমিক ৫৩ শতাংশ ও পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় ৬৬ দশমিক ১৮ শতাংশ ভোট পড়ে। আর সর্বনিম্ন ১৭ শতাংশ ভোট পড়েছে বগুড়ার সোনাতলায়, চট্টগ্রামের মিরসরাই ও কুষ্টিয়া সদর উপজেলায়। এ ছাড়া ঢাকার নবাবগঞ্জে ১৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ ও চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে ১৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ ভোট পড়ে।
এর আগে ২০১৯ সালে পঞ্চম উপজেলা নির্বাচনে গড়ে ৪১ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছিল। আর ২০১৪ সালে চতুর্থ উপজেলা নির্বাচনে ৬১ শতাংশ এবং ২০০৯ সালে তৃতীয় উপজেলা নির্বাচনে ৬৭.৬৯ শতাংশ ভোট পড়ে। সেই হিসাবে গত এক দশকের মধ্যে স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচনে ভোটের হার এবারই সবচেয়ে কম।
ইসির নির্বাচন পরিচালনা শাখার একাধিক কর্মকর্তা জানান, জাতীয় নির্বাচনের পর এবারের উপজেলা নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে বেশ চিন্তিত কমিশন। ভোটের ব্যাপারে দিন দিন মানুষের এমন অনাগ্রহের কারণ খুঁজছেন সংশ্লিষ্টরা। এতে অনেক কারণের কথা বলা হলেও মূল কারণ হিসেবে ‘একতরফা’ ভোটকেই দায়ী করা হচ্ছে। সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের মতো বিএনপিসহ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এবারের উপজেলা নির্বাচনও বর্জন করেছে। ফলে ক্ষমতাসীনদের নিজেদের মধ্যে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচন নিয়ে তেমন আগ্রহ বা উচ্ছ্বাস দেখাননি ভোটাররা।
তবে রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের বিষয়ে কমিশনের খুব বেশি কিছু করার ক্ষমতা নেই বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। সংবিধান ও আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে প্রতিটি নির্বাচন যথাসময়ে আয়োজন করছে কমিশন। পরবর্তী ধাপগুলোতে ভোটার উপস্থিতি বাড়িয়ে কীভাবে কম সহিংসতাপূর্ণ ভোট আয়োজন করা যায়, তা চিন্তাভাবনা চলছে।
নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেন, ‘নানা কারণে ভোট কম পড়েছে। এ ছাড়া প্রার্থীর জনপ্রিয়তার ওপরও ভোট পড়ার হার নির্ভর করে। এই নির্বাচনের ৭৩ শতাংশ ভোট পড়েছে এমন এলাকাও আছে। আবার ১৭ শতাংশও ভোট পড়েছে এমন উপজেলাও আছে।’
তিনি বলেন, ‘এটা স্থানীয় সরকার নির্বাচন। এই নির্বাচনে সরকার পরিবর্তন হবে না। তাই দলগুলোকে ভোটে আসার জন্য আলোচনায় ডাকা হয়নি। এই নির্বাচনে সংলাপ করার কোনো দরকার নেই। তবে সব দল এলে ভোট পড়ার হার আরও বেশি হতো।’
তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন চেয়েছে বলেই সবার সহযোগিতায় সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভোট হয়েছে। ছোটখাটো ত্রুটি হতেই পারে, সেই ত্রুটিকে বড় করে দেখার কোনো কারণ নেই।’
প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচন পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন ভোটের যে হার উল্লেখ করেছে, তা নিয়ে অনেকেরই সন্দেহ আছে। কারণ, ভোটের দিন সবাই গণমাধ্যমে ভোটের চিত্র দেখেছে। তবে কমিশনের ভোটের হিসাব সত্যি হলেও, তা একেবারেই তলানিতে। এর মূল কারণ ক্ষমতাসীন দলের নিজেদের মধ্যে অনুষ্ঠিত একতরফা নির্বাচন। এ নির্বাচন দেশের বেশিরভাগ দল বর্জন করেছে, যা ক্ষমতাসীনদের বোঝা উচিত। আর অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনে কমিশনেরও অনেক কিছু করার আছে। সংবিধান তাদের অনেক ক্ষমতা দিয়েছে। কিন্তু তারা তা ব্যবহার করছেন না।’কালবেলা