রাঙ্গামাটি:- রাঙ্গামাটি সদর উপজেলায় একক প্রার্থী দিতে ব্যর্থ হওয়ায় আওয়ামীলীগের নৌকা প্রতীকের বর্তমান চেয়ারম্যান শহীদুজ্জামান মহসিন শেষ দিনের শেষ বেলায় প্রার্থীতা প্রত্যাহার করে নিয়ে ভোটের মাঠের লড়াইয়ের চিত্রই পাল্টে দিয়েছেন। ঠিক কি কারণে বা কোন সমীকরণে ভোটের মাঠ থেকে সড়ে গেলেন এই প্রার্থী,সেই সম্পর্কে তিনি নিজস্ব একটি ব্যাখ্যা দিলেও তা ধোপে টেকেনি। ধারণা করা হচ্ছে,প্রতীকবিহীন নির্বাচনে একক প্রার্থী হিসেবে মাঠে দাপট দেখানোর সুযোগ না থাকায় এবং ভোটের আগামচিত্র সুবিধার মনে না হওয়ায় নিজেকে সড়িয়ে নিয়েছেন তরুন এই জনপ্রতিনিধি। সেই সাথে নিজে যে সংগঠনের সহসভাপতি,সেই সংগঠনের সভাপতি-সম্পাদকসহ বড় অংশটির বিপরীত অবস্থানও তাকে ভিন্ন চিন্তা করতে বাধ্যই করেছে। তবে তিনি থাকলে ভোটের মাঠের চিত্র কি হতো তা এখন দূর অতীত। আলোচনায় আড্ডায়ও এসব ফিঁকে এখন। বাকি থাকা ৫ প্রার্থীর তালিকাকেও ছোট করে নিয়ে এসেছেন ভোটাররা। ফলে নারী সমাজকর্মী সুফিয়া কামাল ঝিমি এবং হিন্দু অধিকারকর্মী পঞ্চানন ভট্টাচায ভোটের মাঠে প্রচারে সক্রিয় থাকলেও ভোট রাজনীতিতে বেশ পিছিয়ে এখনো। বরং সর্বত্র আলোচনা ছড়াচ্ছেন বাকি তিন প্রার্থী অন্ন সাধন,বিপ্লব আর শাহজাহান।
এদের মধ্যে প্রভাবশালী আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সমর্থনে অন্নসাধন চাকমা বেশ শক্ত প্রার্থীই। ধারণা করা হচ্ছে অন্ন সাধন চাকমার সাথে বিপ্লব ও শাহজাহানের ত্রিমুখী লড়াই বেশ জমজমাটই হবে। এতে জিততে পারেন যে কেউই। এখানে আওয়ামলীগের তিন নেতা প্রার্থী থাকায় বেশ সুবিধাজনক অবস্থানেই আছে জনসংহতি সমর্থিত প্রার্থী। সেই সাথে অন্তত একটি মেয়াদ পর হলেও এবার ভোটের মাঠে বেশ সক্রিয় মনে হচ্ছে জনসংহতি সমিতির নেতাকর্মীদের। এর আগের সর্বশেষ নির্বাচনে পরাজিত তৎকালীন চেয়ারম্যান প্রার্থী অরুন কান্তি চাকমার পক্ষেও শেষ মুহুর্তে এমন সক্রিয় দেখা যায়নি দলটির নেতাকর্মীদের। সঙ্গত কারণেই অন্ন সাধন কে ভোটের মাঠে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়ই মনে করা হচ্ছে এবার। উপজাতীয় কাঠ ব্যবসায়ি সমিতির সাধারন সম্পাদক অন্ন সাধন কার্বারী হিসেবেও পরিচিত,তিনি কার্বারীদের জেলা কমিটির সভাপতিও। জেএসএস এর পাশাপাশি ইউপিডিএফ নিয়ন্ত্রিত ইউনিয়নগুলোর ভোটও তার বাক্সে যাবে বলে জানাচ্ছেন ইউপিডিএফ সূত্রগুলো। শহরের পাহাড়ী ভোটের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এবং ৬ ইউনিয়নের ভোটের বড় অংশটিই যদি তিনি নিয়ন্ত্রন করতে পারেন,তবেই তাকে চেয়ারম্যান হিসেবে দেখা যাবে হয়ত এবার। কিন্তু বাঙালী অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে তার প্রচার ও পরিচিত নেই বললেই চলে। আবার রাজনীতির মাঠেও নবীন ও অপরিচিত তিনি। ফলে ন্যুনতম বাঙালি ভোটও যদি তার বাক্সে না আসে তবে কিছুটা হলেও ঝুঁকিতে থাকবেন তিনি।
অন্ন সাধন এর জন্য চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছেন পৌর আওয়ামীলীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক ছাত্র ও তারাবুনিয়া মৌজার হেডম্যান অ্যাডভোকেট বিপ্লব চাকমা। পেশায় আইনজীবি ও ব্যক্তিগতজীবনে সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে সুপরিচিত বিপ্লব,আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীদের বিপদের বন্ধু হিসেবেই পরিচিত। আদালত অঙ্গনে একটি দীর্ঘসময় মামলা হামলায় জর্জরিত নিজ দল আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদের নিঃশর্ত সহযোগিতার কারণে তার প্রতি তৃণমূল নেতাকর্মীদের সমর্থন বিপুল। আবার বিরোধী বিএনপির নেতাকর্মীদেরও আছে প্রচ্ছন্ন সমর্থন। ফলে ভোটের মাঠে নতুন হলেও ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা,ছোট বেলা থেকেই ছাত্রলীগ-যুবলীগ হয়ে আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে নিবিঢ়ভাবে জড়িত থাকা বিপ্লব ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছেন। শহরের শিক্ষিত ও সচেতন পাহাড়ীদের ভোটের একটি বড় অংশই তার বাক্সে যাবে,যদি চাপহীন পরিবেশে তারা ভোট দিতে পারেন। পাশাপাশি পুরো শহরের বাঙালী ভোটের বড় অংশটিই মোটামুটি নিয়ন্ত্রনে তার। যদি পাহাড়ী ভোটের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ টেনে নিতে পারেন তিনি এবং বাঙালী ভোটের বড় অংশটিই বাক্সে আনতে পারেন,তবে শেষ হাসি তার হাসাও সম্ভব,খুবই সম্ভব। তার জন্য বাড়তি দুঃশ্চিন্তা হলো পঞ্চানন,ঝিমি ও শাহজাহানের ‘কাটা ভোট’। এই ‘কাটা ভোট’ কতটা কম বা বেশি,তার উপরও নির্ভর করছে তার বহুকিছুই। সব মিলিয়ে ব্যক্তি বিপ্লবের অসাম্প্রদায়িক ইমেজ তার জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ রাঙামাটির সচেতন শিক্ষিত বিবেকবান মানুষ বহুদিন ধরেই এমন প্রার্থীই খুঁজছেন,যিনি দল বা জাতের উর্ধে উঠে ‘সর্বজনীন’ নেতা হয়ে উঠবেন।
জেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগের সাধারন সম্পাদক মোঃ শাহজাহান,মূলত ‘জিদের প্রার্থী’। রোমানকে চেয়ারম্যান পদ থেকে সড়াতে সংঘবদ্ধ স্বেচ্ছাসেবকলীগ,যুবলীগ ও আওয়ামীলীগের বিক্ষুদ্ধ কয়েকজন নেতা ভোটের মাঠে নামিয়েছিলেন তাকে। শেষ পর্যন্ত মাঠ থেকে সরে যাওয়ায় ক্ষেত্রে কিছুটা নমনীয় হলেও রোমানের কারণেই ফের ভোটের মাঠেই রয়ে গিয়ে এবং নানা চাপেও ভোটের মাঠে থেকে শাহজাহান প্রমাণ করেছেন,তিনি ভোটটা করতেই চাইছেন মনেপ্রাণে। তার পক্ষে থাকা নেতারা সবাই মূলত রিজার্ভবাজার কেন্দ্রিক। ফলে রিজার্ভবাজারের ভোটের আঞ্চলিক সমীকরণে সেখানকারে ভোটের বড় একটি অংশই হয়ত তার বাক্সেই যাবে। কিন্তু বাকি শহরের ভোটের কতটা তিনি সংগ্রহ করতে পারেন,তার উপর নির্ভর করছে তার ভবিষ্যত। তার উপর তাকে পুরোটাই নির্ভর করতে হচ্ছে বাঙালী ভোটের উপরই। আবার রোমানকে সড়াতে তাকে মাঠে নামানো নেতারা সবাই মনে প্রাণে তার বিজয় কামনা করছেন কিনা সেটা নিয়েও আছে সন্দেহ,অবিশ^াস। কিন্তু চলনে বলনে ‘ভীষণ সাধারন’ শাহজাহান ভোটের মাঠেও বিপদজনক প্রার্থী,এটা বলাই যায়।
জয়ের আশাবাদের কথা জানিয়ে বলেন ‘উট’ প্রতীকের প্রার্থী এ্যাডভোকেট বিপ্লব চাকমা বলেন, ‘এখানকার নির্বাচনে সাম্প্রদায়িকতা নানাভাবে ভূমিকা ফেলে। আমি একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ ও রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে সব দল মত জাতির মানুষ আমাকে নির্বিশেষে বেছে নিবে বলেই বিশ্বাস আমার। আমাকে পাহাড়ী বাঙালী সবাই ভোট দিবেন এবং জয়ের ব্যাপারে আমি খুবই আশাবাদী।’ বিপ্লব চাকমা বলেন,রাঙামাটির মত অসাম্প্রদায়িক শহরে এমন মানুষই বিজয়ী হওয়া উচিত যিনি শুধুমাত্র পাহাড়ী ভোট বা শুধুমাত্র বাঙালীর ভোটে বিজয়ী হবেন না। দুই জাতি,সব ধর্মের মানুষের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সবার জন্য সমভাবে চিন্তা ও কাজ করতে পারবেন, এমন প্রার্থীই বিজয়ী হওয়া প্রয়োজন পার্বত্য এই শহরে।’
আরেক প্রার্থী ‘কাপপিরিচ’ প্রতীকের,মোঃ শাহজাহান বলছেন, আমি জয়ের ব্যাপারে অত্যন্ত আশাবাদি, আমার বিশ^াস জনগণ অতীতে অনেক বড়লোক প্রার্থী ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে প্রতারিত হয়েছে। এবার আমার মত সাধারন একজন প্রার্থীকেই বেছে নিবেন তারা। তিনি বলেন, আমার সম্ভাবনা বেশিই মনে করছি আমি। কারণ আমি সাধারন মানুষ,ভাবসাব নিয়ে চলাফেরা করিনা। সাধারন মানুষ আমাকে নিজেদের মানুষ মনে করছে। এটাই আমার সবচে বড় অর্জন।’
জয়ের আশাবাদের কথা জানালেন জনসংহতি সমিতি সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী দোয়াল কলম প্রতীকের অন্নসাধন চাকমা। নির্বাচন সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হলে জয় সুনিশ্চিত বলে দাবি করেন এই প্রার্থী। তিনি বলেন, আমি খুবই আশাবাদী। তবে ভয়ও আছে। অতীতের নির্বাচনগুলো যেভাবে হয়েছে,এবারও এমন কিছু হলে তাহলে ভালো কিছু আশা করা কঠিন। তবে আমি বিশ্বাস করি, এবার তেমন হবেনা। যদি সবকিছু ঠিকঠাক হয়,তবে বিজয়ী হওয়ার ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী আমি।’
পাঁচ প্রার্থীর মধ্যে আলোচনায় এগিয়ে থাকা তিন প্রার্থী অন্ন সাধন, বিপ্লব চাকমা এবং শাহজাহান, এই তিনজনের ভোটযুদ্ধে বিজয়ী হবেন কে শেষাবধি ? পুরোটাই পাহাড়ী ভোটের উপর নির্ভরশীল অন্ন সাধন, পুরোই বাঙালী ভোটের উপর নির্ভর শাহজাহান নাকি যূথবদ্ধ পাহাড়ী-বাঙালীর অসাম্প্রদায়িক যৌথ ভোটের উপর নির্ভরশীল বিপ্লব চাকমা ! তা জানার জন্য আপাতত অপেক্ষাই করতে হবে,৮ মে শেষ বিকেল অবধি।পাহাড় টোয়েন্টিফোর