সুন্দরবনে ৫৪ বছরে ৪০ বার অগ্নিকাণ্ড

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় সোমবার, ৬ মে, ২০২৪
  • ৮৬ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- আবারও আগুন লাগল বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ সুন্দরবনে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ বনে প্রায় প্রতিবছরই আগুনের ঘটনা ঘটছে। ১৯৭০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৫৪ বছরে অন্তত ৪০ বার আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ গত ৪ মে আগুন লাগে চাঁদপাই রেঞ্জ এলাকার আমুরবুনিয়ায়।

এবারের আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের উদ্যোগ ছাড়াও বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়েছে। গতকাল রবিবার বিকেলে প্রধান বন সংরক্ষকের পরিদর্শনের পর বন বিভাগ আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে দাবি করেছে। এমন প্রেক্ষাপটে সামনে এসেছে অতীতের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত না হওয়ার অভিযোগ।

অগ্নিকাণ্ডের এলাকা পরিদর্শনের পর গতকাল রাত ৮টার দিকে প্রধান বন সংরক্ষক আমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন, ‘সুন্দরবনে জ্বলতে থাকা আগুন এখন দেখা যাচ্ছে না।

এর পরও মাটির নিচের অংশে ধোঁয়ার কুণ্ডলী থেকে আগুন দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে বন বিভাগের সদস্যরা পানি দিয়ে আগুন নেভাবেন। এ জন্য রাতভর আগুনের এলাকায় দায়িত্ব পালন করার জন্য ২০ জনের একটি টিম গঠন করা হয়েছে। অগ্নিনির্বাপণের জন্য সুন্দরবন পূর্ব ও পশ্চিম বিভাগের পাম্প মেশিন যুক্ত করা হয়েছে।’

প্রায় পাঁচ একর এলাকায় বিক্ষিপ্তভাবে আগুন ছড়িয়েছিল বলে প্রধান বন সংরক্ষক জানান।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয়ে তিনি বলেন, আগুন নেভানোর জন্য বনের ক্যাম্পগুলোতে নিজস্ব পাম্প মেশিন যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়া পানির উৎস নিশ্চিত করতে ভোলা নদী, খোড়মা ও আড়ুয়ারবের খাল খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আগামী অর্থবছরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে এই নদী ও খাল খনন করা হবে।

প্রধান বন সংরক্ষক আরো জানান, আগুনে বনের জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণে আজ সোমবার উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করা হবে।

এর আগে বন বিভাগের খুলনা অঞ্চলের সংরক্ষক মিহির কুমার দো জানান, তখনো বিক্ষিপ্তভাবে ধোঁয়া উঠতে দেখা যাচ্ছিল।

তবে আগুনের ভয়াবহতা ছিল না। অগ্নিকাণ্ড এলাকার প্রায় দুই কিলোমিটার দূরের মরাভোলা নদীর বিভিন্ন স্থানে পাইপ বসিয়ে পানি এনে আগুন নেভাতে ব্যবহার করা হয়। বাগেরহাট, মোংলা, কচুয়া, মোরেলগঞ্জ ও শরণখোলা থেকে ফায়ার সার্ভিসের পাঁচটি ইউনিট আগুন নেভাতে কাজ করে। এ ছাড়া বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার শ্যালা নদী থেকে পানি সংগ্রহ করে তা ওপর থেকে আগুনে নিক্ষেপ করে।

মিহির কুমার দো বিকেলে বলেছিলেন, আগুন সম্পূর্ণভাবে নিভেছে কি না তা নিশ্চিত হতে আরো দুই-তিন দিন অপেক্ষা করতে হবে।

বাগেরহাট ফায়ার স্টেশনের উপপরিচালক সাইদুল ইসলাম চৌধুরী জানান, বনের আড়াই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিক্ষিপ্তভাবে আগুন ছড়িয়েছে। আগুন যাতে আর ছড়াতে না পারে, সে জন্য ওই এলাকা ঘিরে ফায়ার লেন (কর্ডন) তৈরি করা হয়েছে।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বনে আগুনের বিষয়টি অবহিত আছেন এবং খোঁজখবর নিচ্ছেন। এতে বলা হয়, প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।

প্রসঙ্গত, গত শনিবার সকাল ১১টার দিকে পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের জিউধরা স্টেশনের আমুরবুনিয়া টহল ফাঁড়ির লতিফের ছিলা এলাকায় প্রথমে আগুন লাগে। প্রাথমিকভাবে বনকর্মী এবং বনের সুরক্ষায় নিয়োজিত স্বেচ্ছাসেবী ও স্থানীয় লোকজন আগুন লাগা এলাকার চারদিকে পরিখা (ফায়ার লেন) কেটে এর বিস্তাররোধের চেষ্টা করেন।

বন বিভাগের পক্ষ থেকে গঠিত তদন্ত কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে আগুন লাগার কারণ জানাতে বলা হয়েছে।

‘আগুন নিয়ন্ত্রণে’, বলল পরিবেশ মন্ত্রণালয়

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ও গতকাল এক বিবৃতিতে সুন্দরবনের আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে জানিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, আগুন গাছের ডালপালা পর্যন্ত ছড়ায়নি। বরং তা মাটির নিচে গাছের শিকড়ের মধ্য দিয়ে বিস্তৃতি লাভ করছে।

বিবৃতিতে জানানো হয়, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী এবং মন্ত্রণালয়ের সচিব ফারহিনা আহমেদ আগুন নেভানোর কার্যক্রম সার্বক্ষণিকভাবে তদারকি ও সমন্বয় করছেন।

আগের সুপারিশ কার্যকর হয়নি

সুন্দরবনে এ পর্যন্ত প্রতিটি আগুনের ঘটনা ঘটেছে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জে। এর আগে ২০২১ সালে চাঁদপাই রেঞ্জে দুইবার আগুন লেগেছিল। অতীতের আগুনের ঘটনায় প্রতিবারই তদন্ত কমিটি হলেও তাদের প্রতিবেদনের কোনো সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। অতীতের সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে : ৪০ কিলোমিটার খাল ও তিনটি পুকুর পুনরায় খনন করা, বন বিভাগের জনবল বাড়ানো, বনরক্ষীদের টহল কার্যক্রম জোরদার করা, কমপক্ষে তিনটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার তৈরি করা, রিভার ফায়ার স্টেশন নির্মাণ করা ও শুকিয়ে যাওয়া ভোলা নদী খনন করা। কিন্তু বিশেষ করে অবকাঠামোগত ও ভৌত কাজসহ কোনো সুপারিশই দৃশ্যত কার্যকর হয়নি।

যেসব কারণে আগুন লাগে

আগের তদন্ত কমিটিগুলোর বেশির ভাগ প্রতিবেদনেই আগুন লাগার কারণ হিসেবে মৌয়ালদের ব্যবহৃত আগুনের কুণ্ডলী, জেলেদের সিগারেট, গ্রীষ্মের দাবদাহ, অনাবৃষ্টি, বন অপরাধে সাজাপ্রাপ্তদের প্রতিশোধমূলক কাজ ইত্যাদিকে দায়ী করা হয়। মাটিতে জমা হওয়া শুকনা পাতার পুরু স্তর আগুন ছড়িয়ে পড়তে ও দীর্ঘস্থায়ী হতে সাহায্য করে।

শুষ্ক মৌসুম বন থেকে মধু আহরণের সময়। বর্তমানে তা চলছে। এ ছাড়া বাগদা ও গলদা চিংড়ির পোনা (রেণু) আহরণের সময়ও এখন। বনসংলগ্ন গ্রামগুলোর বাসিন্দাদের কেউ কেউ গোপনে বনে প্রবেশ করে মধু সংগ্রহ করে। অনেকে বনের ভেতর দিয়ে হেঁটে শ্যালা নদীতে পোনা আহরণ করতে যায়। এরা বনের হাঁটাপথে বিড়ি-সিগারেট খেয়ে তার অবশিষ্টাংশ যেখানে সেখানে ফেলে। মধু সংগ্রহকারীদের মৌমাছি তাড়ানোর মশাল থেকেও আগুন লাগে। সুন্দরবনের ধানসাগর ও জিউধরা স্টেশনের আওতায় বেশ কিছু বিল রয়েছে। এক শ্রেণির অসাধু জেলে বর্ষায় সহজে মাছ ধরার লক্ষ্যে এসব বিলের আগাছা পরিষ্কার করতে ইচ্ছা করে শুষ্ক মৌসুমে বনে আগুন ধরিয়ে দেয়।

সুন্দরবন বন বিভাগের তথ্য মতে, ১৯৭০ সালে চাঁদপাই রেঞ্জ এলাকায় আগুন লেগেছিল। এরপর থেকে দু-এক বছরের ব্যবধানে এই রেঞ্জ এলাকার কোনো না কোনো স্থানে আগুন লাগে। ১৯৯৬ সালের এপ্রিল মাসে এই রেঞ্জ এলাকার বৈদ্যমারিতে বেশ বড় আগুন লাগে। ১৯৭০ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ছোট-বড় কমপক্ষে ১৫টি আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। আর ২০০২ সাল থেকে এ পর্যন্ত অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে ২৪ বার।

২০০৬ সালে চাঁদপাই রেঞ্জের তেড়াবেকা, আমুরবুনিয়া, খুরাবাড়িয়া, পচাকোড়ালিয়া ও ধানসাগর এলাকায় পাঁচবার আগুন লাগে। ২০২১ সালের ৩ মে পূর্ব সুন্দরবনেরই শরণখোলা রেঞ্জের দাসেরভারানি এলাকায় যে আগু লাগে তা ফায়ার সার্ভিস, বন বিভাগ ও স্থানীয়দের প্রায় ৩০ ঘণ্টার চেষ্টায় নেভানো হয়।

বিশেষ করে এপ্রিল-মে মাসে এবং যে বছর গরমের তীব্রতা তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে, সেবারই আগুনের ঘটনা বেশি ঘটে।কালের কণ্ঠ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions