চাকমা নেতৃত্বের কুম্ভিরাশ্রু ও সিএইচটি কমিশনের বিবৃতি

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪
  • ৬০ দেখা হয়েছে

মেহেদী হাসান পলাশ:- কেএনএফ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থান গ্রহণের পরপরই জেএসএস ও এর সাথে নানাভাবে সম্পৃক্ত চাকমা নেতৃত্ব কেএনএফের প্রতি সহানুভূতিশীল নানা পোস্ট দিতে শুরু করেছে। অথচ কেএনএফ বারবার তাদের অস্ত্র হাতে তুলে নেয়ার অন্যতম কারণ বঞ্চনা, শোষণ বলে দাবী করেছে। বলা বাহুল্য বাংলাদেশ সরকার বা বাঙালিরা পাহাড়ের প্রান্তিক ট্রাইবাল জনগোষ্ঠীকে শোষণ ও বঞ্চিত করেনি। কেএনএফ বিভিন্ন সময় তাদের দাবী দাওয়ায় অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে তারা বলেছে, শান্তিচুক্তির পর পার্বত্য চট্টগ্রামে ও সেখানকার ট্রাইবাল জনগোষ্ঠীর জন্য সরকার যে বিশেষ সুযোগ সুবিধা দিয়েছে তা এককভাবে গ্রাব করেছে জেএসএসের বর্তমান ও সাবেক নেতাকর্মী এবং তাদের পরিবারের সদস্যবৃন্দ। বিশেষ করে জেএসএসের সাথে জড়িত চাকমা সদস্যবৃন্দ ও তাদের পরিবারবর্গ। একই অভিযোগ মারমা ন্যাশনাল পার্টিসহ আরো অনেকের। পাহাড়ের বৃহৎ ট্রাইবাল জনগোষ্ঠী যদি প্রান্তিক ট্রাইবাল জনগোষ্ঠীদের এই শোষণ ও বঞ্চনার দিকে ঠেলে না দিতো তাহলে নাথান বমের হাতে আজ শিল্পীর তুলি থাকতো, আগ্নেয়াস্ত্র নয়। অথচ আজ তারাই কেএনএফের প্রতি কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করছে।

কেএনএফ যখন শোষণ ও বঞ্চনার অভিযোগ তুলে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল তখন কিন্তু এই চাকমা নেতৃত্ব তাদের সাথে বসে যদি তাদের শোষণ-বঞ্চনার সুষ্ঠু বিধান দিতেন তাহলে আজকের দিনটি হয়তো তাদের দেখতে হতো না। কিন্তু সেটা তো তারা করেনইনি বরং রণকৌশল চাকমা নামক এক কোম্পানী কমাণ্ডারের নেতৃত্বে সেখানে বিশাল বাহিনী প্রেরণ করেছিল কেএনএফকে নিধন করতে। কিন্তু রণকৌশল রণকৌশলে কেএনএফের কাছে ধরা খেয়ে গেলে উল্টো কমাণ্ডারসহ সবাই নিহত হয়। এরপর থেকে একেরপর এক জেএসএস কেএনএফকে নিধন করতে বিরতিহীন যুদ্ধ চালিয়ে যায়। এতে দুইপক্ষেরই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সাধারণ মানুষেরও ক্ষয়ক্ষতি হয়। তবুও জেএসএস বান্দরবানে তাদের হারানো নিয়ন্ত্রণ আর কখনোই ফিরে পায়নি। যুদ্ধে কেএনএফের সাথে এঁটে উঠতে না পেরে জেএসএস কেএনএফ নিরাপত্তা বাহিনীর সৃষ্টি বলে প্রচারণা চালানো শুরু করে। প্রকৃতপক্ষে জেএসএস যখনই যার সাথে পেরে ওঠে না তখনই তার নামের সাথে নিরাপত্তা বাহিনীর সমর্থনপুষ্ট বলে ট্যাগ লাগায়। এটা তাদের চিরাচরিত স্বভাব।

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনামলে জিয়াউর রহমান যখন পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে বন্দি সন্তু লারমাকে মুক্তি দিয়ে ত্রিপুরাতে ফেরত পাঠায়, সেখানে থাকা শান্তিবাহিনীর সদস্যদের বুঝিয়ে দেশে ফিরিয়ে এনে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান করার জন্য, তখন সেখানে থাকা শান্তিবাহিনীর বাকি সদস্যরা সন্তু লারমাকে নিরাপত্তা বাহিনীর মদদপুষ্ট বলে তাকে প্রত্যাখ্যান করে। অন্যদিকে এম এন লারমার মৃত্যুর পর শান্তিবাহিনী দুই ভাগ হয়ে যায়, একভাগ সরকারের সাথে শান্তি চুক্তি করায় অন্যভাগ তা প্রত্যাখ্যান করলে তাদেরকেও নিরাপত্তা বাহিনীর মদদপুষ্ট বলে অভিযোগ করতে থাকে। এই অংশ যখন ইউপিডিএফ নামে নতুন দল গঠন করে তখন তাকেও নিরাপত্তা বাহিনীর মদদপুষ্ট বলে অভিযুক্ত করতে থাকে। এভাবে দেখা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের যখন কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সংগঠন বা জাতির সাথে জেএসএস বুদ্ধিবৃত্তিক, রাজনৈতিক বা সামরিক লড়াইয়ে পর্যুদস্ত করতে সক্ষম হতে পারেনি, তখনই তাকে নিরাপত্তা বাহিনীর মদদপুষ্ট বলে ট্যাগ লাগিয়ে বিতর্কিত করার চেষ্টা করে। একই কারণে কেএনএফ এর বিরুদ্ধেও তাদের এই প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল শুরু থেকেই। অথচ কেএনএফের সাথে যুদ্ধে সেনাবাহিনীর এ পর্যন্ত পাঁচজন সদস্য নিহত এবং আরো অনেকে আহত হয়েছে।

যদি দুইটি ছবির বিচারে কাউকে কোনো বাহিনীর মদদপুষ্ট বলে রায় দিতে হয় তাহলে বলা যেতে পারে, এ ধরনের ছবি জেএসএস নেতা সন্তু লারমা, চাকমা সার্কেল চিফ দেবাশীষ রায়সহ পাহাড়ের প্রায় সকল জনপ্রতিনিধির সাথে রয়েছে। সন্তু লারমাসহ জেএসএস এর শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সাথে সেনা সদস্যদের শত শত ছবি রয়েছে অন্তর্জালে। একই চিন্তা ধারায় বিচার করতে গেলে একথাও বলা প্রয়োজন যে, নাথান বম একসময় জেএসএসের ছাত্র সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সক্রিয় নেতা ছিল এবং তাদের সুপারিশক্রমে ভর্তি পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে পড়াশোনার সুযোগ পায়। কৃতজ্ঞতা স্বরূপ জেএসএসের সাথে সম্পৃক্ত হওয়া ছাড়াও খাগড়াছড়িতে এমএন লারমার আবক্ষ মূর্তি নির্মাণ করেন নাথান বম। জেএসএসের প্রচারণার স্টাইলে অনেকেই পাল্টা যুক্তি দিয়ে স্যোশাল মিডিয়ায় বলেছেন, নাথান বম বা কেএনএফ সন্তু লারমা বা জেএসএসের সৃষ্টি।

অন্যদিকে এ কথাও মনে রাখা প্রয়োজন যে, কেএনএফও একসময় অভিযোগ করত যে, জেএসএস ও চাকমারা কেএনএফ নিধনে যৌথবাহিনীকে সহযোগিতা করছে। তাদের অভিযোগ ছিল, জেএসএস সমর্থিত ট্রাইবাল জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন অঞ্চলে কেএনএফ এর অবস্থান ও চলাচল সম্পর্কিত তথ্য যৌথবাহিনীকে জানিয়ে দিত জেএসএস। সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা কেএনএফের বিভিন্ন পেজ ও গ্রুপে এ ধরনের অনেক প্রচারণা দেখেছি। অথচ আজকে যখন কেএনএফের সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও ব্যাংকলুটের ঘটনায় নিরাপত্তা বাহিনী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে জোরালো অভিযান পরিচালনা করছে তখন জেএসএস সমর্থিত চাকমা নেতৃত্বের একটি অংশ সোশ্যাল মিডিয়ায় কেএনএফের সমর্থনে কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করছে।

অথচ চাকমা নেতৃত্ব চাইলেই এই সমস্যার খুব সহজ সমাধান করতে পারত। এ কথা অনস্বীকার্য যে, শিক্ষাদীক্ষা কর্মসংস্থান অর্থনীতি ও জীবনযাপনে চাকমা জনগোষ্ঠী পাাহড়ে তো বটেই দেশের সমতলের গড় মানুষের থেকেও অনেকাংশে এগিয়ে রয়েছে। সেকারণে তারা চাইলে এসব ক্ষেত্রে সমতলের মানুষের সাথে প্রতিযোগিতা করেই সরকারি সকল সুবিধা নিশ্চিত করতে পারে। সেকারণে শান্তিচুক্তির মাধ্যমে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য যে সকল কোটা ও সুযোগ-সুবিধা বিশেষভাবে বরাদ্দ করেছে সে সকল সুযোগ সুবিধা তারা আর গ্রহণ না করে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রকৃত অনুন্নত ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীদের উন্নয়নের জন্য সমানুপাত করার জন্য ছেড়ে দেবে তাহলে তাদের এই মায়া কান্না সত্যি ও আন্তরিক বলে প্রমাণিত হতে পারে। আশা করি বৃন্দ যে এসএস নেতৃবৃন্দ বিষয়টি বিবেচনা করে দেখবেন।

আজকে যে চাকমা সার্কেল চিফের স্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রে আন্তর্জাতিক ফোরামে ‘stop persecution of Bawm civilians’ সাইনবোর্ড ধরে বম জনগোষ্ঠীর জন্য সহমর্মিতা দেখাচ্ছেন, কেএনএফ সদস্যরা যখন বাহিনী চালানোর জন্য রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচির সাধারণ ট্রাইবাল জনগোষ্ঠীর উপরে চাঁদাবাজি, নির্যাতন, পর্যটক অপহরণ, নির্মাণ শ্রমিক অপহরণ, রাস্তা কেটে দেয়া প্রভৃতি অপকর্ম করে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল তখন তাকে সিভিলিয়ানদের জন্য এভাবে সহমর্মী হতে দেখা যায়নি। কেএনএফ সদস্যদের গুলিতে পাঁচজন সেনা সদস্য নিহত এবং অনেকে আহত হলেও তিনি টু শব্দ করেননি। সেগুলো তার কাছে নিপীড়ন মনে হয়নি।

পরে তিনি একই সাথে তার ফেসবুক প্রোফাইলে বিতর্কিত সিএইচটি কমিশনের একটি বিবৃতি পোস্ট করে লিখেছেন, ‘Stop persecution of Bawm civilians. Calling for action against sponsored proxy conflicts in the CHT’. অর্থাৎ কেএনএফের সাথে যুদ্ধে সেনাবাহিনীর ৫জন সদস্য নিহত হওয়া ও আরো অনেক সদস্য আহত হওয়াকে তার কাছে মনে হয়েছে ‘sponsored proxy conflicts’. তার কাছে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করা যায় না।

১৬ এপ্রিল ২০২৪-এ সিএইচটি কমিশন-এর তিন কো-চেয়ার সুলতানা কামাল, এলসা স্ট্যামাটোপোলু এবং মিরনা কানিংহাম কাইনের স্বাক্ষরিত একটি প্রেস বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “কেএনএফ-এর কর্মকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায়, বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল এসএম শফিউদ্দিন আহমেদ গত ৭ এপ্রিল ২০২৪-এ বান্দরবান সফর করেন এবং কেএনএফ-এর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের ঘোষণা দেন। গণমাধ্যমের রিপোর্ট অনুসারে, গত ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত, কেএনএফ-এর বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর সময় মোট ৬২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে, গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে অনেকেই নিরপরাধ নাগরিক, যার মধ্যে বম সম্প্রদায়ের গর্ভবতী মহিলা, ছাত্র, শিক্ষক এবং সরকারি কর্মচারী রয়েছে। এছাড়াও রুমা, থানচি, রোয়াংছড়ি এবং চিম্বুকের জুম্ম বাসিন্দাদের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, যার মধ্যে তাদের চাল ক্রয়ের সর্বোচ্চ ৫ কিলো সীমা রয়েছে, যার লক্ষ্য কেএনএফ-এর সরবরাহ ব্যাহত করা। সিএইচটি কমিশন কিছু কেএনএফ সদস্যের কর্মকাণ্ডের কারণে সমগ্র বম সম্প্রদায়ের নির্বিচারে গ্রেপ্তার এবং সম্মিলিত শাস্তির তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং অবিলম্বে নিরীহ নাগরিকদের মুক্তি ও সুরক্ষা দাবি করেছে।”

বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, “বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন গত ১০ এপ্রিল একটি প্রেস বিবৃতিতে দাবি করেছে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তা বাহিনীর বর্ধিত উপস্থিতির ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য কেএনএফ-এর কার্যক্রম মঞ্চস্থ করা হয়েছিল। এমনও অভিযোগ উঠেছে যে, কেএনএফ গঠন একটি স্বার্থান্বেষী মহলের দ্বারা পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তি বজায় রাখার জন্য ‘ভাগ করো এবং শাসন করো’ নীতির অংশ। এছাড়া, পার্বত্য চট্টগ্রামে মারমা ন্যাশনালিস্ট পার্টি (এমএনপি) নামে পরিচিত একটি নবগঠিত সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিষয়ে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, যেটিকে কেএনএফের সৃষ্টিতে যারা মদদ দিয়েছে সেই একই স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী দ্বারা পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য এবং আদিবাসী গোষ্ঠীর মধ্যকার সম্প্রীতিকে অস্থিতিশীল করে পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিরতা সৃষ্টি করার জন্য এই স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর দ্বারা এই ধরনের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলিকে যে সহায়তা দেওয়া হয়েছে সে বিষয়ে সিএইচটি কমিশন বারবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

সিএইচটি কমিশন এইসব পরিস্থিতির জন্য গভীরভাবে উদ্বিগ্ন এবং বিশ্বাস করে যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের ২৫ বছর পরেও দীর্ঘায়িত অবাস্তবায়ন থেকে এসব উদ্ভূত হয়েছে। সরকার যত বেশি বিলম্ব করবে, পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি তত জটিল হবে। এই সমস্যাগুলি মোকাবেলা করার জন্য, কমিশন নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি জরুরী বাস্তবায়নের সুপারিশ করছে:

১. সরকারকে অবশ্যই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বাস্তবায়নকে দুর্বল করার জন্য কেএনএফ এবং এমএনপি-এর মতো সশস্ত্র সক্রিয় গোষ্ঠীগুলিকে পৃষ্ঠপোষকতাকারী স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীগুলিকে চিহ্নিত করতে হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

২. সরকারকে আর বিলম্ব না করে অবিলম্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন শুরু করতে হবে।

৩. নিরাপত্তা বাহিনীকে অবশ্যই বম বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত শাস্তি বন্ধ করতে হবে, মানবাধিকার লংঘন থামাতে হবে এবং অবিলম্বে নির্দোষ বেসামরিক নাগরিকদের মুক্তি দিতে হবে।

৪. কমিশন কেএনএফকে শান্তি কমিটির সাথে শান্তি আলোচনা পুনরায় শুরু করা, অপরাধমূলক কর্মকান্ড বন্ধ করা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি রক্ষার জন্য স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার আহ্বান জানায়।”

এই বিবৃতিতে সিএইচটি কমিশন তথ্য প্রমাণ ছাড়া বা কোনো প্রতিষ্ঠিত মিডিয়ার প্রকাশিত তথ্য উদ্ধৃত করা ছাড়া ছাত্র ইউনিয়ন নামের একটি সংগঠনের বিবৃতিকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করে কেএনএফের কার্যক্রম নিরাপত্তা বাহিনীর বর্ধিত কার্যক্রমকে ন্যায্যতা দেয়ার নাটক মঞ্চস্থ বলে আখ্যায়িত করেছে। বিবৃতিতে সংগঠনটি কেএনএফ সৃষ্টিকে স্বার্থান্বেষী মহলের ডিভাইড এন্ড রুল পলিসির অংশ বলেও কোট করা হয়েছে। এহেন সিএইচটি কমিশনের এই বিবৃতি নিয়ে আলোচনার পূর্বে আমরা এ সংগঠন সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা প্রয়োজন।

এরশাদ সরকারের সামরিক শাসনের দুর্বলতার সুযোগে ১৯৮৩ সাল থেকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার সুযোগ পায়। একের পর এক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে বিবৃতি দেয়া শুরু করে। ১৯৮৫ সালে ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও) পার্বত্য চট্টগ্রাম সফর করে একটি নেতিবাচক রিপোর্ট প্রদান করে। এরই প্রেক্ষাপটে ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী কোপেনহেগেনের ড্যানিস পার্লামেন্টের সভায় পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি আন্তর্জাতিক কমিশনকে স্বাগত জানানোর ঘোষণা দেয়। দশমাস পর আমস্টার্ডামে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপর একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে পরিস্থিতি তদন্তে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক কমিশন গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। ১৯৮৯ সালের শেষ নাগাদ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক আন্তর্জাতিক কমিশন গঠিত হয়। শুরুতে এই কমিটির কো-চেয়ারম্যান ছিলেন কানাডার আইনের অধ্যাপক স্যার ডগলাস স্যান্ডারস ও ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সহসভাপতি জার্মানির উইলফ্রিড টেলকেম্পার। এছাড়াও কমিটির অন্য সদস্যরা ছিলেন, অস্ট্রেলিয়ার রোজ মুরে, নরওয়ের লীফ ডানফিল্ড, গ্রীনল্যান্ডের হ্যান্স পাভিয়া রোজিং। কমিটি গঠনের লক্ষ্য হিসেবে বলা হয়, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বের পার্বত্য এলাকার মানবাধিকার ও ভূমি সংক্রান্ত অভিযোগ সরেজমিনে তদন্ত করা।

কিন্তু এ কমিটির গঠন, স্থান ও সদস্যদের তালিকা থেকে শুরুতেই বোঝা যায় বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কথা। বিষয়টি ভারত সরকারও অনুধাবন করতে পারায় কমিটি ১০ দিনের জন্য ত্রিপুরা সফরের অনুমতি চাইলে তাদেরকে ৫ দিনের জন্য অনুমতি দেয়া হয়। কমিটি ১৯৯০ সালের ২১-২৫ নভেম্বর ত্রিপুরাস্থ বাংলাদেশী উপজাতীয় শরণার্থী শিবির এবং একই বছরের ৮-২৯ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা সফর করে সেখানকার উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর সাথে কথা বলে এবং এ সময় তারা দোভাষী হিসেবে চাকমাদের সহায়তা নেয়। ত্রিপুরা সফরকালে ভারত সরকার কমিটির সাথে সার্বক্ষণিক তাদের লোক মারফত পর্যবেক্ষণ করে এবং তাদেকে কোনো টেপ রেকর্ডার ব্যবহার করতে দেয়নি। সফরে প্রাপ্ত তথ্য বলে দাবি করে এ কমিটি ১৯৯১ সালের ২৩ মে লন্ডনের হাউস অব লর্ডসে ‘Life is not ours : land human rights in the Chittagong hill tracts’ শিরোনামে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। পরবর্তীকালে এ কমিটি ১৯৯২, ১৯৯৪, ১৯৯৭ এবং ২০০০ সালে পরপর চারটি ফলোআপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। রিপোর্টে কমিটি পার্বত্য চট্টগ্রাম, বাঙালি, ইসলাম, সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ সরকার সম্পর্কে নানা মিথ্যা ও রাষ্ট্রবিরোধী তথ্য উপস্থাপন করে। রিপোর্টে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের মানবাধিকার লঙ্ঘন বিশেষ করে সন্ত্রাস, হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ভূমি দখল, গণধর্ষণ প্রভৃতির জন্য বাঙালি বিশেষ করে সেনাবাহিনীকে দায়ী করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগই মিশনারিদের তৎপরতায় নিজ ধর্ম ও সংস্কৃতি ছেড়ে খ্রিস্টান হয়ে গেলেও কমিটি তাদের রিপোর্টে উপজাতীয়দের জোরপূর্বক ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করে এবং নাম না জানা ৭ জন মারমার মুসলমান হওয়ার কথা প্রকাশ করে। তাদের মতে, গোটা পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে মসজিদ নির্মাণ অব্যহত থাকার দাবি করে বলে, মাইক্রোফোনে ভেসে আসা মসজিদের আজানের শব্দে কমিশনের কাজকর্ম অনেক সময় বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে।

২০০০ সালের পর থেকে দীর্ঘদিন চুপচাপ থাকার পর ২০০৮ সালের ৩১ মে-১ জুন ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে দুইদিন ব্যাপী এক সম্মেলনে নতুন করে সিএইচটি কমিশন গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত ১২ সদস্যের এই কমিশনের কো-চেয়ারম্যান হন ব্রিটিশ নাগরিক লর্ড এরিক এভাব্যুরি, বাংলাদেশের সুলতানা কামাল ও ডেনমার্কের ড. আইডা নেকোলাইসেন। লর্ড এরিক এবাব্যুরি ১৯৬২-১৯৭০ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এমপি এবং ১৯৭১ সাল থেকে ব্রিটিশ লর্ড সভার সদস্য রয়েছেন এবং বর্তমানে তিনি এই সভার সভাপতি। তিনি পূর্ব তিমুরকে (স্বাধীন বা আলাদা খ্রিস্টান রাষ্ট্র গঠন) বিষয়ক আন্তর্জাতিক কমিশনে কাজ করেছেন। পাশাপাশি বর্তমানে লর্ড এরিক এভাব্যুরি বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে জামায়াতে ইসলামের আন্তর্জাতিক প্রচার সেলের প্রধান হিসাবে কাজ করছেন। সমকামী সমর্থক লর্ড এরিক এভাব্যুরি ২০১৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ৮৭ বছর বয়সে মারা যান।

তার মৃত্যুর পর সংগঠনটি পুনর্গঠন করা হয়। বর্তমানের এ সংগঠনের কো-চেয়ার হিসেবে আছেন সুলতানা কামাল, এলসা স্ট্যামাটাপোলু এবং মারনা কানিংহাম। এ ছাড়াও বাংলাদেশ থেকে আরো রয়েছেন, ড. জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী ইয়াসমিন হক, খুশী কবির, ড. স্বপন আদনান।

পুনর্গঠিত কমিশন ২০০৮ সালের ৬-১৪ আগস্ট এবং ২০০৯ সালের ১৬-২২ ফেব্রুয়ারি পার্বত্য চট্টগ্রাম সফর করেন। সাজেক এলাকাটি এই কমিশনের কাছে সবসময়ই বিশেষ আগ্রহের ছিল। ২০০৮ সালের সফরকালে এ কমিশনের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ও বাঙালিদের কথা না শোনার কারণে তারা সুলতানা কামালকে অবরোধ করে। তার সামনে ঝাড়ু ও জুতা মিছিল করে। কয়েক ঘণ্টা পর পুলিশ তাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। কমিশনের বিরুদ্ধে বাঙালিদের অন্যতম অভিযোগ কমিশন পার্বত্য চট্টগ্রাম সফর করার পরপরই পাহাড়ে বড় ধরনের হিংসাত্মক ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে।

২০১০ সালের ১৭-১৮ ফেব্রুয়ারি এ কমিশন বাঘাইছড়ি সফর করে ও সেখানে রাত্রিযাপন করে। এর পরদিনই বিপুল সংখ্যক পাহাড়িদের ঘরে আগুন লাগে। এর দায় বাঙালিদের উপর চাপিয়ে পাহাড়িরাও বাঙালিদের ঘরে আগুন লাগায়, তাদের জায়গা-জমি দখল করে। শুরু হয় ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা- যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করে। বাংলাদেশ সরকার বিষয়টিতে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যায়। সেসময় সাজেকের চেয়ারম্যান লাল থাঙ্গা পাঙ্খো দৈনিক ইনকিলাবের জন্য আমাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান, চাকমারা নিজেরাই নিজেদের ঘরে আগুন লাগিয়ে বাঙালিদের দোষ দিচ্ছে। বাঙালিরা অভিযোগ করেছিল সিএইচটি কমিশনের গোপন উসকানিতে পাহাড়িরা এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করেছে।
২০০৮ সালে কমিশন তাদের পার্বত্য সফরকালে বাঙালিদের পাহাড় ছেড়ে সমতলে যাবার জন্য উদ্বুদ্ধ করে এবং এজন্য তাদের প্রয়োজনীয় সকল চাহিদা পূরণের প্রলোভন দেখায়। বাঙালিরা সেই প্রস্তাব প্রত্যাখান করলে ২০০৯ সালে কমিশন বাংলাদেশ সরকারের কাছে রিপোর্ট দেয় যে, বাঙালিদের পাহাড় থেকে সমতলের সরকারি খাস জমিতে ফিরিয়ে আনতে হবে এবং এর জন্য যত অর্থের প্রয়োজন ইইউ, ইউএনডিপিসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তা সহায়তা দিতে প্রস্তুত।

২০১০ সালে কমিশন বাংলাদেশ সরকারের কাছে দাবি জানায়, বাঙালিদের জোর করে পাহাড় থেকে উচ্ছেদ করতে হবে। তাদের রেশন বন্ধ করে দিতে হবে, গুচ্ছগ্রাম ভেঙে দিতে হবে। এছাড়াও কমিশন তাদের প্রত্যেক রিপোর্টে উল্লেখ করেছে, আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে পাওয়া অনুদান বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য এলাকার উপজাতিদের অধিকার হরণের কাজে ব্যবহার করছে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে। কাজেই যতদিন বাংলাদেশ সরকার তাদের নির্দেশিত সুপারিশ পার্বত্য চট্টগ্রামে বাস্তবায়ন না করবে ততদিন যেন তারা বাংলাদেশ সরকারকে সবধরনের সহায়তা প্রদান বন্ধ রাখে- এ মর্মেও কমিশন বিদেশি দাতা দেশ ও সংস্থার কাছে আবেদন জানিয়েছে। এভাবে সিএইচটি কমিশন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে।

সিএইচটি কমিশনের সকল রিপোর্টই একতরফা ও পক্ষপাতদুষ্ট। তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম সফরকালে একতরফা উপজাতিদের সাথে কথা বলে। কখনো কখনো বাঙালিদের সাথে কথা বললেও তা তাদের নির্বাচিত বাঙালি। যারা সন্তু লারমার উপকারভোগী। সে কারণে তাদের সেখানো বুলি মতে, তারা কমিশনের সামনে মত প্রকাশ করে, সরকার তাদের সমতলে পুনর্বাসন করতে চাইলে তাদের আপত্তি নেই। সিএইচটি কমিশন পাহাড়ে উপজাতি জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার নিয়ে শতশত পৃষ্ঠা রিপোর্ট করলেও তাতে বাঙালিদের প্রতি বৈষম্য, বঞ্চনা, নির্যাতনের কোনো কথা উঠে আসেনি।

সিএইচটি কমিশনের এহেন বাঙালি বিদ্বেষী ও একতরফা ভূমিকার কারণে পার্বত্য বাঙালিরা সব সময়ই এ সংগঠনের বিরুদ্ধে ছিলো। এ কারণে ২০১৪ সালের জুলাই মাসে কমিশন তিনদিনের পার্বত্য চট্টগ্রাম সফর কর্মসূচি ঘোষণা করলে পাহাড় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বাঙালি সংগঠনগুলো কমিশনের পার্বত্য সফর প্রতিহত করতে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করে। এঘটনায় প্রকাশিত রিপোর্টের কিছু অংশের প্রতি পাঠকদের দৃষ্টিপাত করা যেতে পারে। “গত ২-৫ জুলাই সিএইচটি কমিশনের এই সফর অনুষ্ঠিত হয়। কমিশনকে বিতর্কিত, পক্ষপাতদুষ্ট ও রাষ্ট্রবিরোধী সংগঠন আখ্যা দিয়ে এই সফরকালে ঘিরে ৬ বাঙালি সংগঠন তিন পার্বত্য জেলায় অবরোধ ডাকে। অবরোধের মধ্যেই সফর অব্যাহত রেখে ২ জুলাই কমিশনের কো-চেয়ারম্যান সুলতানা কামালের নেতৃত্বে ৬ সদস্যের টিম খাগড়াছড়ি গমন করে। খাগড়াছড়িতে রাত্রি যাপনের পর ৩ জুলাই প্রবল উত্তেজনা ও প্রশাসনের ডাকা ১৪৪ ধারা জারির মধ্যেই দিঘীনালায় বাবুছড়ায় ৫১ বিজিবি ব্যাটালিয়ন স্থাপনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট উত্তেজনা ও ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন। এসময় তারা স্থানীয় স্কুলে আশ্রয় নেয়া ক্ষতিগ্রস্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার দাবিদার ২১ পরিবারের সাথে কথা বলেন। এ সময় কমিশনের এক সদস্য পাহাড়িদের বলেন, ভয় পাবেন না। আমরা আপনাদের পাশে আছি। শক্ত হয়ে থাকতে হবে। স্থান ত্যাগ করবেন না।
দিঘীনালায় বিজিবি ক্যাম্প পরিদর্শনে সিএইচটি কমিশন

এরপর স্থানীয় প্রশাসনের সাথে কথা বলেন। এসময় বাবুছড়া বিজিবি জোন কর্মকর্তারা তাদের সকল পরিস্থিতি বুঝিয়ে বলেন, ‘যারা উচ্ছেদ হয়েছে বলে দাবি করছেন, বাস্তবিক অর্থে তারা বিজিবি ব্যাটালিয়ন স্থাপন প্রকল্প শুরু হওয়ায় ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আশায় ৩-৪ মাস আগে বসতি স্থাপন করেছিলেন।’ বিজিবি সদর দপ্তর স্থাপনের জন্য ২৯.৮১ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক সকল প্রকার সরকারি নিয়মনীতি অনুসরণ করে বিজিবিকে অধিগ্রহণকৃত ভূমি হস্তান্তর করেন। হস্তান্তরিত ভূমিতে বিজিবি’র স্বাভাবিক কার্যক্রম চলমান থাকা অবস্থায় গত ১০ জুন সকাল ১০টায় ভূমি নিয়ে গ্রামবাসীদের সাথে যে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে তা নিষ্পত্তি করার জন্য বিজিবি স্থানীয় জনপ্রতিনিদের সাথে মতবিনিময় সভা করে। মতবিনিময়ে আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এই সিদ্ধান্তকে বানচাল করার জন্য একটি বিশেষ মহলের প্ররোচনায় বিকেলে একদল মহিলা বিজিবির হেলিপ্যাডে কলাগাছ লাগাতে থাকে। তাদের বাধা দিলে পার্শ্ববর্তী কয়েকটি গ্রামের মহিলা ও যুবকরা দল বেঁধে এসে বিজিবি সদর দপ্তরে হামলা চালায় এবং বেশ কিছু স্থাপনা ভাঙচুর করে। হামলায় এক পুলিশ সদস্যসহ ৬ বিজিবি সদস্য আহত হয়। এ সময় কমিশন সদস্য ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্লটটি তো ভালোই সাজিয়েছেন কিন্তু বাস্তবে তা টিকবে না। এছাড়াও কমিশনের আরো কেউ কেউ বিজিবিকে অবজ্ঞাসূচক কথা বলেন। সিএইচটি কমিশনের কো-চেয়ারপার্সন এডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, বিজিবি সদর দপ্তরে পাহাড়ি মহিলারা হামলা করতে পারে তা বিশ্বাসযোগ্য নয়।

এদিকে দিঘীনালা পরিদর্শন শেষে কমিশন সদস্যরা বাঘাইছড়ি উপজেলার দুইটিলা এলাকা পরিদর্শন করেন। এসময় দায়িত্বপালনরত পুলিশ সদস্যরা সেখানে ১৪৪ ধারা জারি রয়েছে জানিয়ে কমিটির সাথে যাওয়া পাহাড়িদের সেখানে প্রবেশ করতে দিতে অস্বীকৃতি জানান। এসময় কমিশন সদস্যরা ১৪৪ ধারা জারির কারণ জানতে চাইলে পুলিশ সদস্যরা জানান, ফরেস্টের জমিতে অবৈধভাবে মন্দির নির্মাণ করতে গেলে তাদের বারণ করা হয়। তারা তা না শুনলে প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে। জবাবে কমিশন মন্তব্য করে, বনবিভাগের জায়গায় মসজিদ থাকতে পারলে মন্দির কেন থাকতে পারবে না। কমিশনের সদস্যরা খাগড়াছড়ি অবস্থানকালে দফায় দফায় পাহাড়ি নেতৃবৃন্দের সাথে বিভিন্নস্থানে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করতে থাকেন। কমিশনের এরূপ একতরফা আচরণ ও পক্ষপাতদুষ্ট বক্তব্যের কারণে স্থানীয় বাঙালি নেতৃবৃন্দ শঙ্কিত ও উত্তেজিত হয়ে আধঘণ্টার মধ্যে কমিশনকে খাগড়াছড়ি ছাড়ার আল্টিমেটাম দেন। অবশেষে আল্টিমেটাম শেষ হওয়ার আগেই কমিশন তার পূর্বনির্ধারিত রাঙ্গামাটি সফর বাতিল করে পুলিশ প্রহরায় খাগড়াছড়ি ত্যাগ করে। অবশ্য শহর ত্যাগের পথে বাঙালিরা কমিশনের গাড়িতে বৃষ্টির মতো জুতা নিক্ষেপ করে ঘৃণার প্রকাশ ঘটায়।

এদিকে কমিশনের রাঙ্গামাটি কর্মসূচি পরিত্যাগের ঘোষণা জানতে পেরে রাঙ্গামাটির বাঙালি সংগঠনগুলো তাদের অবরোধ তুলে নেয়। এখবর জানতে পেরে কমিশন গোপনে রাঙ্গামাটি প্রবেশ করে তাদের কর্মসূচি অব্যাহত রাখে। এতে করে রাঙ্গামাটির বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যেও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। তারাও কমিশনকে বাঙালি বিদ্বেষী আখ্যা দিয়ে রাঙ্গামাটি ত্যাগের জন্য প্রবল চাপ সৃষ্টি করে শহরে নতুন করে অবরোধ আরোপ করে। পরিস্থিতির চরম অবনতি হওযার আশঙ্কা করে স্থানীয় প্রশাসন কমিশন সদস্যদের রাঙ্গামাটি ত্যাগ করার জন্য অনুরোধ করলে তারা রাজি হন। দুপুরে পুলিশ প্রহরায় তারা রাঙ্গামাটি ত্যাগ করার পথে বিক্ষুব্ধ বাঙালিরা পাহাড়ের উপর থেকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে।

অতর্কিত এ হামলায় পুলিশ ও কমিশন সদস্যরা হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। স্থানীয় পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ ৪ কমিশন সদস্য এ ঘটনায় আহত হয়। তাদের বহনকারী গাড়িটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্থানীয়ভাবে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে কমিশনের সদস্যরা প্রশাসনের দেয়া গাড়িতে করে নিরাপত্তা প্রহরায় রাঙামাটি ত্যাগ করেন। এরপর কমিশনের তরফে চট্টগ্রাম শহরে সাংবাদিক সম্মেলনে দাবি করা হয় শান্তিচুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়ন না হওয়ায় এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। অবশ্য রাঙ্গামাটির অভিজ্ঞতা থেকে তারা তাদের বান্দরবান সফরসূচি ত্যাগ করে ঢাকায় ফিরে আসেন।”

এরপর ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে সিএইচটি কমিশনের সমন্বয়ক হানা শামস পরিচয় গোপন করে বিতর্কিত জমিতে রামজাদি বৌদ্ধ বিহার নির্মাণের ঘটনা তদন্তে বান্দরবান সফর করেন। এসময় তার সফরসঙ্গী হন জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা নাসরিন আক্তার। দিনভর নানা একপাক্ষিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করলে তার বান্দরবান অবস্থানের খবর প্রকাশিত হয়ে পড়ে। বাঙালি সংগঠনগুলো দফায় দফায় তাকে বান্দরবান ছাড়ার হুমকি দিলে তিনি একেরপর এক তার অবস্থান পরিবর্তন করেন। বিকেলে শৈলপ্রপাত পরিদর্শনে গেলে সন্ধ্যায় ফিরে আসার পথে শৈলপ্রপাত পরিদর্শন করে আসার পথে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে মিলনছড়ি পর্যটন স্পটের কাছাকাছি হাফেজঘোনা এলাকায় ১০/১২জনের একটি গ্রুপ অতর্কিত হানা শামসের বহনকারী গাড়িতে ইটপাটকেল ছুঁড়লে তারা গাড়ি থামাতে বাধ্য হয়। আক্রমণকারীরা এসময় তাকে উদ্দেশ্য করে জুতা নিক্ষেপ করে এবং তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে দ্রুত পালিয়ে যায়। তারা হাতে পায়ে ধরে হামলাকারীদের নিকট থেকে রক্ষা পায়। তবে পাহাড়ি রাতের অন্ধকারে ঘটনা ঘটায় কে বা কারা হামলা করেছে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি এবং কোনো পক্ষ থেকে হামলার দায়ও স্বীকার করা হয়নি।

২০১৪ সালের ওই ঘটনার পর সিএইচটি কমিশন আর কখনো পূর্ণাঙ্গ টিম নিয়ে পার্বত্য এলাকা সফর করার সাহস করেনি। তবে ঢাকা থেকে পাহাড়ের বিভিন্ন ইস্যুতে নিয়মিত বিবৃতি প্রকাশ করে গেছে। তবে ২০২২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর লামার রাবার বাগান ইস্যুকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট ঘটনা তদন্তে সিএইচটি কমিশনের একটি টিম কমিশনের পরিচয় না দিয়ে বান্দরবান ভ্রমণ কর্মসূচি ঘোষণা করলে বিষয়টি প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় বাঙালি সংগঠনগুলো তাদের প্রতিহত করতে কর্মসূচি ঘোষণা করে। এতে তারা বান্দরবানে প্রবেশ না করে চট্টগ্রামের লোহাগড়ায় একটি হোটেলে বসে স্থানীয় পাহাড়ী নেতাদের ডেকে কথা বলে চট্টগ্রাম ফিরে যায়।

পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো প্রতিনিয়ত যে হত্যা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, গুম, অপহরণ, ধর্ষণ বেপরোয়াভাবে চালিয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে এই কমিশনের কোনো বক্তব্য নেই। তারা শুধু বাংলাদেশ সরকার কতটুকু শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন করলো না তা নিয়ে সোচ্চার। কিন্তু সন্তুবাহিনীর সহস্রাধিক সদস্য এখনো অস্ত্র সারেন্ডার না করে হিংসা, হানাহানি ও অপরাধ বিস্তার কার্যক্রমে জড়িত রয়েছে তাদের বেলায় কমিশনের কোনো বক্তব্য নেই। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাবাহিনী ফিরিয়ে আনা তাদের অগ্রাধিকার তালিকার অন্যতম দাবি। ঐতিহাসিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রাচীন বাঙলার সমৃদ্ধ হরিকল রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। সে কারণে বাঙালিরাই এ অঞ্চলের প্রাচীন জনগোষ্ঠী। অথচ কমিশন উপজাতিদের তারা আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করে প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রনীতি রেখে বাকি সকল ক্ষমতা প্রদানসহ পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি ব্যাপক স্বায়ত্বশাসিত প্রদেশ বানাতে সুপারিশ করেছে। এসব কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালি সম্প্রদায় সিএইচটি কমিশনের প্রতি বিক্ষুদ্ধ।

বর্তমানে একটি অনিবন্ধিত অবৈধ সংগঠন। বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করার কোনো ম্যান্ডেট তাদের নেই। তাছাড়া বাংলাদেশের আইনে কোনো বেসরকারী সংগঠনের কমিশন গঠনের অনুমোদন দেয়া হয় না। এ কমিশনের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গের এহেন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে বাঙালি সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে সিএইচটি কমিশনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার দাবী জানিয়ে আসছে। তবে এ বিষয়ে সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
♦ লেখক: সম্পাদক, পার্বত্যনিউজ, চেয়ারম্যান, সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশন।

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.net
Website Design By Kidarkar It solutions