কুকি-চাকমা দ্বন্দ্বের ঐতিহাসিক ও বর্তমান প্রেক্ষাপট

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪
  • ৫০ দেখা হয়েছে

মেজর নাসিম হোসেন (অব.):- আমরা সাধারণ বাঙালি তো বটেই আমাদের বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, নিরাপত্তা-প্রশাসনিক কর্মকর্তারা পাহাড়ের মানুষ এবং তাদের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবন সম্পর্কে খুব বেশি খোঁজখবর রাখি না। আমি যদি ৭২-৭৩’ প্রেক্ষাপটকে ভিওি ধরি, তবে আমার এই বক্তব্যকে ভুল বলা যাবে না। সংবিধান রচনাকালে এর সাথে জড়িত বুদ্ধিজীবী ড. আনিসুজ্জামান নিজের বক্তব্যেই তা স্বীকার করেছেন, ‘আমাদের পাহাড়ে যারা আছেন তাদের কি নামে সম্বোধন বা চিহ্নিত করবেন এই প্রশ্ন তাদের মনে এসেছিলো। সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদের মতো খ্যাতিমান লোকও জানতেন না পাহাড়ে আর কোন কোন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী / উপজাতি বাস করে। (সূত্র : কার্পাস মহল থেকে শান্তি চুক্তি পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ইতিহাস। ড. আনন্দ বিকাশ চাকমা।)

আমরা সমতলবাসীরা (অধিকাংশ) গড়ে সকলকে চাকমা বলে ডাকি বা মনে করি।

বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবানে কুকি জনজাতির কথিত সংগঠন কেএনএফ পার্বত্য চট্টগ্রামের অতি ক্ষুদ্র এক জনজাতির সমস্যা বা সশস্ত্র তৎপরতা সাড়া দেশের মানুষকে উদ্বিগ্ন করে ফেলেছে। স্যোশাল মিডিয়ায় কমেন্ট বক্সে ‘কোথাকার কুকি ফুকি’ বলে বেকুব গোছের লোক তো বটে অনেক তাবৎ বড় পদধারীরাও এদের ‘চোর ডাকাত ছিনতাইকারী ‘ বলে সম্বোধন করছেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী (আমি সরকারি পদবীটি ব্যবহার করছি) র ‘চামাত্রি’দের (চাকমা-মারমা-ত্রিপুরা) সম্পর্কে এখন মোটামুটি সবাই জানে। কিন্তু বান্দরবান ভিত্তিক অপরাপর ছয়টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী – বম, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়ং, ম্রো ও খুমি, যারা সম্মিলিতভাবে কেএনএফের পতাকাতলে সংঘবদ্ধ বলে মনে করছি।

আমাদের কাছে চাকমা-কুকিরা এক গোত্রভুক্ত মনে হলেও এদের ভৌগোলিক বিস্তার, জীবনযাপন, ভাষা সংস্কৃতি র কারণে আলাদা আলাদা জাতি। তাদের উভয়ের ইতিহাসে আছে পারস্পরিক সংঘাত ও হানাহানির দীর্ঘ ইতিহাস। কুকিরা সাধারণত বাস করে দুর্গম ও সুউচ্চ পাহাড়ে এবং উঁচু খুঁটির উপর নির্মিত মাচাং বা টং ঘরে। এদের সামষ্টিক নাম ‘ট্যাংথা’। জুম চাষ এবং শিকারই এদের পেশা। এরা নদী বা লেক বা পানি এড়িয়ে চলে। প্রচন্ডভাবে আগ্রাসী ও হিংস্র জাতি। নিজের ভূখণ্ডে কারো অনুপ্রবেশকে তারা ভয়ংকর হিংস্রতায় প্রতিহত করে।

অপর দিকে চাকমারা সাধারণত নদী-খাল-বিলের অপেক্ষাকৃত সমতল ভূমিতে বাস করে, মাছ ধরা নৌকা চালনায় পটু। এরা ‘খ্যাংথা’ নামে পরিচিত। চাকমারা বৃটিশদের বশ্যতা মেনে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে চললেও কুকিরা তাদের ভূখণ্ডে বৃটিশদের এবং তাদের সাথে সমঝোতাকারী প্রজাদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত থেকেছে দীর্ঘদিন।

১৮৬০ সালে তারা তিপেরা বা ফেনী নদীর অববাহিকায় ব্যাপক নৃশংসতা চালায় চাকমা জনগোষ্ঠীর উপর। যা ইতিহাসের পাতায় গ্রেট কুকি ইনভেশান নামে পরিচিত। চাকমা জনজাতির সাথে ভূমি বিরোধ, বনাঞ্চলের অধিকার এবং বৃটিশরা চাকমাদের সহায়তা করছে এই ধারণার বশে ৪০০/৫০০ কুকির একটি দল চাকমা গ্রামগুলোতে আক্রমণ করে, ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। প্রায় ‘শ খানেক চাকমা নারী-শিশুকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। কুকিদের সাথে চাকমাদের এই অপদস্ত হওয়ার কাহিনী এখনো চাকমাদের গান, কবিতা, লোকগীতিতে প্রতিফলিত হয়ে আসছে এবং তা বংশ পরম্পরায় ওরাল হিস্ট্রি হিসাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রবাহিত হয়ে আসছে।

তবে চাকমা রাজবংশের আভ্যন্তরীন বিরোধে ভাড়াটে যোদ্ধা হিসাবে কুকিদের কদর ছিলো। চাকমা রানী কালিন্দীর শাসনামলে তার অধীনস্থ প্রভাবশালী দেওয়ান ত্রিলোক চন্দ্র চাকমা ও গিরিশ দেওয়ানের মধ্যে বিরোধে কুকিরা ত্রিলোক চন্দ্রের হয়ে যুদ্ধ করে ফলে গিরিশ দেওয়ান নিহত হয়।

একই রকম ঘটনা ঘটে মারমাদের মধ্যেও। তারাও কুকিদের ভাড়াটে যোদ্ধা হিসাবে ব্যবহার করে।

১৮৮৮-৮৯ সালে চিন-লুসাই এক্সপিডিশনের মাধ্যমে বৃটিশ সম্মিলিত বাহিনী কুকিদেরকে লুসাই পাহাড়ের দিকে ঠেলে দেয়। এর ফলে কুকিরা অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়ে। তারা চট্টগ্রামের বরকল, জুড়াছড়ি এসব এলাকা ছেড়ে চলে যায়। অল্প কিছু কুকি এখানে থেকে যায়। ধীরে ধীরে এসব এলাকায় চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর লোক এখানে প্রবেশ করে। সে কারণেই আজ কুকিরা এসব এলাকায় এদেরকে বহিরাগত বলে দাবি করে। কুকিদের মতে ওরাই এই এলাকার আদি বাসিন্দা। এখন তারা তাদের পিতৃভূমিতে ফিরতে চায়।

কুকিদের সাথে চাকমাদের বিরোধ আবার প্রকাশ পায় যখন মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট নেতা লালডেঙ্গা পার্বত্য চট্টগ্রামে ঘাঁটি গেঁড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শুরু করে। আজকের সাজেক এলাকায় তাদের অনেক ঘাঁটি ছিলো। মিজোরা পাকিস্তান ও চীনের কাছ থেকে অস্ত্র সহায়তা পেত। মিজোদের এ পাড়ে ঘাঁটি করায় চাকমাদের সাথে প্রায়ই সংঘর্ষ হতো। মিজোরা চাকমা গ্রামে হামলা করতো রসদ সংগ্রহের জন্য। ১৯৭২ সালে ভারতীয় বাহিনী রাঙামাটিতে প্রবেশ করে মিজো দমনের জন্য। চাকমারা এসময় ভারতীয় বাহিনীকে স্বাগত জানায়।

শান্তি বাহিনীর সাথে মিজোদের অনেক বার সংঘর্ষ হয়েছে। মিজোরা (এমএনএফ) শান্তি বাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করতে এলে শান্তি বাহিনী প্রতিহত করেছে।

মিজো-কুকি-চিন এই তিন মঙ্গোলীয় জাতি একত্রে ‘জো’ জাতি নামে পরিচিত। যারা ভারত মায়ানমার ও বাংলাদেশে বিস্তৃত। জাতিসংঘ ২০০০ সালে আদিবাসী দশক ঘোষণা করে। গঠন করে ‘ United Nations Forum for Indigenous Issues’। জাতিসংঘ আদিবাসী দশক ঘোষণার সাথে সাথে আদিবাসীদের সুরক্ষার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপের কথা বলে। তার ফলে ‘জো’ জাতির মধ্যে তাদের স্বপ্নের ‘জালেন গাম’ ( হোম অফ ফ্রিডম) ধারণা উজ্জীবিত হয়। এটা নাগাদের স্বাধীন ভূমি ‘নাগালিম’, চাকমাদের কল্প রাজ্য চম্পকনগর বা ‘জুম্মা ল্যান্ডের’ মতো নিজস্ব পৈত্রিক ভূমির ধারণা।

বর্তমানে চাকমা ও কুকিদের মনের গহীন কোনে লুকিয়ে রাখা আছে সেই স্বপ্ন। চাকমাদের সাথে সীমানাগত কারণ, সম্পদের উপর অধিকার এক্ষেত্রে সংরক্ষিত বনাঞ্চল এবং বৃটিশদের ঔপনিবেশিক নীতির কারণে, যা চাকমাদের অধিক সুবিধা দিয়েছে বলে কুকিরা মনে করতো, এখনো কুকিরা পার্বত্য চট্টগ্রামের ৯টি উপজেলাকে নিজেদের অধিকারভুক্ত বলে মনে করে এবং পার্বত্য শান্তি চুক্তির মাধ্যমে তা চাকমাদের হাতে সরকার তুলে দিয়েছে বলে তারা অভিযোগ করে। এখানেও পূর্বতন বৃটিশ সরকারের মতো বাংলাদেশের সরকারও তাদের প্রতি অন্যায় করেছে বলে কুকিরা দাবি করে।

কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে অভিজাত এবং অগ্রসর চাকমা শ্রেণি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরবর্তী সময়ে তারা সশস্ত্র আন্দোলনের জন্য এটিকে তারা বড় কারণ হিসাবে সফলভাবে তুলে ধরে। কিন্তু বাস্তবে এই প্রকল্পের কারণে আদি বাঙালি বলে পরিচিত বসতিকারী বাঙালিদের কথা যেমন জানা যায় না, তেমনি হাইল্যান্ডার নামে খ্যাত বান্দরবানের কুকিরা তেমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি বলেই তাদের ক্ষোভের মাত্রা চাকমাদের মতো ছিলো না সশস্ত্র সংগ্রামের শুরুতে। সে কারণে শান্তি বাহিনীর ১৫ সদস্যের কমিটিতে কুকি জনগোষ্ঠীর কাউকে কোনো নেতৃত্বের অবস্থানে দেখা য়ায়নি। মূলত জেএসএস এবং তার সশস্ত্র শাখা শান্তি বাহিনীর নেতৃত্ব চাকমাদের হাতেই ছিলো বরাবর। ‘পদ সৈনিক’ হিসাবেও এই কুকিরা ছিলো বরাবর উপেক্ষিত। বান্দরবানে মুরং বাহিনী বলে ভিডিপির সদস্য হিসাবে তারা তাদের নিজস্ব পাড়া পাহারা দিয়েছে। এখানে শান্তি বাহিনীর প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিলো। তাই দেখা গেছে, চুক্তির পরে তারা আগের মতোই উপেক্ষিত রয়ে গেছে। জেলা পরিষদসহ অন্যান্য জায়গায় তাদের উপস্থিতি মোটেই শক্তিশালী নয়।

বর্তমান চুক্তির কাঠামোতে আগামী একশত বছরেও কোনো কুকি জনগোষ্ঠীর কেউ আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান হতে পারবে না। সন্তু লারমার গত ২৫ বছর ধরে আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের পদ ধরে রাখা সে ইঙ্গিতই দেয়। কুকিদের অভিযোগ, ‘চুক্তি বাস্তবায়ন হয়নি মুই হিচ্ছু দেবার ন পারি’ এরকম সান্তনা বাক্য শুনে তারা হতাশ। চাকরি শিক্ষার সব কোটা এককভাবে ‘চামাত্রি’রা ভোগ করছে। বঞ্ছনার পালা বদল ঘটেছে। গত ২৫ বছর ধরে নানাভাবে কুকিরা পিছিয়ে আছে। আর এমন সময়ে তাদের কাছে যদি সীমান্তের ওপার থেকে কেউ আওয়াজ তুলে ‘কুণ্ঠে আছো বাহে’ তবে তো তা স্বপ্নের জালেন গামে প্রতিধ্বনিত হবেই। তবে এই ক্ষেত্রে প্রকৃত অর্থে কী ঘটেছে তা নাথান বমই বলতে পারবে।

এ যেন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি: ১৯৭৩ সালে খসড়া সংবিধানের উপর আলোচনাকালে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার আকুতি কেউ আমলে নেয়নি। তিনি সংসদ থেকে ওয়াক আউট করলে ক্ষুদ্র ‘তোরা কয়জন’ বলে কেউ তাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টাও করেনি। আজ পনের হাজারী বম জনগোষ্ঠীর এমএন লারমারূপী নাথানকেও ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেনি জেএসএস নেতৃবৃন্দ।

ভারতে ২০০টি নৃগোষ্ঠী আছে। তাদের প্রত্যেকের আছে নিজস্ব আলাদা ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও জীবনবোধ। তারা নিজেদের পরিচয়বাদী ইমেজ নিয়ে দারুণ সচেতন। এই স্বাতন্ত্র্যবোধই তাদেরকে আলাদা করে রেখেছে সমতলের মানুষ থেকে যেমনি, তেমননি অন্য পাহাড়ি জনজাতি থেকেও।

এই বিরোধকে আরো তীব্র করেছে বৃটিশদের শাসন ব্যবস্থা। ভারতে বৃটিশরা দুটো বর্গে নেটিভদের ভাগ করেছে : সভ্য ও অসভ্য, অগ্রসর অনগ্রসর গোত্রে। ভারত এবং পার্বত্য চট্টগ্রামকে এক্সক্লুডেড এরিয়া বা শাসন বহির্ভূত এলাকা হিসাবে আলাদা শাসন পদ্ধতিতে শাসন করেছে। দুর্ধর্ষ কুকি উপজাতি, যারা বৃটিশদের হাতে বশ্যতা স্বীকার করেনি, তাদের দমনের জন্য স্থানীয় চাকমাদের সহায়তা নিয়েছে। চীন লুসাই এক্সপিডিশনের সময় চাকমা রাজা হরিশ্চন্দ্র তার সৈন্য দিয়ে সাহায্য করে। বিনিময়ে বৃটিশরা চাকমা নৃপতি হরিশচন্দ্রকে ‘রায় বাহাদুর’ উপাধি ও মূল্যবান ঘড়ি উপহার দেয়।

কুকিদের হাতে চাকমাদের নির্যাতনের ইতিহাস চাকমা মনে এখানো জ্বলজ্বল করে। পক্ষান্তরে কুকিরাও ভুলে যায়নি লুসাই হিলের পশ্চিমে তাদের ফেলে যাওয়া বাস্তুভিটার কথা। তারাও হয়তো স্বপ্ন দেখছে চিন মিজোরামের জ্ঞাতি ভাইদের নিয়ে ‘জালেন গামের’ ( Home of Freedom). চাকমারা পুরান গল্প লোকগাথায় বর্ণিত ‘চম্পক নগর’ বা জুম্মা ল্যান্ডের। আর সেই ‘জো’ জাতি আর ‘জুম্মা’ জাতীয়তাবোধের তরঙ্গের ঝড় বয়ে যাচ্ছে বান্দরবান জুড়ে। (১৯-০৪-২০২৪.)

লেখক: পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সামরিক বিশ্লেষক

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.net
Website Design By Kidarkar It solutions