ডেস্ক রির্পোট:- বেসরকারি খাতের ১০৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্ক, কর ও ভ্যাট পাওনা ১ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকা। এনবিআর সূত্রে এ কথা জানা যায়।
আরও জানা যায়, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রাজস্ব পরিশোধের তথ্য খতিয়ে দেখতে ১৪ সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। এ টাস্কফোর্সে ভ্যাট, আয়কর ও শুল্ক শাখা, ভ্যাট নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর, শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এবং এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা শাখা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেলের (সিআইসি) কর্মকর্তারা আছেন।
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্যানুসারে, সারা দেশে সরকারি খাতের ১১৬টি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১২৩টি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল আছে। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই টাস্কফোর্সের কর্মকর্তারা পর্যায়ক্রমে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আয়, ব্যয়, কর-শুল্ক-ভ্যাট পরিশোধের তথ্য খতিয়ে দেখেন। বিশেষভাবে ব্যাংক লেনদেনের তথ্য, শিক্ষার্থী ভর্তির পরিমাণ এবং এ খাতে আদায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপকরণ কেনা, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজনের আয়-ব্যয় বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখা হয়।
সব তথ্য-প্রমাণ যাচাই-বাছাই করে মোট ১০৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রাজস্ব পরিশোধের তথ্যে গরমিল পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৪৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৫৯টি ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল রয়েছে। গত ৩ মার্চ ৪১টি এবং ৩১ মার্চ ২৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এনবিআর থেকে চিঠি পাঠিয়ে বকেয়া রাজস্ব পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। চলতি সপ্তাহে বাকি ৩৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চিঠি পাঠানো হবে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ১৫ কর্মদিবস সময় দেওয়া হয়েছে। বেঁধে দেওয়া সময়ে রাজস্ব পরিশোধ না করায় এবং রাজস্ব কেন পরিশোধ করেনি তার সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে না পারায় সম্প্রতি দেশের আট নামিদামি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে।
এ আটটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক, ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি ও সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি।
এনবিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এনবিআরের কাছে দাখিল করা তথ্য প্রমাণ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, শিক্ষার্থী ভর্তির তথ্যে মিথ্যা হিসাব দেওয়া হয়েছে। রেজিস্ট্রারে শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা ও ভর্তি ফির ক্ষেত্রে যে হিসাব দেওয়া হয়েছে, ব্যাংক লেনদেনে তার চেয়ে বেশি। আবার বিভিন্ন উপকরণ কেনা, সেমিনার, শিক্ষামূলক কার্যক্রম আয়োজন, প্রশিক্ষণ, বেতন-ভাতাসহ সব ক্ষেত্রেই এনবিআরে দাখিল করা হিসাবের সঙ্গে ব্যাংক লেনদেনের মিল নেই। বিনা বেতনে অনেক শিক্ষার্থীকে পড়ানো হচ্ছে এমন তথ্য দেওয়া হলেও তা সঠিক নয়। স্কলারশিপের তথ্যেও রয়েছে গরমিল। শুধু তাই নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ ব্যয়েও মিথ্যা হিসাব দেওয়া হয়েছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, একসময়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ধনী পরিবারের সন্তান হলেও এখন আর তা না। অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান সরকারিতে ভর্তির সুযোগ না পেয়ে বেসরকারিতে বাধ্য হয়ে ভর্তি হন। এদের অনেকে জমিজমা এবং বাবা-মায়ের শেষ সঞ্চয় দিয়েও ভর্তি হন। এসব শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ভর্তি ফি হিসেবে মোটা অঙ্ক আদায় করেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ ক্ষেত্রে এনবিআরকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকরা ক্ষমতাবান। তাই কোনো তদবির বা সুপারিশে রাজস্ব মাফ করা উচিত হবে না। দু-একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আদায় করা সম্ভব হলে অন্যরাও ঠিকমতো পরিশোধ করবে।
এনবিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘আয়কর আইন-২০২৩-এর ২১৪ ধারা অনুসারে গত ৪ মার্চ কর অঞ্চল-১১ থেকে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির রেজিস্ট্রার বরাবর চিঠি পাঠিয়ে ২০০২-০৩ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত মোট ১৬ অর্থবছরে ১৮০ কোটি ৫০ লাখ ৯৪ হাজার ৫৬৪ টাকা রাজস্ব পাওনা দাবি করা হয়। চিঠিতে এ অর্থ ১৫ মার্চের মধ্যে পরিশোধের জন্য সময় বেঁধে দেওয়া হয় এবং সময়মতো রাজস্ব পরিশোধ না করলে ২০২৩-এর ২৭৫ ধারা অনুযায়ী জরিমানা আরোপসহ অন্যান্য আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানানো হয়।’
এ বিষয়ে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘এনবিআর থেকে চিঠি পাঠিয়ে রাজস্ব পাওনার কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে আরও বলা হয়েছে, কোনো ধরনের রাজস্ববিষয়ক মামলা থাকলে তা এনবিআরকে জানাতে হবে। আমরা ১৪ মার্চ জানিয়েছি। অথচ তারপরও আমাদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। এতে ঈদের আগে আমাদের লেনদেনে সমস্যা হচ্ছে। বিষয়টি এখনো সুপ্রিম কোর্টে প্রক্রিয়াধীন, তাই আমরা আইনজীবীকে জানিয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এনবিআরের রাজস্ব পরিশোধসংক্রান্ত হিসাবের সঙ্গে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একমত নই। আমাদের আইনজীবী বলেছেন ২০১০ সালের পর থেকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আমাদের কাছে যে পরিমাণ রাজস্ব দাবি করা হয়েছে, প্রকৃত হিসাব তা নয়।’
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ফকরুল আলম বলেন, ২০১০ সালের ১ জুলাই এনবিআর প্রজ্ঞাপন জারি করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর ১৫ শতাংশ কর নির্ধারণ করে। এই কর আদালতের রায়ে স্থগিত হয়। আবারও গত ২৭ ফেব্রুয়ারি এই কর কার্যকর করা হয়।
তদন্ত প্রতিবদনে বলা হয়েছে, রাজস্ব পাওনা আছে এমন সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকদের ব্যক্তিগত আয়কর নথি খতিয়ে দেখা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি তারা আর কী ব্যবসা করছেন, সেসব ব্যবসায়ে হিসাবমতো কর, শুল্ক, ভ্যাট পরিশোধ করেছে কি না, তা গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিআইসির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকরা সমাজের সম্পদশালী ব্যক্তি। এদের প্রতিষ্ঠান থেকে যেমন রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয় তেমনি নিজেরাও প্রভাব খাটিয়ে ঠিকমতো রাজস্ব পরিশোধ করেন না। এদের চিহ্নিত করতে কাজ করা হবে। খবরের কাগজ