সাক্ষী তিওয়ারি :- চীন নৌ ঘাঁটি নির্মাণের মাধ্যমে বাংলাদেশ এবং কম্বোডিয়ায় তার প্রভাব বিস্তার করার বিষয়টি অস্বীকার করে আসছে, তবে এই পদক্ষেপগুলো নয়াদিল্লি এবং ওয়াশিংটনে সতর্কতার সাথে দেখা হচ্ছে। কম্বোডিয়া (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া) এবং বাংলাদেশে (দক্ষিণ এশিয়া) নৌ ঘাঁটি নির্মাণে চীনের সহায়তাকে বেইজিং এবং অংশীদার দেশগুলো একটি আপাত ‘নিরীহ প্রকল্প’ হিসাবে দেখলেও এটি উভয় অঞ্চলে গুরুতর নিরাপত্তা উদ্বেগ তৈরি করেছে। কয়েক বছর ধরেই সামরিক বিশ্লেষকরা বিষয়টি নিয়ে সতর্ক করছেন। তাদের দাবি, বেইজিং তার প্রভাব বিস্তার করতে এবং আঞ্চলিক শক্তি ও বৈশ্বিক পরাশক্তিকে চ্যালেঞ্জ করতে বিশ্বব্যাপী সামরিক ফাঁড়িগুলোর একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করার পরিকল্পনা করছে।
কম্বোডিয়ার রিম নৌ-ঘাঁটির ওপর বিশেষ করে নজর রাখা হচ্ছে । ইতিমধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উদ্বেগ উত্থাপন করেছে এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের প্রথম সামরিক সুবিধা হিসাবে রিমের কথিত বিকাশের বিষয়ে সতর্কতা জারি করেছে। যদিও কম্বোডিয়া পিপলস লিবারেশন আর্মিকে প্রবেশাধিকার দেয়ার কোনও পরিকল্পনার কথা অস্বীকার করেছে। দুই পক্ষের মধ্যে সহযোগিতা তলে তলে এগোচ্ছে । নিক্কেই এশিয়ার রিপোর্ট মোতাবেক, ঘাঁটিতে সম্প্রতি কমপক্ষে দুটি যুদ্ধজাহাজের উপস্থিতির কথা সামনে এসেছে, এটি এখন ব্যাপকভাবে স্বীকৃত যে চীনা সামরিক বাহিনী কম্বোডিয়ার রিম নৌ ঘাঁটিতে অ্যাক্সেস অব্যাহত রেখেছে।
গত বছর ডিসেম্বরের গোড়ার দিকে চীনা জাহাজগুলো প্রথমে এই নৌ ঘাঁটিতে নোঙর করে। প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে, ২০ মার্চের দৃশ্যকল্পটি আমেরিকান উদ্বেগের সাথে মিলে যায় যে চীন তার একচেটিয়া ব্যবহারের জন্য সাইটে নিজের সুবিধার পথ প্রশস্ত করছে । নিক্কেই এর প্রাপ্ত ছবিতে চীনা নৌবাহিনীর কর্ভেট ওয়েনশান হিসাবে চিহ্নিত দুটি জাহাজের মধ্যে একটিতে চীনের পাশাপাশি চীনা সামরিক নৌবাহিনীর পতাকা দেখা যাচ্ছে।
ডিসেম্বরে যখন চীনা জাহাজগুলো প্রথম ঘাঁটি পরিদর্শন করেছিল, তখন কম্বোডিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী টি সিহা স্পষ্ট করেছিলেন যে এটি একটি রুটিন সফর ছিল। যুদ্ধজাহাজগুলো জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত ঘাঁটিতে উপস্থিত ছিল।
সেই সময়ে, সিঙ্গাপুরের এস. রাজারত্নম স্কুল অফ ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (আরএসআইএস)-এর রিসার্চ ফেলো কলিন কোহ বলেছিলেন, “এটি একটি সংকেত যে রিম- এর কাজ সম্পূর্ণ হতে চলেছে৷ যদিও তারা বলছে এটি নির্মাণের কাজ চলছে, তবে অন্তত এখন এটি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যাতে বিদেশী নৌবাহিনীর জাহাজকে নোঙর করতে পারে।”
কম্বোডিয়ান নৌবাহিনী ঐতিহ্যগতভাবে দক্ষিণ চীন সাগর এবং অন্যান্য অঞ্চলে প্রবেশের জন্য থাইল্যান্ড উপসাগরের প্রবেশদ্বারের কাছাকাছি কৌশলগতভাবে অবস্থানরত রিম নৌ-ঘাঁটিকে ব্যবহার করে। এটি পশ্চিমে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছিল যে চীনা সমর্থনে ঘাঁটি সম্প্রসারণের ফলে এটি অবশেষে চীনা নৌবাহিনীর আউটপোস্টে পরিণত হতে পারে।
বেইজিং কম্বোডিয়ায় বেস আপগ্রেডের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করছে। এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে একজন প্রাক্তন মার্কিন নৌবাহিনীর সাবমেরিনার এবং প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক টম শুগার্ট ২১ ফেব্রুয়ারিতে প্ল্যানেট ল্যাবস থেকে প্রাপ্ত স্যাটেলাইট চিত্রগুলো প্রকাশ করেছিলেন। ছবিগুলো কম্বোডিয়ার রিমে তার নতুন ঘাঁটি তৈরিতে চীনের অগ্রগতির একটি ব্যাপক আপডেট প্রদান করে। ছবিগুলো ছিল ২০২৩ সালের ১৫ জানুয়ারি তারিখের। যদিও রিম নৌ ঘাঁটি জাপান বা ফিলিপাইনের ঘাঁটির মতো বড় নয়, তবে সামরিক পর্যবেক্ষকদের মতে এটি বেশ কয়েকটি বড় চীনা নৌবাহিনীর জাহাজকে নোঙ্গর করার ক্ষমতা রাখে। রিম নৌ ঘাঁটিতে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা বেইজিংয়ের অতি গুরুত্বপূর্ণ মালাক্কা স্ট্রেইট শিপিং লেনগুলিতে নৌ অভিযানকে শক্তিশালী করবে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার আঞ্চলিক মিত্রদের মধ্যে সংঘর্ষের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হিসাবে কাজ করবে বলে মনে করা হয় ।
ঘাঁটি এবং লজিস্টিক সহায়তার একটি বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্কের অনুপস্থিতি চীনের বিশাল নৌবহরকে সীমিত করে। সুতরাং, এই সুবিধাগুলো স্থাপন করে একটি সম্পূর্ণরূপে কার্যকরী ব্লু-ওয়াটার নৌবাহিনী গঠন করা বেইজিংয়ের লক্ষ্য। এর মাধ্যমে, বেইজিং সমগ্র ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এবং তার বাইরেও তার নৌশক্তিকে আরও ভালভাবে প্রজেক্ট করতে পারে। আন্তর্জাতিক জলসীমায় অপারেশন পরিচালনা সহজ করে তোলে। যদিও রিম চীনাদের দ্বারা নির্মিত নৌ ঘাঁটি হিসেবে বেশ কয়েক বছর ধরে স্ক্যানারে রয়েছে। এর পাশাপাশি চীনাদের দ্বারা নির্মিত আরেকটি নৌ ঘাঁটি এখন এমন একটি সুবিধায় রূপান্তরিত হওয়ার পথে রয়েছে যা চীনের নৌ ক্রিয়াকলাপকে সহজতর করে তোলে। সেই ঘাঁটি দক্ষিণ এশিয়ার দেশ বাংলাদেশে অবস্থিত।
বাংলাদেশের সাবমেরিন ঘাঁটি চীনের দখলে
একজন প্রখ্যাত OSINT বিশ্লেষক ড্যামিয়েন সাইমন গত ৩১ মার্চ চীনা সহায়তায় নির্মিত বাংলাদেশের সাবমেরিন ঘাঁটির স্যাটেলাইট চিত্র প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশে চীন-নির্মিত সাবমেরিন ঘাঁটির যে চিত্র সামনে এসেছে সেখানে সাইটে সাবমেরিন রক্ষণাবেক্ষণে সহায়তাকারী একটি শুষ্ক ডক দেখা যাচ্ছে । সাম্প্রতিক চিত্রগুলোতে যে শুকনো ডক দেখা গেছে সেখানে সাবমেরিন মেরামত করা হয়। ডকের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৩৫ মিটার এবং প্রস্থ প্রায় ৩০ মিটার বলে অনুমান করা হয়েছে। ছবিটি এক্সে পোস্ট করার সাথে সাথেই, এটি ভারতীয় নেটিজেনদের মধ্যে একটি আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। কেউ কেউ চিন্তা করতে শুরু করেছে যে চীনারা তার সাবমেরিন অপারেশনের জন্য এই ঘাঁটি ব্যবহার করবে কিনা। গত বছরের ডিসেম্বরে প্রকাশিত ঘাঁটির স্যাটেলাইট চিত্রগুলো প্রস্তাব করে, চীন নৌ ঘাঁটিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে এবং ঘাঁটির আকার ইঙ্গিত দেয় যে, পিএলএ-নৌবাহিনী শিগগিরই ঘাঁটিতে ‘লজিস্টিক অ্যাক্সেস’ শুরু করবে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে, চীনা সাবমেরিনগুলো সংস্কার ও পরিষেবার জন্য বাংলাদেশ বন্দরে ডক করতে পারে। বিশেষজ্ঞরা এটিকে চীনের ‘সাবমেরিন কূটনীতি’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। বাংলাদেশে নির্মাণাধীন নৌ ঘাঁটির স্যাটেলাইট চিত্রের পূর্ববর্তী বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে, ‘পিএলএর বঙ্গোপসাগরে পা রাখা চীনের উপকূল থেকে আরও দূরে কাজ করার এবং ভারতের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবে।’
ফোর্সেস গোল ২০৩০- এর অধীনে তার সামরিক আধুনিকীকরণ প্রচেষ্টার অংশ হিসাবে, বাংলাদেশ ২০১৩ সালে চীন থেকে মাত্র ২০৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে তার প্রথম দুটি সাবমেরিন অর্ডার করেছিল। সাবমেরিনগুলো দেশে পৌঁছে দেয়ার এক বছর পরে, পলি টেকনোলজিস, চীনভিত্তিক রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিরক্ষা সংস্থা, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে একটি নতুন সাবমেরিন সাপোর্ট স্টেশন নির্মাণের জন্য ১.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি চুক্তিতে পৌঁছেছে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে নামকরণ করা ১.৭৫ বর্গকিলোমিটার ঘাঁটিটি বিএনএস শেখ হাসিনা নৌ ঘাঁটি নামে পরিচিত। প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ২০২৩ সালের মার্চে উদ্বোধনের সময় বেসটিকে ‘অতি-আধুনিক’ হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন। অনুষ্ঠানে পিএলএ-এনের অন্তত দুজন সিনিয়র কর্মকর্তাসহ বেশ কয়েকজন চীনা কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই সেখানে চীন নির্মিত সাবমেরিন মোতায়েন করেছে বলে প্রমাণ রয়েছে। একবার সম্পূর্ণ হলে, ঘাঁটিটি একসাথে ছয়টি সাবমেরিন এবং আটটি যুদ্ধজাহাজ ডক করতে সক্ষম হবে। যা ভারতের নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগজনক হতে পারে।
মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতর এর আগেও সতর্ক করেছিল যে, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয়ই তাদের সন্দেহের তালিকায় রয়েছে যেখানে বেইজিং বিদেশী সামরিক স্থাপনা স্থাপনের চেষ্টা করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও উল্লেখ করেছিলেন যে, সুবিধাটি ‘বঙ্গোপসাগরে জাহাজ চলাচলের জন্য একটি পরিষেবা পয়েন্ট’ হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে – এটি একটি সম্ভাব্য সংকেত যে চীনা সামরিক বাহিনী একদিন এটিকে বন্দর হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। যদিও চূড়ান্ত মূল্যায়নে পৌঁছাতে আরো কিছু বিশদ বিবরণ প্রয়োজন, তবে বিশেষজ্ঞরা চিন্তিত যে চীন আপাত নিরীহ নৌ সুবিধা নির্মাণের আড়ালে তাদের সামরিক ক্ষেত্রকে প্রসারিত করছে।
সূত্র : ইউরেশিয়ান টাইমস
(লেখক : সাক্ষী তিওয়ারি। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যাস কমিউনিকেশন থেকে সাংবাদিকতা অধ্যয়ন করেছেন এবং প্রতিরক্ষা ও জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন)