বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর বিদেশে সম্পদের পাহাড়

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪
  • ১৫২ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- তানজিম আশরাফুল হক। পোশাক ব্র্যান্ড তানজিম ও এক্সটেসির কর্ণধার। পোশাকের খুচরা ব্যবসা করে মাত্র কয়েক বছরে শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক বনে গেছেন। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশের মাটিতে গড়েছেন মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের সম্পদ। দুবাই, লেবানন, দ্বীপরাষ্ট্র সেন্ট কিটস ও যুক্তরাষ্ট্রে কিনেছেন একাধিক অ্যাপার্টমেন্ট, রিসোর্ট, দোকান, হোটেল। দুবাইয়ের নামিদামি সব শপিং মলে রয়েছে একাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। খুলেছেন তানজিম আনটোল্ড, তানজিম স্কোয়াড নামে ৫টি আউটলেট। নিজ দোকানের ব্র্যান্ডিং করতে পৃথিবীর বড় বড় ডিজে ও পপ তারকাদের এনে মিউজিক শো আয়োজন করেন। পোশাকের মডেলও বানান তাদের। দেশ ছেড়ে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের অভিজাত এলাকা দুবাই মেরিনাতে।

সেখানে আল-সাহাব টাওয়ার ও বিউপোর্ট টাওয়ারে কিনেছেন ৪টি অ্যাপার্টমেন্ট। পরিবারসহ নিয়েছেন ক্যারিবিয়ান দেশ সেন্ট কিটস অ্যান্ড নাভাসের নাগরিকত্ব। এই নাগরিকত্ব নিতে খরচ করতে হয়েছে ৩ লাখ ডলার। জানা গেছে, ওই দেশে বিনিয়োগ করেই তানজিম হক এই নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন। এছাড়া সেন্ট কিটসের রাজধানী বাসেতেরের সমুদ্র পাড়ে রয়েছে নিজম্ব একটি ৪ তারকা হোটেলও। এই দেশেও কিনেছেন একাধিক অ্যাপার্টমেন্ট। সময়ে- অসময়ে পরিবার নিয়ে ছুটে যান সেন্ট কিটসে। অবকাশ সময় কাটান নিজের রিসোর্টেই।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সংযুক্ত আরব আমিরাতের পারস্য উপসাগরের পাড় ঘেঁষা দুবাই মারসা অঞ্চলের দুবাই মেরিনাতে বিলাসবহুল আল-সাহাব টাওয়ার-১ এর ১১ তলায় অ্যাপার্টমেন্টে ১১০২ নম্বর ফ্ল্যাটের মালিক তানজিম আশরাফুল হক। এই ফ্ল্যাটেই তিনি পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। তার পরিবারে রয়েছে স্ত্রী আসমা সুলতানা, মেয়ে জারা ইরভিন হক, জাইনা আদিভা হক, জোয়ানা আমরিন হক। মানবজমিন অনুসন্ধানে শুধুমাত্র দুবাই মেরিনার বিউপোর্ট টাওয়ারেই তানজিম হকের ২ বেড রুমের ১২৪৩ স্কয়ার ফিটের ৩টি ফ্ল্যাটের সন্ধান পাওয়া গেছে। এরমধ্যে মেরিনা প্রমেন্যাডে বিউপোর্ট টাওয়ারে ১ টি। ইউনিট নম্বর ১৬০২, ফ্ল্যাট নম্বর জিরো। Beauport X1-ফ্ল্যাট নম্বর [LX] 18A। এই ভবনের ১৬তলায় Plot Number: 107-0, Unit No: 114 আরও একটি ফ্ল্যাট আছে। বিউপোর্ট টাওয়ারটি ব্লসম মেরিনা নার্সারির পাশে। ভবনটি ২৬ তলাবিশিষ্ট। অভিযোগ আছে, যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটনে অবস্থিত সেন্ট্রাল পার্ক টাওয়ারেও একটি ফ্ল্যাট আছে তানজিমের। সেখানে তানজিমের ছোটভাই তাসিন হক বসবাস করেন। ফ্ল্যাটটি ওই ভবনের ৩৬ তলায় অবস্থিত। এই ভবনের প্রতি ইউনিটের দাম প্রায় ৫.৯ মিলিয়ন ডলার। দুবাইতে অ্যাপার্টমেন্ট, ফ্ল্যাট, প্লট কেনাবেচার জনপ্রিয় ওয়েবসাইট প্রপার্টি ফাইন্ডার ও বাইউট ডটকম ঘেঁটে দেখা গেছে, দুবাই মেরিনার আল-সাহাব টাওয়ার ও বিউপোর্ট টাওয়ারে ২ বেড রুমের ১২৭৫ স্কয়ার ফিটের প্রতিটি ফ্ল্যাটের মূল্য ইউনিটভেদে ৩২ থেকে ৪২ লাখ দুবাই দিরহাম। এতে প্রতিটি ফ্ল্যাটের দাম দাঁড়ায় ৮ লাখ ৭১ হাজার থেকে প্রায় সাড়ে ১১ লাখ ডলারের কাছাকাছি। এছাড়া দুবাইয়ের বহুজাতিক শপিং মলগুলোতে প্রতিটি দোকান ভাড়া মাসে আকারভেদে ১০ থেকে ১৫ হাজার দিরহাম এবং এককালীন অগ্রিম হিসাবে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ লাখ দুবাই দিরহাম খরচ করতে হয়।

দুবাইতে যত দোকান-
দুবাইয়ের ৪টি শপিং মলে একাধিক দোকান রয়েছে তানজিম আশরাফুল হকের। তানজিম আনটোল্ড, তানজিম স্কোয়াড নামে এসব দোকানের নামকরণ করা হয়েছে। এরমধ্যে দোকান নং এসসি ১৩৮, প্রথমতলা, দুবাই ফেস্টিভ্যাল সিটি মল। দোকান নং এসএফ ৪০, প্রথমতলা, দুবাই আউটলেট মল। দোকান নং জিএফ ০৩০, নিচতলা, দুবাই হিলস মল। দোকান নং বিএস ৪৩, দ্বিতীয় তলা, এক্সপো সিটি দুবাই। আনটোল্ড ফ্যাশন এভিনিউ দোকান নং ৩৯, ৪৮ দুবাই এক্সপো সিটি। এছাড়া মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে তানজিম ৩টি পোশাক শোরুম চালু করেছেন। এই তথ্য তিনি তার ব্যক্তিগত ফেসবুকে এক পোস্টের মাধ্যমে জানান। এবং ভক্তদের কাছে দোয়া চান।

যেভাবে সেন্ট কিটসে নাগরিকত্ব পেলেন তানজিম-
সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস। ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বীপপুঞ্জে অবস্থিত একটি সার্বভৌম দেশ। দেশটির সাংবিধানিক নাম ফেডারেশন অফ সেন্ট ক্রিস্টোফার অ্যান্ড নেভিস। রাজধানী বাসেতেরে। সূত্র মতে ২০১৪ সালের ৩১শে জানুয়ারি ক্যারিবিয়ান গভর্নেন্স কনসালটেন্ট এর মাধ্যমে অ্যাম্বাসেডর ওয়েন্ডেল লরেন্স বরাবর সেন্ট কিটস এন্ড নাভাস এর নাগরিকত্ব চেয়ে আবেদন করেন তানজিম আশরাফুল হক। আবেদনপত্রে পরিবারের ৩ সদস্যের নাগরিত্ব প্রদানের অনুরোধ জানানো হয়। এবং ৩ লাখ ডলারের বিনিয়োগ মর্মে এই আবেদন করা হয়। পরে সম্পূর্ণ অর্থ পরিশোধ করা হয়। ওই আবেদনপত্রটি সেন্ট কিটস ইনভেস্টমেন্ট সিটিজেনশিপ ইউনিটের প্রধান চেরিলিন পেম্বাটন অনুমোদন করে প্রধানমন্ত্রী বরাবর পাঠিয়ে দেন। যার আবেদন নং জঊঋ: REF: CIU/H&P/HAQUE/11/13/027। তানজিম হকের এই ৩ লাখ ডলার প্রদানের সমস্ত ডকুমেন্ট মানবজমিন-এর হাতে সংরক্ষিত আছে। পরে ওই বছরের ২৩শে মে তানজিম আশরাফুল হক, স্ত্রী আসমা সুলতানা, মেয়ে জাইনা আদিবা হককে ওই দেশের প্রধানমন্ত্রী স্বাক্ষরিত নাগরিকত্ব সনদ প্রদান করেন সেন্ট কিটস সরকার। যার রেজিস্ট্রেশন নম্বর যথাক্রমে ২০৯৭১, ২০৯৭২ ও ২০৯৭৩। পরে ওই বছরের পহেলা জুন সেন্ট কিটসের বায়োমেট্রিক পাসপোর্টের আবেদন করেন তানজিম হক ও তার পরিবার। পাসপোর্টের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের চেইস ম্যানহাটন ব্যাংক থেকে সেন্ট কিটসের দ্য সার্কাস ব্যাংকে ক্যারিবিয়ান গভর্নেন্স কনসালটেন্ট এর অ্যাকাউন্টে প্রথম ধাপে ১ হাজার ৬৫ ডলার পাঠান হয়। যার সুইফ্ট কোড: CHASUS33। সার্কাস ব্যাংক অব বাসারেতের সুইফ্ট কোড: ROYCKNSK। এছাড়া নাগরিকত্ব সনদের জন্য বিনিয়োগের অর্থ ২০১৩ সালের অক্টোবরের ৩০শে তারিখে সংযুক্ত আরব আমিরাতের এমিরেটাস ইসলামিক ব্যাংকের AE090340000024780233091 নং একাউন্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে সিটি ব্যাংকের শাখায় প্রায় ৩ লাখ ৩৯ হাজার ডলার পাঠানো হয়। যার রেফারেন্স নম্বর HP1101। পরে ওই টাকা দ্বীপরাষ্ট্র সেন্ট কিটসের হেনলি অ্যান্ড প্যারেন্টস নামে এক প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব GB27MIDL40051573104225 নং তে পাঠানো হয়। এর পরে একই উপায়ে প্রায় ৫ লাখ ডলার স্থানান্তরের তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া ওই বছরের ৩১শে অক্টোবর পাসপোর্ট ফি হিসেবে দুবাই থেকে এইচএসবিসি ব্যাংকে ১১ হাজার ৫০০ ডলার পাঠানো হয়। যার লেনদেন কোড HP818 ।

মিলিয়ন ডলার খরচে দুবাইতে মিউজিক ফেস্টিভ্যাল-
গত ২৪শে ফেব্রুয়ারি দুবাই এক্সপো সিটিতে দুবাই’স প্রথম মেগা ফেস্টিভ্যাল আয়োজন করে। নাম দেয়া হয় আনটোল্ড মিউজিক ফেস্টিভ্যাল। দুইদিনব্যাপী এই কনসার্টে প্রায় এক লাখ মানুষ জড়ো করা হয়। জনপ্রতি ১০০ থেকে ৫০০ দিরহাম পর্যন্ত টিকেটের মূল্য ধরা হয়। দুবাই এক্সপো সিটিতে বিশাল এই সংগীত অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিলেন তানজিম হকের প্রতিষ্ঠান দ্য তানজিম স্কোয়াড। মূলত তানজিম হকের পোশাকের শোরুম উদ্বোধনের জন্যই এই আয়োজন করা হয়। এতে হাজির করা হয় জনপ্রিয় ডাচ্ ডিজে গায়ক আরমিন ভ্যান বুরেন, ডিজে রকস্টার ডন ডায়াবলো ও ডিজে গায়ক হার্ডওয়েল, যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় গায়িকা বেবে রেক্সা, ইংলিশ গায়িকা এলি গোল্ডিং, আমেরিকান জনপ্রিয় রেপার জি-ইজি, জ্যামাইকান ডিজে গায়ক মেজর লেজার, জার্মান গায়ক পাল কাল্কব্রেনার, অস্ট্রেলিয়ান জনপ্রিয় গায়ক অ্যান্ড প্রডিউসার টিমি ট্রাম্পেট সহ আরও নামিদামি বিখ্যাত সব গায়কদের ভাড়া করে আনা হয়। পুরো আয়োজনের বিষয়টি তানজিম আশরাফুল হক ও তার স্ত্রী আসমা সুলতানা একাই সামলান। এই আয়োজনে প্রায় ১ মিলিয়ন ডলার খরচের তথ্য পাওয়া গেছে।

তানজিম আশরাফুল হকের বাংলাদেশি পাসপোর্টে নিজস্ব ঠিকানা হিসেবে বনানীর একটি বাসার নাম ব্যবহার করা হয়েছে। যার হাউজ নং ৯২, রোড নং ২৩/এ, ফ্ল্যাট নং ৫/এ, বনানী, ঢাকা। তবে ওই ঠিকানায় গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। পরে ওই বাসার সিকিউরিটি গার্ড হারুন উর রশীদের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, তানজিম হক এই বাসায় থাকেন না। ৫ তলায় তার একটি ফ্ল্যাট কেনা। ওখানে তার শোরুমের মালামাল রাখা হয়। শার্ট-প্যান্ট প্যাকিং করা হয়। তারা পরিবারসহ সবাই বিদেশে থাকেন। কোন দেশে থাকে তা জানি না। ২ বছরেও তাকে এই বাসায় আসতে দেখিনি। তবে ২ দিন আগে তার ড্রাইভার আমাকে বলেছে, স্যার সোমবার দেশে আসবেন। বাসা পরিষ্কার রাখতে হবে। পরে তানজিম আশরাফুল হকের শুলশানের বাসা সিডব্লিউএন (এ)৪৮এ, রোড নং ৪১, ফ্ল্যাট নং ১০পি, ভিলা লায়লা, গুলশান-২তে গেলে সেখানেও তাকে পাওয়া যায়নি। ওই বাসার সিকিউরিটি গার্ড বলেন, তানজিম হক এই বাসায় থাকেন না। এই ফ্ল্যাট ভাড়া দেয়া। তারা সবাই দুবাই থাকেন। তিনি ফ্ল্যাট কেনার পরে কখনোই এই বাসায় থাকেননি। তবে দেশে এলে মাঝেমধ্যে এসে দেখে যান। ইলেকট্রিশিয়ানের সঙ্গে কথা বলেন। ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় বসুন্ধরা আর/এ’তে ৩ একর জমির উপর নির্মাণ করেছেন সুবিশাল বাংলো বাড়ি। নাম এস্কেপ ডেন। সুইজারল্যান্ডের পাহাড়ি বাড়ির আদলে এই বাড়িটি ১০টি কার্গো কনটেইনার ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে। স্থপতি কাজী ফিদা ইসলাম বাড়িটির ডিজাইন করেছেন।

বিদেশে বিপুল সম্পদের উৎস্য সম্পর্কে জানতে নানা উপায়ে যোগাযোগ করা হয় ব্যবসায়ী তানজিম আশরাফুল হকের সঙ্গে। দুবাইতে ব্যবহার করা মোবাইল ফোনে তার সঙ্গে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে যোগাযোগ করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। এক পর্যায়ে প্রতিবেদকের ফোন নম্বরটি ব্লক করে দেন।

পরে ফ্যাশন হাউজ এক্সটেসি ও তানজিমের বসুন্ধরা কর্পোরেট অফিসের ম্যানেজার মঞ্জুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথমে কথা বলতে রাজি হননি। পরে তিনি তাদের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ এই বিষয়ে জানতে চান। বিষয়টি তাকে অবহিত করলে তিনি এ বিষয়ে তানজিম আশরাফুল হকের সঙ্গে আলাপ করে জানাবেন বলে আশ্বস্ত করেন। এ সময় তিনি বলেন, আমাদের মাত্র অল্পকিছু আউটলেট। কিন্তু যাদের শত শত আউটলেট। দুবাই, সিঙ্গাপুর, আমেরিকায় হাজার কোটি টাকার সম্পদ। বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। আপনারাতো তাদের ধরেন না। আমাদের মতো ছোট মানুষের পেছনে লাগলেন কেন? এমডি স্যার সব সময় বিদেশ থাকেন না। তিনি আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকেন। সময় পেলেই দেশে আসেন। আমি তার সঙ্গে কথা বলে আপনাকে জানাবো। অনেকে অনেক কিছু বলতে পারেন। কিন্তু সব কিছুতে উত্তর দেয়ার সময় উনার থাকে না। তিনি সবসময় কাজে ব্যস্ত থাকেন। পরদিন মঞ্জুর রহমানকে ফোন করা হলে তিনি আর ফোন ধরেননি।মানবজমিন

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions