খাগড়াছড়িতে ইটভাটা ও তামাকচুল্লিতে পুড়ছে বন

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় বুধবার, ২৭ মার্চ, ২০২৪
  • ২৯ দেখা হয়েছে

খাগড়াছড়ি:-খাগড়াছড়িতে নির্বিচারে অশ্রেণিভুক্ত বন উজাড় হচ্ছে। গত কয়েক দশক ধরে ধারাবাহিক বন উজাড়ে একদিকে পাহাড় হারাচ্ছে তার ভারসাম্য, অপরদিকে ঝুঁকি বাড়ছে জনজীবনে। বিশেষজ্ঞদের মতে, নির্বিচারে বন উজাড় রোধে প্রশাসনের কঠোর হস্তক্ষেপের বিকল্প নাই।

পার্বত্য অঞ্চলে চার শ্রেণির বন রয়েছে। সেগুলো হলো, সংরক্ষিত বন, রক্ষিত বন, ব্যক্তিমালিকাধীন বন ও অশ্রেণিভুক্ত বন৷ তবে অধিকাংশই অশ্রেণিভুক্ত বনের আওতাভুক্ত। দীর্ঘদিন ধরে সংরক্ষিত বন ও অশ্রেণিভুক্ত বনাঞ্চল ব্যাপক হারে উজাড় হয়েছে। প্রতিনিয়ত বনখেকোদের দৌরাত্ম্যে নির্বিচারে কাটা হচ্ছে এসব বনের গাছ ।বিশেষ করে পাহাড় থেকে পরিবহণ করে সেসব কাঠ নেওয়া হয় ইটভাটা,করাতকল ও বিভিন্ন তামাকচুল্লিতে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরে হারিয়ে যাবে প্রাকৃতিক বন।

খাগড়াছড়িতে সংরক্ষিত বনের পরিমাণ ৬ হাজার ২শ একর এবং অশ্রেণিভুক্ত বনের আয়তন প্রায় ২ লাখ ৬৩ হাজার ৩২ একর। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক বন রক্ষায় এখনই উদ্যোগ তাগিদ দিয়েছে পরিবেশকর্মীরা।খাগড়াছড়িতে অবৈধ ইটভাটার সংখ্যা ৪৩টি। এদের অধিকাংশরই বৈধ কাগজপত্র নেই। সবুজ অরণ্যজুড়ে এখন ইটভাটার ক্ষত। সবুজ পাহাড় এবং কৃষিজমিতে জ্বলছে ইটভাটার চিমনি। ভাটার ধোঁয়ায় বিপর্যস্ত পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য।ভাটা নির্মাণের জন্য পাহাড় কেটে সমান করা হয়েছে। এসব ভাটায় পোড়ানো হচ্ছে বনের কাঠ।

সূত্র বলছে, প্রতি বছর জেলায় অক্টোবর মাসে ইটভাটাগুলোর কাজ শুরু হয় এবং তা চলে মে-জুন পর্যন্ত। বৃষ্টির আগ পর্যন্ত প্রত্যেকটি ইটভাটায় ১২-১৩ রাউন্ড ইট পোড়ানো হয়। প্রত্যেক রাউন্ডে৭/৮ লাখ ইট পোড়ানো হয়। আর প্রত্যেক ইটভাটায় বছরে গড়ে এক কোটি ইট উৎপাদন হয়। খাগড়াছড়ির সব ভাটায় বছরে প্রায় ৪৩ কোটি ইট তৈরি হয়, যার বাজার মূল্য প্রায় ৩০০ থেকে ৩৮৭ কোটি টাকা (প্রতি হাজার গড়ে ৭/৯ হাজার টাকা দরে)।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতি রাউন্ড ইট পোড়াতে প্রায় ৮-৯ হাজার মণ (১ মণে ৪০ সের) জ্বালানি কাঠ লাগে এবং এক মৌসুমে একটি ইটভাটায় গড়ে কাঠ পুড়ে প্রায় এক লাখ মণ। সেই হিসেবে ৪৩ ইটভাটায় বছরে কমপক্ষে ৪৩ লাখ মণ কাঠ পুড়ছে। ইটভাটা এবং ভাটা শ্রমিকের রান্নাবান্নার কাজেসহ প্রায় ৫০ কোটি টাকার গাছ পুড়ছে।

এছাড়া পুরো জেলার আনাচে-কানাচে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে প্রায় দেড় শতাধিক করাতকল। শুরুতে বেশীরভাগই অবৈধ থাকলেও সম্প্রতি অধিকাংশই বৈধতা পেয়েছে। যার বেশিরভাগই রাজনৈতিক ও আঞ্চলিক দলের প্রভাবশালী নেতাদের মালিকানায়৷

বন ও পরিবেশ আইন অনুযায়ী, সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে করাতকল স্থাপনের কোনো সুযোগ বা নিয়ম নেই। তবে এসবের তোয়াক্কা করেন না বনখেকোরা। সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘিরেই করাতকল স্থাপন করে দিনে-রাতে কাটা হচ্ছে সংরক্ষিত বনের কাঠ। করাতকল মিস্ত্রিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রতিটি করাতকলে দৈনিক অন্তত ১০০ থেকে ১৫০ ঘনফুট পর্যন্ত কাঠ চিরানো হয়। সেই হিসেবে খাগড়াছড়ি জেলার করাতকলগুলোতে প্রাত্যহিক গড়ে অন্তত সাড়ে ২২ হাজার ঘনফুট কাঠ চেরা হয়। বছর শেষে যার পরিমাণ ৮০ লাখ ঘনফুট ছাড়িয়ে যায়।

মূলত প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় এভাবে অবাধে বন ধ্বংসের তাণ্ডব চলছে, নির্বিকার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

খাগড়াছড়িতে এ বছর ছয় শতাধীক হেক্টর কৃষি জমিতে তামাক চাষ করা হয়েছে। আর এ তামাক পাতা পোড়াতে প্রয়োজন হবে প্রায় ৪ লক্ষ মণ কাঠ। যার সব গুলোই সংগ্রহ করা হচ্ছে সবুজ বনাঞ্চল ধ্বংস করে।
এক সাধারণ সমীক্ষায় দেখা গেছে, এক হেক্টর জমির তামাকের পাতা পোড়াতে প্রায় ৬শ থেকে ৬শ পঞ্চাশ মণ কাঠ প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে ছয় শতাধীক হেক্টর জমির তামাকের পাতা পোড়াতে প্রায় ৪লক্ষ মণ কাঠ গাছ প্রয়োজন হবে। আর এই চাহিদা পূরণের জন্য পাহাড়ের কচি কাচা ও বড় ছোট গাছ কেটে প্রতিটি তামাক চুল্লীর দুয়ারে পৌছে দেওয়া হচ্ছে। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা উপেক্ষা করে এসব বন থেকে নির্বিচারে গাছ কেটে নিচ্ছে বনখেকোরা। সাধারণ পার্বত্য গাছ কাটতে হলে সরকারিভাবে অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু নজরদারি ও তদারকির অভাবে বিনা অনুমতিতে বনের গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে বনখেকোরা।

প্রাকৃতিক বন উজাড় করে রাবার ও ফলদ বাগান তৈরি, বনের গাছ চুরির কারণে দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক বন। এছাড়া অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণের কারণে বনের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। বন ধ্বংসের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে শত প্রজাতির বৃক্ষ, লতা-গুল্ম। বিচরণ ক্ষেত্র কমে যাওয়ায় বনের ওপর নির্ভরশীল বণ্যপ্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এসব নিয়ে বন বিভাগের কোন নজরদারি নেই। প্রাকৃতিক বন বিপন্ন হওয়ায় বিপন্ন হয়ে উঠছে বনের ওপর নির্ভরশীল মানুষরা। বন ধ্বংস হওয়ায় পানি উৎস কমেছে প্রায় ৬১ শতাংশ। শুষ্ক মৌসুমে ঝিরি ঝরনায় পানি উৎস কমে আসে।

খাগড়াছড়ি পরিবেশ সুরক্ষা আন্দোলনের সভাপতি প্রদীপ চৌধুরী বলেন, ‘এ সংকট নতুন নয়। দীর্ঘ বছর ধরে অবাধে বন ধ্বংসের ফলে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু হয়েছে। পাহাড়ে বনের কাঠ কর্তনের ওপর একটি দীর্ঘ সময়ের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা না গেলে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে আসবে।’

খাগড়াছড়ির বন্যপ্রাণী বিষয়ক আলোকচিত্রী সবুজ চাকমা বলেন, একসময় পাহাড়ে ভাল্লুক, বাঘ, সাম্বার হরিণসহ বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখি দেখা গেলেও আজ তা বিপন্ন। একসময় হর্নবিলনহ অনন্ত ৩৭৫ প্রজাতির পাখি দেখা যেত। যা আজ হারিয়ে গেছে।

খাগড়াছড়ির বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো.ফরিদ মিঞা জানান,ইটভাটা ও তামাকচুল্লিতে বনের কাঠ পোড়ানো সর্ম্পূণ নিষেধ। কেউ যদি বনের কাঠ ব্যবহার করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মাঠ পর্যায়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ’

বনখেকোদের দৌরাত্ম্য বন্ধে খাগড়াছড়িতে পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসনের একাধিক অভিযান পরিচালিত হলেও অবৈধভাবে বনের কাঠ ইটভাটায় জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার বন্ধ হচ্ছেনা।

খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান জানান, খাগড়াছড়িতে অবৈধ ইটভাটা বন্ধসহ পরিবেশ বান্ধব ইটভাটা তৈরি করা হবে। দৈনিক খাগড়াছড়ি

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.net
Website Design By Kidarkar It solutions