শিরোনাম
রাঙ্গামাটিতে শুরু হতে যাচ্ছে এনডিএফ বিডি ন্যাশনাল ইয়ুথ লিডারশীপ ট্রেনিং ক্যাম্প কেএনএফের আরও ২ সন্দেহভাজন সদস্য হাজতে ‘কেএনএফ’ সন্ত্রাস : সার্বভৌম নিরাপত্তা সতর্কতা রাঙ্গামাটির কাপ্তাইয়ে দরিদ্র জেলেদের মাঝে ছাগল বিতরণ উপজেলা নির্বাচন : জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮ মে’র পরীক্ষা স্থগিত ‘খুব শিগগিরই এ বিষয়ে কথা বলব’, শাকিবের তৃতীয় বিয়ে প্রসঙ্গে অপু বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ের খেলা দেখা যাবে দুই শ টাকায় শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে বিএনপি সংকল্পবদ্ধ : মির্জা ফখরুল মানুষের প্রতিকার চাওয়ার কোনো জায়গা নেই : রিজভী ফটিকছড়িতে ‘হিট স্ট্রোকে’ গৃহবধূর মৃত্যু

মা আমার

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় শনিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২৪
  • ২৬১ দেখা হয়েছে

মো: শাহ্ আলম সবুজ:- আমার মায়ের কপালের ডান পাশে যে কাটা দাগটি আছে তার চারিধারে কতগুলো বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে থাকতে দেখতাম প্রতিটি ঈদের দিন সকালে। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন রমজানের ঈদ হতো কনকনে শীতের দিনে। ঘরের ধারে যে ছোট্ট নদীটি বয়ে গেছে অনেক দূরে, তার উপর দিয়ে সাদা বকের মত ভেসে বেড়াত রাশি রাশি কুয়াশা। ঈদের দিন ভোরে কুয়াশা ভেদ করে আশেপাশের পাঁচ বাড়ির ছেলেপুলে মিলে নেমে পড়তাম নদীতে। ঈদ বলে কথা। সকালে গোসল না করে তো ঈদ হয় না।
বরফ চুয়ানো সেই ঠান্ডা পানিতে গোসল করে আমি দাঁতের পাটি কাঁপতে কাঁপতে যখন চুলার ধারে মায়ের কাছে গিয়ে বসতাম। তখনই মায়ের কপালের দাগের পাশে ঘামের বিন্দুগুলো আমাকে বড় অবাক করে দিত। আমি বলতাম – মা তোমার শীত করে না?
মা বলতো- মায়েদের শীত করলে তোরা গরম পাবি কই? এ কথার অর্থ কি সে আমি তখন বুঝিনি মোটেও। শুধু অবাক দৃষ্টিতে আমার মায়ের মুখে চেয়ে রইতাম। এরমধ্যে পাশের বাড়ির তপু এসে হাজির। তার গায়ে নতুন জামা। আমারও আছে ঈদের জামা, মাইনির হাট থেকে লাল জামা , কালো প্যান্ট,আরেকটা ৩ টাকার লাল চশমা কিনে দিয়েছিল বাবা।
তড়িঘড়ি করে ওগুলো পড়ে নিলাম। চোখে দিলাম প্লাস্টিকের সেই লাল চশমা। ওটা চোখে দিলে মাটিগুলো উঁচু নিচু লাগে। সেই উচু নিচু মাটির উপরে পা ফেলতে ফেলতে বাবার হাতের তর্জনী আঙ্গুলটা ধরে সোজা চলে যেতাম ঈদগায়।
যাওয়ার আগে মা লাল সেমাই খাইয়ে দিতে আমায়। তখনো ঘিয়ে ভাজা সেমাই রান্না হয়নি। লাল সাদা হলুদ রঙে মিশ্রিত এক ধরনের ঘিয়ে ভাজা সেমাই আমার খুব পছন্দের ছিল। ওগুলো এখন আর দেখা যায় না।
।।।
।।।
বাবার হাত ধরে ঈদগাহে যেতে যেতে মায়ের কপালের ঐ দাগটির কথা বারবার চোখে ভাসতেছিল সেদিন।

আগের বছর এমন ঈদের দু দিন আগে মাকে বলেছিলাম – মা তপু গো পিঠা বানাইতেছে। ঈদ আইলে আমাগো পিঠা বানাইবা ? আমার কথা শুনে মায়ের চোখ আমি ছলছল করতে দেখেছি।

আমার বাবা একজন দিনমজুর। টানা পূরণের সংসারে জীবন ধরনই যেন একমাত্র ধর্ম। আমাদের ঘুমানোর জন্য সনের ঘরের ভিতরে যে পাশে মাটির তৈরি একটা চকি ছিল তার কাছেই ছিল একটা কালো রংয়ের ট্রাঙ্ক। ওই ট্রাঙ্কে থাকতো আমার মায়ের একটা ঈদের শাড়ি আর বাবা একটা জামা। প্রতিবছর ঈদের দিন মাকে ওই শাড়ি আর বাবাকে ওই জামা পড়তে দেখতাম আমি। মাঝেমধ্যে কৌতুহল নিয়ম বাবাকে বলতাম – বাবা তোমরা ঈদের নতুন জামার নাও না কেন ?
বাবা বলতো – বড়দের ঈদের জামা কিনতে হয় না। তখন আমি বাবার চোখের দিকে চেয়ে বলতাম – বাবা আমিও কি একদিন বড় হবো? বাবা আমার কথার কোন উত্তর দিতে পারতেন না। কিসে যেন তার কন্ঠকে হঠাৎ আটকে দিতে ।

এই সংসারে আমি যখন মায়ের কাছে পিঠার কথা বললাম মা আমার শুধু বুকে টেনে নিল আর বলল – বাবা আমরাও পিঠা বানাবো। বলেই ঘরের থেকে কিছু চাল নিয়ে শিউলিদের বাড়িতে গেল ঢেঁকিতে চালগুড়া করবে বলে। শিউলির মা ঢেকিতে পার দেয়, আমার মা মটিতে বসে নিচের দিকে নুয়ে চাল গুলি আলিয়ে দেয়। দেখতে দেখতে হঠাৎ ঢেকির মাথা মায়ের কপালে লেগে গেল। মুহূর্তেই রক্তে লাল হয়ে গেল আমার মায়ের কপাল। আমি কেঁদে উঠলাম, মা শুধু আমার চোখের দিকে চাইল, কিন্তু কাঁদলেন না ।

সেই থেকে মায়ের কপালের সেই কালো দাগ আমার বুকের একধারে একটা গভীর ক্ষতর জন্ম দিয়েছে। সেই ক্ষতে মাঝে মাঝেই টনটন করে ওঠে। ঈদের দিন আসলে ওই জায়গায় বড় টান পরে।

ঈদগাহ থেকে ফিরে আসার সময় এক টাকার বাঁশের বাঁশি কিনে আনতাম। চোখে সেই লাল চশমা। ঘরে এসে দেখতাম মা এখনো চুলার ধারে। আমার পছন্দের সেই তিন রঙের ঘিয়ে ভাজা সেমাই প্লেটে বেড়ে দিতে দিতে ঈদ নিয়ে মা যে কত কথা জিজ্ঞেস করতো,আমায় সেসব কথা এখনো স্মৃতিতে অমলিন হয়ে আছে।

এভাবে গুনে গুনে ষোলটি ঈদ এ জীবন থেকে চলে গেল। সতেরতম ঈদের দিন বিকেল থেকে হঠাৎ শুরু হল প্রচন্ড বৃষ্টি। আমাদের সনের ঘরে বৃষ্টির শব্দ তেমন একটা শোনা যায় না। শুধু বাতাসের শো শো শব্দে কানে আসে। ঘর থেকে একটু দূরে আমাদের যে গরুটি বাঁধা ছিল তা আনতে গিয়ে কিছুক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজেছিল মা।

পরের দিন মায়ের গায়ে এলো প্রচন্ড রকমের জ্বর। বৃষ্টি থেমে গেল কিন্তু মায়ের গায়ে থেকে জ্বর তো কমে না। বাবা গ্রামের যত ডাক্তার যত বৈদ্য সব একে একে দেখাতে লাগলো । মায়ের মুখ দিনে দিনে যেন মলিন হতে লাগলো। এভাবে ১১ দিন পর এক সকালে মা আমায় কাছে ডেকে কিছু একটা বলতে গিয়ে যেন বলতে পারল না। শুধু আমার কপালে একটা চুমু দিল, আর চোখ দিয়ে গলগল ধারায় কতগুলো জল গড়িয়ে ভিজে যেতে দেখলাম।

কিছুক্ষণ পর মায়ের বুকে ব্যথা বেড়ে গেল। ঘরের ভিতরে ভরে গেল মানুষ। সেদিনের পর থেকে আমি জেনেছি আমার মা আর কোনদিন আমার দিকে চোখ তুলে চাইবে না। আর কোনদিন আমার জন্য পিঠা বানাতে ঢেঁকিতে পা দিবেন না। আমি আর কোন ঈদের দিনে মায়ের কপালে সে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখতে পাবো না। এই কথা জানার পর আমি শুধু একটা চিৎকার দিয়েছিলাম। সেই চিৎকার সেই অশ্রুধারা আর জীবনে একদিনের জন্য বুকের ভেতর থেকে মুছে যায় নি।

এরপর থেকে বিগত ৩০ বছর ধরে আমার ঈদ শুরু হয় ওই হিজল গাছের নিচে সুউচ্চ ওই মাটির বেদির পাশে। যেখানে মা আমার জন্য সেই শখের পিঠা আর তিন রঙের সেমাই বেড়ে অপেক্ষা করে।

এরপর হতে যতবার ঈদ আসে ততবারই মায়ের সাথে দেখা করে তারপর ধীর কদমে ঈদগাহের দিকে যাই। কিন্তু এখন আর মায়ের হাতের লাল সেমাই খাওয়ার জন্য কেউ ডাকেনা, বাবার সেই‌ তর্জনী আঙ্গুল ধরে যাওয়া হয় না ঈদে। বাবার শরীরে বাসা বেধেছে কত যে অসুখ। বাবাকে ধরে ধরে ধীর কদমে নিয়ে যাই ঈদগায়। হাটি আর ভাবি কতদূর হাঁটলে তোমার দেখা পাব মা?

 

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.net
Website Design By Kidarkar It solutions