মো. ফিরোজ মিয়া ;- প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বর্তমান আচরণ এবং বিশ্বের অগণতান্ত্রিক দেশের সরকারি কর্মচারীদের আচরণের মাঝে খুব একটা পার্থক্য দেখা যায় না। তাদের আচরণ ও কর্মকাণ্ডে মনে হয়, তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী নন, সরকারের কর্মচারী। বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশের সরকারি কর্মচারীদের আচরণের সঙ্গে বর্তমান প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের আচরণের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। সবসময় জনগণের সেবা করার চেষ্টা করার যে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে, তাদের অধিকাংশের আচরণে সাংবিধানিক সেই বাধ্যবাধকতা প্রতিপালনের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বর্তমান কর্মকাণ্ড ও আচরণে অনেকেরই মনে হতে পারে এরা মধ্যযুগের রাজ-কর্মচারীদের প্রকৃত উত্তরসূরি। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায়ও তারা তাদের পূর্ব-চরিত্র ও আচরণ ধরে রেখেছে। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের অন্যতম ও প্রধান দায়িত্ব জনসেবা, এটি এখন তাদের চিন্তা ও চেতনায় আছে বলে মনে হয় না। তাদের চিন্তা ও চেতনায় কেবল নিজস্ব ও দলগত স্বার্থসিদ্ধি এবং দুর্নীতির প্রচ্ছায়া। জনসেবা ও সুশাসন নিশ্চিত করার পরিবর্তে তারা এখন ব্যস্ত নিজেদের ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করায়। এজন্য তারা জনসেবার পবিত্র দায়িত্বের কথা ভুলে গিয়ে একক বা দলগতভাবে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছেন। কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সংযুক্ত হয়ে রাজনৈতিক কর্মীর অনুরূপ আচরণ করছেন। ফলে উপেক্ষিত হচ্ছে সুশাসন ও নিরপেক্ষ জনসেবা।
দক্ষ, সৎ ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা সর্বদাই নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে জনসেবা ও সুশাসন নিশ্চিত করায় মনোযোগী হন। তারা নিজেদের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হতে দেন না। শ্যাম নির্বাচনে সহায়তা করেন না। তারা তাদের মেধা, দক্ষতা ও যোগ্যতার বিনিময়ে যেটুকু প্রাপ্য, ততটুকুই চাকরিগত সুযোগ-সুবিধার আশা করেন। তারা কখনো অপরকে বঞ্চিত করে পদ-পদবি বাগিয়ে নেওয়ার অনৈতিক নোংরা খেলায় মাতেন না। অপরদিকে অদক্ষ, দুর্নীতিগ্রস্ত ও ব্যক্তিত্বহীন কর্মচারীরা সব সরকারের আমলেই ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক কর্মচারীর চেয়েও নিজেদের অধিকতর অনুগত রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে প্রমাণের চেষ্টা করেন এবং সফলও হন। কারণ, জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়লে সব সরকারই দক্ষ, সৎ ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কর্মচারীদের গুরুত্বপূর্ণ পদ ও পদবিতে আসীন করতে আগ্রহী হয় না, বরঞ্চ ভয় পায়। বিরোধী মত দমন ও শ্যাম নির্বাচনে সহায়তার জন্য সরকার তখন অদক্ষ, বুদ্ধিবৃত্তিক ও আর্থিক দুর্নীতিগ্রস্ত এবং ব্যক্তিত্বহীন কর্মচারীদের গুরুত্বপূর্ণ পদ ও পদবিতে আসীন করে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে। এছাড়া জনপ্রশাসনে নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রেও বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতির আশ্রয়ে মেধাকে প্রাধান্য না দিয়ে দলীয় পরিচয় ও আনুগত্যকে প্রাধান্য দেওয়া দেয়। ফলে জনপ্রশাসনে দক্ষ, সৎ ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কর্মচারীর সংখ্যা ক্রমেই কমতে থাকে। এছাড়া রাজনৈতিক বিবেচনায় দক্ষ, সৎ ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কর্মচারীদের জনসেবা ও সুশাসন নিশ্চিতে কোনোরূপ ভূমিকা রাখার সুযোগও দেওয়া হয় না। ফলে জনপ্রশাসনের প্রকৃত চেহারাটাই পালটে যায়, জনপ্রশাসনের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হয়। জনগণ সমগ্র জনপ্রশাসনকেই মনে করে মেধাহীন, অযোগ্য ও দুর্নীতিগ্রস্ত। জনপ্রশাসনের ওপর জনগণ আস্থা হারায়। জন-আস্থাহীন জনপ্রশাসন দিয়ে ভারসাম্যহীন অবকাঠামোগত উন্নয়ন সম্ভব হলেও সার্বিক উন্নয়ন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা কখনো সম্ভব নয়।
জনপ্রশাসনের ভাবমূর্তি বিনষ্ট ও জন-আস্থা হারানোর আরেকটি বড় কারণ হলো প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বিভিন্ন সমিতি বা সংগঠনের সরাসরি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ। এসব সমিতি বা সংগঠনের অধিকাংশই সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রূপ পালটে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠনের রূপ ধারণ করে। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের নিজেদের মধ্যে সমিতি বা সংগঠন করাতে কোনো বাধা নেই। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী নন এমন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত কোনো সমিতি বা সংগঠনের সঙ্গে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা যুক্ত হতে পারেন না; কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী নন এমন ব্যক্তিদের দ্বারা গঠিত সমিতি বা সংগঠনের সঙ্গে সরাসরিভাবে যুক্ত হয়ে সরাসরি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেন এবং রাজনৈতিক দলের অনুগত কর্মচারীর মতো আচরণ করেন। কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে সরাসরি অবস্থান নেন। তাদের কর্মকাণ্ড জনস্বার্থের অনুকূলে থাকে না। এছাড়া এসব সংগঠন বিভিন্ন সময়ে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে আইন ও নিয়মবহির্ভূত সুবিধা আদায়ে সচেষ্ট হয়। জনসমর্থনে ভাটা পড়লে সরকারও তাদের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে আইন ও নিয়মবহির্ভূত সুযোগ-সুবিধা দেয়। এমন অবস্থা চলতে থাকলে জনপ্রশাসনের যেটুকু মর্যাদা এখনো জনমনে অবশিষ্ট আছে, তা খুব শিগগির মুছে যাবে; যা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ও সুশাসনের জন্য মোটেই কাম্য নয়।
রাজনৈতিক আশীর্বাদপুষ্ট প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের অধিকাংশ আর্থিক দুর্নীতিতে জড়িত, উচ্চপর্যায়ের কর্মচারীরা বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতিতে জড়িত এবং কিছুসংখ্যক কর্মচারী আর্থিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উভয় প্রকার দুর্নীতিতে জড়িত। আর্থিক দুর্নীতির চেয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি জাতির জন্য অনেক বেশি ক্ষতিকর। কারণ, আর্থিক দুর্নীতি দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় প্রকার প্রভাব ফেলতে পারে। এছাড়া আর্থিক দুর্নীতিতে রাজনৈতিক সহায়তা না-ও থাকতে পারে। এছাড়া সদিচ্ছা থাকলে অতি সহজেই আর্থিক দুর্নীতি কমানো সম্ভব। কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতির সঙ্গে রাজনৈতিক সহায়তা থাকায় বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি দমন করা খুব একটা সহজ কাজ নয়। এছাড়া বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে আঘাত হানে। রাষ্ট্রীয় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দেয়। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে নিজেদের সুবিধামতো ব্যবহার করে।
স্বাধীনতার পর দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে উঠতে পারেনি। অন্য কথায় বলা যায়, কোনো সরকারই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে উঠতে দেয়নি। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে না ওঠার সুফল ভোগ করছে দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মচারী ও রাজনীতিকরা এবং কুফল ভোগ করছে সর্বস্তরের জনগণ। প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে না ওঠার কারণে রাজনীতিকরা তাদের ইচ্ছামতো প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের একটা অংশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করতে পারছে এবং অন্য অংশকে নিষ্ক্রিয় করে রাখতে সক্ষম হচ্ছে।
সমাজের ভারসাম্য বিনষ্ট করে এমন অর্থনৈতিক বা অবকাঠামোতগত উন্নয়ন কখনো একটি জাতির জন্য কাম্য উন্নয়ন নয়। নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং মানবতাবোধসম্পন্ন একটা জাতি গঠনের জন্য মূল্যবোধসম্পন্ন সার্বিক ও টেকসই উন্নয়নের বিকল্প কিছু নেই। এরূপ উন্নয়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়ভার রাজনীতিকদের হলেও এর বাস্তবায়নের দায়িত্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা। যে জন্য প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের হতে হয় দক্ষ, সৎ ও যোগ্যতাসম্পন্ন এবং রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ। বর্তমান জনপ্রশাসনে এরূপ কর্মচারীর সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। দেশের ও জনগণের কথা ভেবে তাদের কাজে লাগানোর দায়িত্ব রাজনীতিকদেরই।
মো. ফিরোজ মিয়া : অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব, চাকরি ও আইন সংক্রান্ত গ্রন্থের লেখক