ডেস্ক রির্পোট:- জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইরুজ অবন্তিকা লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রক্টরের কাছে। কিন্তু প্রতিকার পাননি তিনি। অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম ও সহপাঠী আম্মান সিদ্দিকীকে শনিবার রাতে আটক করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় দু’জনকে কুমিল্লা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
গত বছরের ১৪ই নভেম্বর সহপাঠী আম্মান সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে উত্ত্যক্ত করা ও হয়রানির অভিযোগ জানিয়েছিলেন অবন্তিকা। মানবজমিনের হাতে আসা লিখিত অভিযোগে তিনি লেখেন- ‘দীর্ঘদিন যাবৎ (১৪ ব্যাচ) আমারই বিভাগের শিক্ষার্থী আম্মান সিদ্দিকী আমার সঙ্গে হয়রানিমূলক আচরণ ও উত্ত্যক্ত করে আসছে। ১ম বর্ষে প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে সে চুপ হয়ে যায়। কিন্তু তার কিছুদিন পরই লিফটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকলে আমাকে দেখে সে কুরুচিপূর্ণ ও অশ্লীল মন্তব্য করে এবং আমি এরূপ মন্তব্যের প্রতিবাদ করায় বিপত্তি বাধে। সে অপমানিত বোধ করে এবং আমাকে বলে, আমার একদিন এমন অবস্থা করবে বা এমনভাবে ফাঁসাবে যাতে আমি মেয়ে হয়ে সমাজে মুখ দেখাতে না পারি এবং সুইসাইডে বাধ্য হই। ২০২২ সালে এমন আগ্রাসী আচরণ, মৌখিক গালাগাল, রাস্তায় চলতে গেলে দুর্ঘটনার হুমকিতে রূপ নেয়। তখন আমার বাবা অসুস্থ থাকায় আমি এ বিষয়ে আলোকপাত করিনি এবং তাকেও গুরুত্ব দেইনি।
তাই তাকে আমি বলি আমার সঙ্গে যেন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সে কোনো কথা না বলে। এরপর কিছুদিন বন্ধ থাকলেও হঠাৎ ছেলেটি ম্যাসেঞ্জারে আমাকে বলে সে এমন কিছু ছড়াবে মানুষের কাছে যাতে অপদস্ত হই এবং সে বলে, কবর থেকে একদম মুুরদা তুলে ফেলবে ওর সঙ্গে কিছু করলে।
অবন্তিকা লেখেন, সম্প্রতি আমার বাবা মারা যাওয়ার পর তার হুমকি-ধামকি এবং উৎপাতের মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন সময় আমি ডিপার্টমেন্টের করিডরে একা থাকলে সে আমাকে বিবিএ ফ্যাকাল্টির ছাদে কিংবা সম্পূর্ণ ফাঁকা ক্লাসরুমে তার সঙ্গে কথা বলার জন্য ডাকে এবং আমি সরাসরি কথা বলতে বললে রেকর্ড করবো বললে সে ভয়ে সেখান থেকে দ্রুতগতিতে চলে যায়। কয়েক মাস আগে সে আবারো আমাকে ডেকে আমাদের ডিপার্টমেন্টের উপরের ফ্লোরে নিয়ে কথা বলতে চাইলে আমি প্রতিবাদ করি এবং তখন সে আমাকে বলে, আমার বিরুদ্ধে প্রক্টর স্যারের বিরুদ্ধে নালিশ দিবি? দে দেখি কী করতে পারস। প্রক্টর স্যারকে কল দিলেই স্যার ধরে কারণ আমি সাংবাদিক। তুই জানিস আমার কোতোয়ালি থানায় আমার কতো লিংক। এক সেকেন্ড লাগবে তোকে ফাঁসাতে; এসব বলে আমাকে ভয় দেখায়। এমতাবস্থায় সেদিন আমি ভয়ে হোম টাউনে চলে যাই। কয়েকদিন ক্লাস অফ দেই। পরীক্ষা দিতে তো আসতেই হয়। মিডটার্ম পরীক্ষা শেষ হবার পর আমি যখন আমার বন্ধু-বান্ধবীর সঙ্গে ছিলাম তখন দেখেও আমাকে ডাকেনি। যখনই আমার বন্ধুরা চলে গেল তখনই সে আমাকে একা পেয়ে আবার ফাঁকা ক্লাসরুমে ডাকে। তখন আমি ইগনোর করে যেতে চাইলে সে আমার পথ রোধ করে এবং তার ডাকে ক্লাসরুমে না যাওয়ায় ধমক দেয়। আমি ঠিক তখনই তাকে বিভাগের অফিস রুমে নিয়ে যাই আমার কোনো ক্ষতি না হয়। আমি প্রচণ্ড ভীতসন্ত্রস্ত, এমনকি পরিবার ছাড়া ঢাকা থাকায় রাস্তাঘাটে চলাচলেও অনিরাপদ বোধ করছি।
অভিযোগের শেষে অবন্তিকা বিষয়টি আমলে নিয়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানান।
এই অভিযোগ ও প্রতিরোধের আবেদন পাওয়ার পর কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল, সে বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ও সাবেক প্রক্টর মোস্তফা কামাল বলেন, আমরা যখন আবেদনটি পেয়েছিলাম, এর তিনদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ইমদাদুল হক মারা গিয়েছিলেন। সে সময় ভিসির নির্দেশনা ছিল কোনো অভিযোগ এলে যেন আমরা অভিযোগকারীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলি। আমরা অবন্তিকাকে অফিসে এসে কথা বলার জন্য জানিয়েছিলাম। কিন্তু সে আসেনি। পরবর্তী সময়ে কোনো যোগাযোগও করেনি।
ভুক্তভোগী দেখা না করলে কি অভিযোগ আমলে নেয়া হয় না? এমন প্রশ্নে অধ্যাপক মোস্তফা কামাল বলেন, আমলে নেয়া হয়। কিন্তু এর আগে এ অভিযোগের একবার মীমাংসা হয়েছিল বলে সরাসরি তার বক্তব্য জানতে চেয়েছিলাম। সে আর যোগাযোগ করেনি।
অবন্তিকার শেষ অভিযোগের বিষয়ে কিছুই জানতেন না বলে জানান অভিযুক্ত সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম ও আগের ঘটনায় তদন্তকারী গৌতম কুমার সাহা।
শেষ অভিযোগের ঘটনা সম্পর্কে জানানো হয়নি বলে জানান গৌতম কুমার সাহা। তিনি বলেন, আগের ঘটনা নিষ্পত্তি হয়ে গিয়েছিল। এরপরে আর কিছু জানানো হয়নি।
অবন্তিকার অভিযোগের বিষয়ে তেমন ভূমিকা দেখা যায়নি আইন বিভাগের। শুধু সুপারিশ করেই ক্ষান্ত ছিল আইন বিভাগ। যদিও তার দাবি তিনি এরপরও একাধিকবার অবন্তিকার কাছে খোঁজখবর নিয়েছেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, আত্মহত্যার আগের দিনও তার সঙ্গে আমার বিভাগে কথা হয়েছিল। আমি জানতে চেয়েছি তার কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা। সে জানিয়েছে, সবকিছু ঠিকঠাক আছে।
সাবেক প্রক্টরের অবহেলার বিষয়ে চেয়ারম্যান আক্কাস বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টরের কাছে দায়ের করা অভিযোগের যে কোনো তদন্ত হয়নি এটা আমার জানা ছিল না। অবন্তিকার বিষয়ে প্রক্টর অফিস থেকেও আর কিছু বলেনি পরবর্তীতে আমাদের। কোনো চিঠিও দেয়নি অফিশিয়ালভাবে।
গত শুক্রবার রাত ১০টার দিকে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে কুমিল্লা শহরে নিজেদের বাড়িতে আত্মহত্যা করেন অবন্তিকা। পোস্টে মৃত্যুর জন্য তিনি সহপাঠী আম্মান সিদ্দিকী ও সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামকে দায়ী করেন। অবন্তিকার বাবা প্রয়াত জামাল উদ্দিন সরকারি কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। মা ছিলেন কুমিল্লা পুলিশ লাইন্স উচ্চ বিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক। এ ঘটনায় শুক্রবার রাত ও শনিবার দিনভর ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল-সমাবেশসহ নানা প্রতিবাদী কর্মসূচি পালন করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। দুজনকে গ্রেপ্তারে ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে (আলটিমেটাম) দেন শিক্ষার্থীরা। এই ঘটনায় শনিবার রাতে আটক করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম ও সহপাঠী আম্মান সিদ্দিকীকে। আনীত অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় দু’জনকে কুমিল্লা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। গতকাল সংবাদ সম্মেলনে গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন ডিএমপি’র অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন। তিনি আরও জানান, শনিবার রাতে অবন্তিকার মা বাদী হয়ে কুমিল্লার কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা করেন। এই মামলায় আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে দু’জনকে (আম্মান ও দ্বীন ইসলাম) আসামি করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের কোতোয়ালি থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। অবন্তিকার ‘হত্যায়’ জড়িতদের অবিলম্বে কঠোর শাস্তি প্রদানের দাবিতে গতকাল সন্ধ্যায় ক্যাম্পাসে মশাল মিছিলের আয়োজন করে শিক্ষার্থীরা।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগের শিক্ষার্থী কাজী ফারজানা মিম বলেন, ‘আমি শিক্ষকের কুপ্রস্তাবে রাজি না হাওয়ায় আমার জীবন হুমকির মুখে পড়েছে। ভয়ভীতির মুখে পড়েছি। আমাকে পুরো একা করে দেয়া হয়েছে। পরীক্ষা দিলেও ফেল করানো হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে অকার্যকর রয়েছে নিপীড়নবিরোধী সেল। অবন্তিকা আত্মহত্যার পর সামনে আসছে বিশ্ববিদ্যালয়টির গাফিলতি। শুক্রবার অবন্তিকার মৃত্যুর পর থেকেই আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা। শনিবার আন্দোলনে নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা দেন ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগের শিক্ষার্থী কাজী ফারজানা মিম। তিনি বলেন, আমাকে একা করে দিয়েছে শিক্ষকরা। প্রতিবাদের ফলাফলস্বরূপ আমাকে অনার্সে ফেল করে দেয়া হয়েছে। আমি যখন অভিযোগ করি তখন কোনো সেল ছিল না। এজন্য আমাকে ভিসি স্যার বরাবর অভিযোগ করতে হয়। এরপর আমার বিরুদ্ধে প্রেশার আসে। যে শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ সে আমার বাড়িতে পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। বাবা-মা অসুস্থ, তাদের ওপর প্রেশার দেয়া হয়েছে অভিযোগ প্রত্যাহার করার জন্য। আমি অভিযোগ প্রত্যাহার না করায় বিভাগে কোনো মহিলা শিক্ষক না থাকা সত্ত্বেও দরজা আটকে জোর-জবরদস্তি করা হয়েছে আমার সঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতিতে বলা হয়েছে, আমার পক্ষে যেন কোনো নিউজ না হয়। মেয়েটি সাহসী বলে মারা গিয়েছে। আমি সাহসী না বলে মারা যাইনি। হয়তো এরপর আমি মারা যাবো। আমার ক্লাসমেটটরা আমার সঙ্গে মিশতে ভয় পায়। আমি দুই বছর ধরে একা। আমার সামনে দিয়ে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় অভিযুক্ত শিক্ষক। আমার শিক্ষকরা আমার এসাইন্টমেন্ট নিতে চান না। আমাকে দুই সেমিস্টারে ফেল করানো হয়েছে। ফাইনাল ইয়ারে ভাইবায় ফেল করানো হয়েছে। আমি নন-পলিটিক্যাল শিক্ষার্থী।
তিনি বলেন, আমি শিক্ষকের কুপ্রস্তাবে রাজি হইনি এটাই আমার অন্যায়। এর আগে ইনকোর্স পরীক্ষায় আমাকে ৪০ এ ০ দেয়া হয়েছে। চেয়ারম্যান স্যার আমাকে ১০০তে ৩ দিয়েছে। আমি যে বেঁচে আছি এটা খোদা আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। আমার বাবাকে বলা হয়েছিল বিভাগ থেকে বহিষ্কার করা হবে। এই একটা শিক্ষার্থীর জন্য ক্লাসের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, তিনি এখনো বহাল আছেন। তিনি আমাকে কাজের জন্য তার অফিস রুমে ডেকে নিয়ে হ্যারাজ করেন। এটা নিয়ে আমি অনেক দিন ধরেই ভুগছি। যখন আমার দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে, আমাকে প্রতিনিয়ত ফেল করানো হচ্ছে, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু বলা হচ্ছে, আমার বাবাকে বলা হয়েছে, আপনার মেয়েকে বহিষ্কার করে দেবো। নতুন করে যে কমিটি করা হয় তার সদস্য ভিসি সাদেকা হালিম ম্যাডাম। তিনি অনেক নারীবান্ধব। কিন্তু ম্যাডামের উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও আমি এখন পর্যন্ত বিচার পেলাম না। কয়েক দফা রিপোর্ট আসা সত্ত্বেও অভিযুক্ত শিক্ষক আবু শাহেদ ইমন সুপ্রিম কোর্টে রিট করেছেন। একজন শিক্ষক কতোটা বেহায়া হলে নিজের দোষ ঢাকতে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যায়। সুপ্রিম কোর্ট থেকেও হেরে গেছেন।মানবজমিন
মিম বলেন, আমি সারাক্ষণ অনিরাপত্তায় ভুগি। আমার পরিবার অনিরাপত্তায় ভোগে। কিন্তু যারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করছে না বা প্রকাশ করছে না তারাও যে নিরাপদ, বিষয়টা তেমন না। একজন শিক্ষার্থী যখন যৌন হয়রানির অভিযোগ দেয়, তখন তার চরিত্র নিয়ে যেসব কথা বলা হয় তা প্রকাশ করা যায় না। আমার বিভাগের শিক্ষকদের সঙ্গে যখনই কেউ কথা বলেন, তখনই আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলেন।
এই ঘটনার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, কোর্ট কিন্তু যে রিট করেছিল সেটা খারিজ করে দিয়েছে। পরিতাপের বিষয় ফারজানা মিমের চেয়ারম্যানের পরীক্ষায় সে ফেল করেছে। মিম গ্রেড শিট নিয়ে দেখা করেছে। সোমবার আমরা গ্রেড শিট নিয়ে চেয়ারম্যানের সঙ্গে কাল মিটিং করবো। ফারজানা মিমের প্রতিটি বিষয় আমরা দেখবো।