জিম্মি নাবিকদের বার্তা: ভয় দেখাচ্ছে জলদস্যুরা, জাহাজে ভয়ানক অগ্নিঝুঁকি

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় বুধবার, ১৩ মার্চ, ২০২৪
  • ১৭৫ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- ভারত মহাসাগরে কেএসআরএম মালিকানাধীন এসআর শিপিংয়ের এমভি আবদুল্লাহ জাহাজটির সর্বশেষ অবস্থান সোমালিয়ায় জলদস্যুদের ডেরায় বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ জাহাজে অবস্থান করা নাবিকেরা জিম্মি হওয়ার আগে ও পরে বেশ কয়েকটি অডিও বার্তায় সার্বিক পরিস্থিতি বর্ণনা করেছেন। এসব বার্তায় জিম্মিরা নানা আশঙ্কা ও ভীতিকর পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়েছেন। উল্লেখযোগ্য অডিও বার্তাগুলো তুলে ধরা হলো:

চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খান: জিম্মি হওয়ার পর ৩ মিনিট ৩৯ সেকেন্ডের একটি অডিও বার্তা পাঠান তিনি। জলদস্যুদের কবলে পড়ার সম্পূর্ণ ঘটনাটি বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে জানিয়েছেন জাহাজ ও তাঁদের বর্তমান পরিস্থিতিও। তিনি অডিও বার্তায় বলেন, ‘আসসালামু আলাইকুম স্যার, ‘আমি চিফ অফিসার আবদুল্লাহ বলছি। আজকে (মঙ্গলবার) সকালে জাহাজের সময় আনুমানিক সাড়ে ১০টার সময়, জিএমটি ৭টা ৩০ মিনিটে একটা হাইস্পিড বোট আমাদের দিকে আসছিল। সঙ্গে সঙ্গে আমরা অ্যালার্ম দিয়ে ব্রিজে গেলাম। ওখান থেকে পরে সিটে চলে গেলাম। ক্যাপ্টেন স্যার ও সেকেন্ড অফিসার ব্রিজে ছিল। আমরা ঝিকঝাক কোর্স করলাম। তারপর এএসএস (জীবন বাঁচানোর জরুরি বার্তা) করলাম। ইউকে এমটিও (যুক্তরাজ্যের মেরিটাইম ট্রেড অপারেশন) যোগাযোগের চেষ্টা করেছি। কিন্তু তারা ফোন রিসিভ করেনি। এর মধ্যে জলদস্যুরা চলে আসে। এরপর ওরা ক্যাপ্টেন স্যার ও সেকেন্ড অফিসারকে ক্যাপচার করল। আমাদের ডাকল। আমরা সবাই গেলাম। আমাদের ডেকে কিছু গোলাগুলি করল। আমরা একটু ভয় পেয়েছিলাম। সবাই ব্রিজে বসে ছিলাম। কারও গায়ে হাত তোলেনি। শুধু সেকেন্ড অফিসারকে হালকা একটু ইয়ে করেছে।’

আতিকুল্লাহ খান বলেন, ‘তারপর ওরা আরেকটি স্পিডবোটে করে আরও কয়েকজন চলে এল। এভাবে মুহূর্তেই প্রায় ১৫–২০ জন চলে আসে। এর কিছুক্ষণ পরে একটি বড় ইরানিয়ান ফিশিং বোট নিয়ে আরও জলদস্যু চলে আসে। ইরানিয়ান ওই ফিশিং বোটটি এক মাস আগে তারা ক্যাপচার করেছিল। এটি দিয়ে তারা এক মাস ধরে নতুন কোনো জাহাজ জিম্মি করার জন্য সাগরে ঘোরাঘুরি করছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা সামনে পড়ে গেলাম। এই ফিশিং বোটের তেল শেষ হয়ে গিয়েছিল। আমাদের জাহাজে থাকা পাম্প দিয়ে কিছু ডিজেল নিয়ে ওই বোটে দিয়েছে তারা। তেল দেওয়ার পর আমাদের জাহাজে উঠে জিম্মি করা ফিশিং বোটটিকে ছেড়ে দেয়।’

‘তারপর ওরা আমাদের সেকেন্ড ও থার্ড অফিসারকে নিয়ে জাহাজের ইঞ্জিন রুমে যায়। তাদের নিয়ে গিয়ে জাহাজের ইঞ্জিন বন্ধ করে দেয়। এখন পর্যন্ত আল্লাহর রহমতে কারও কোনো ক্ষতি হয়নি। আল্লাহর রহমতে জাহাজের কোনো ক্ষতি হয়নি। আমাদেরও কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে সবাই ভয়ে আছি। ওরা খুব ভয় দেখাচ্ছে।’

বার্তায় আতিক উল্লাহ খান আরও বলেন, ‘আমাদের জাহাজে ২০–২৫ দিনের খাবার আছে। প্রায় ২০০ টনের মতো। সবাইকে বলেছি, এগুলো একটু সাবধানে ব্যবহার করতে। শেষ হয়ে গেলে বিপদে পড়ব আমরা। তবে একটা সমস্যা হচ্ছে, আমাদের জাহাজে কিছু কোল্ড কার্গো আছে। প্রায় ৫৫ হাজার টন। এগুলো একটু ডেঞ্জারাসও। ফায়ারেরও ঝুঁকি আছে। মিথেন বাড়ে। লাস্ট যখন অক্সিজেন মেপেছি তখন ৯–১০ শতাংশ লেভেল পেয়েছি। এটি নিয়মিত মনিটরিং করতে হয়। কোনো কারণে অক্সিজেন লেভেল বেড়ে গেলে বিশেষজ্ঞের মতামত নিতে হবে। এটার একটু ব্যবস্থা করবেন, স্যার। আমাদের জন্য দোয়া করবেন, স্যার। আমাদের পরিবারকে একটু দেখবেন, স্যার। সান্ত্বনা জানাবেন, স্যার। আসসালামু আলাইকুম।’

নাবিক নুর উদ্দিন: ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহতে থাকা জিম্মি নুর জাহাজটি থেকে এ বার্তা তাঁর স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌসকে পাঠিয়েছেন। পরে তাঁর স্ত্রী বার্তাটি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে পাঠান।

অডিও বার্তাটিতে নুরকে বলতে শোনা যায়, ‘এই মেসেজটা সবাইকে পাস করে দিয়ো। আমাদের কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে নিচ্ছে। ফাইনাল কথা হচ্ছে, এখানে যদি টাকা না দেয়, আমাদের একজন একজন করে মেরে ফেলবে বলছে আর কি। এদের যত তাড়াতাড়ি টাকা দেবে, এরা তত তাড়াতাড়ি আমাদের ছাড়বে বলছে। এ মেসেজটা সবদিকে পাস করে দিয়ো।’

মোহাম্মদ শামসুদ্দিনের বার্তা: মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় এমভি আবদুল্লাহতে থাকা মোহাম্মদ শামসুদ্দিনের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী ফারজানা সুলতানার শেষ কথা হয় ঠিক এভাবে, ‘জলদস্যুরা মোবাইল নিয়ে নিচ্ছে, আর কথা হবে না।’ এরপর মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় দুজনের। এর আগে মঙ্গলবার বিকেল ৪টার দিকে স্বামীর (শামসুদ্দিন) সঙ্গে প্রথম কথা হয় স্ত্রীর। তখন শামসুদ্দিন বলেছিলেন, ‘জাহাজে জলদস্যু উঠতে চেষ্টা করছে, দোয়া করিও, আমাদের জন্য দুশ্চিন্তা করিও না।’

ফারজানা উৎকণ্ঠা নিয়ে বলেন, ‘জানি না তাঁরা কেমন আছেন। খুব চিন্তা হচ্ছে তাঁদের জন্য।’

চতুর্থ প্রকৌশলী তানভীর আহমেদের বার্তা: এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের চতুর্থ প্রকৌশলী তানভীর আহমেদ মঙ্গলবার রাত ৮টায় সবশেষ মোবাইল ফোনে মা জোছনা বেগমের সঙ্গে কথা বলেন। মা জোছনা বেগমের কাছে ছেলের বার্তাটা ছিল এরকম, ‘আমাদের ওরা (জলদস্যুরা) কিছুক্ষণ পর নিয়ে যাবে। তোমরা (মা) দোয়া করো আর ওদের (ডাকাতদের) সাথে যোগাযোগ করো। কেমনে আমাদের ছাড়ানো যায় তার ব্যবস্থা করো।’

নাবিক মোহাম্মদ সাজ্জাদের বার্তা: সাজ্জাদের সঙ্গে সবশেষ ফোনে কথা হয় তাঁর বাবার, মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা ৪৭ মিনিটে। তাঁর বার্তা ছিল, ‘জলদস্যুরা মোবাইল নিয়ে ফেলবে। আর যোগাযোগ হবে না। আম্মুকে বলো, বিপদে আছি, দোয়া করতে।’ এরপর থেকে তাঁর সঙ্গে পরিবারের কারও আর কথা হয়নি বলে জানান মা শামসাদ বেগম।

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions