ডেস্ক রির্পোট:- ভয়াবহ রকমের বিপর্যয়ের মুখে কর্ণফুলী। এস আলম সুগার মিলের পোড়া চিনির ধকল সামলাতে কর্ণফুলীর মাছসহ জীববৈচিত্র্য চরমভাবে হুমকির মুখে। বর্জ্যের করুণ শিকার হওয়া কর্ণফুলীর মাছসহ প্রাণীকুল মারাত্মক রকমের অক্সিজেন স্বল্পতায় ধুকে ধুকে মরতে শুরু করেছে। জেলা মৎস্য অফিস এগার প্রজাতির মাছ ব্যাপকভাবে মারা পড়েছে বলে উল্লেখ করেছে। এটাকে দীর্ঘমেয়াদী সংকট বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। পতেঙ্গার কাছাকাছি থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত পুরো নদীই মূলত দূষিত হয়ে পড়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর বলেছে, নদীর পানি ভয়াবহ রকমের দূষিত হয়ে যাওয়ায় মাছ মারা পড়ছে।
সূত্র জানিয়েছে, এস আলম সুগার মিলে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার জেরে গত তিন ধরে আগুনে পোড়া চিনি ও ক্যামিকেলের হাজার হাজার লিটার বর্জ্য কর্ণফুলী নদীতে ফেলা হচ্ছে। দুইটি ড্রেন দিয়ে তামাটে বর্ণের এই বর্জ্য নদীতে পড়ছে। যা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। পুরো এলাকা ভরে গেছে দুর্গন্ধে। অনেকটা গুড় পোড়া গন্ধের মতো চারদিকের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। নদীর পানিতে পোড়া তেল ও ফেনার মতো চিনির বর্জ্য ভাসছে। ব্যাপকহারে বর্জ্য ফেলার ফলে কর্ণফুলী নদী বড় ধরণের বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। এরফলে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, কাঁকড়াসহ নানা জলজপ্রাণী মারা পড়ছে। গত সোমবার সন্ধ্যায় আগুন লাগার পর থেকে এস আলম গ্রুপের সুগার মিলের গুদামে থাকা বিপুল পরিমান র সুগার পুড়ে যায়। পরবর্তীতে চিনির গলিত লাভা ও কেমিক্যাল বর্জ্য কারখানার পাশ্ববর্তী কর্ণফুলী নদীতে ফেলা হচ্ছে। গতকাল সকাল থেকে নদীতে বিপুল পরিমান মরা মাছ ভাসতে দেখা যায়। আবার বহু মাছ অসুস্থ হয়ে ভাসতে থাকে। জ্যান্ত মাছগুলো হাত দিয়ে ধরা যাচ্ছিল। স্থানীয় শত শত মানুষ এসব মাছ ধরতে শুরু করে। শুধু নদীর দক্ষিণ পাড়েই নয়, নদীরে উত্তর পাড়েও মরা মাছ ভাসতে এবং ধরতে দেখা গেছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শ্রীবাস চন্দ্র চন্দ গতরাতে বলেন, অবস্থা খুবই ভয়াবহ। পতেঙ্গার ১৫ নম্বর ঘাট থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত পুরো নদীই দূষিত হয়ে পড়েছে। নিজে সন্ধ্যা পর্যন্ত কর্ণফুলী নদীতে থাকার কথা উল্লেখ করে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, আমি এগার প্রজাতির মাছ সংগ্রহ করেছি। এর বাইরেও অন্যান্য জলজ প্রাণী মারা পড়ছে। পানিতে মারাত্মকভাবে অঙিজেন স্বল্পতা দেখা দিয়েছে বলে উল্লেখ করে শ্রীবাস চন্দ্র চন্দ বলেন, আমাদের একটি দল নদীর পানির ফিজিক্যাল ও কেমিকেল কমপোনেন্টের টেস্ট করেছে। পানিতে অঙিজেন স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। দ্রবীভূত অঙিজেন দ্রুত কমে যাচ্ছে। তিনি বলেন, অঙিজেনের মাত্রা যেখানে ৪ থেকে ৬ থাকার কথা, সেটা ২.৪ এ নেমে এসেছে। এই পরিস্থিতিতে মাছের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কম বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কিছু মাছ মরে যাচ্ছে, কিছু সেন্সলেস হয়ে যাচ্ছে। শ্বাস নিতে না পেরে মাছগুলো দিশেহারা হয়ে পড়েছে। মানুষ হাত দিয়ে মাছ ধরে নিচ্ছে। জোয়ারে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতির আশা করলেও শেষতক কি হবে তা সময়ই বলে দেবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। আজ (বৃহস্পতিবার) সকাল থেকে মৎস্য অধিদপ্তরের টিম আবারো কর্ণফুলী নদীতে যাবে বলেও তিনি জানান।
পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ–পরিচালক মো. কামরুল হাসানের নেতৃত্বে একটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে কারখানার ড্রেন ও নদী থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করে। গতরাতে দৈনিক আজাদীর সাথে আলাপকালে উপ–পরিচালক কামরুল হাসান বলেন, আমরা বেশ কিছু নমুনা সংগ্রহ করেছি। এরমধ্যে কিছু নমুনা পরীক্ষার ফলাফল আমরা পেয়েছি। আরো কিছু পরীক্ষার রিপোর্ট পেতে কিছুটা সময় লাগবে। তিনি বলেন, সংগৃহীত পানির নমুনা পরীক্ষা–নিরীক্ষার পর পানির ডিও (দ্রবীভূত অঙিজেন) কমে গেছে। মানমাত্রা যেখানে ৫ থাকার কথা সেটা কমে গতকাল ছিল ১। চিনি পুড়ে কার্বন ডাই–অঙাইড তৈরি হয়েছে। যা সরাসরি নদীতে এসে পড়ায় পানিতে অঙিজেনের পরিমাণ দ্রুত কমে গেছে। দৈনিক আজাদীকে তিনি বলেন, নদীতে জোয়ার ভাটা থাকায় আশা করা যায় যে, দুচারদিনের মধ্যে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। তবে যদি বর্জ্য ফেলা অব্যাহত থাকে তাহলে পরিস্থিতি উন্নতি ঘটবে না।
পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে এস আলম গ্রুপের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, নদীতে বর্জ্য ফেলা বন্ধ করার জন্য বলা হয়েছে। বর্জ্য বালি দিয়ে চাপা দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তারা সেটা করবে বলে আশ্বস্ত করেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা সাজ্জাদুল আলম গতকাল নানা প্রজাতির বহু মাছ ধরেছেন বলে উল্লেখ করে বলেন, পরিস্থিতি ভয়াবহ। চিংড়িসহ নানা ধরণের মাছ মরে ভাসছে। তিনি বলেন, এসব কারখানার বর্জ্য নিয়মিত নদীতে ফেলা হয়। তাই নদীতে বড় কোন মাছ নেই। ছোট ছোট যেসব মাছ ছিল সেগুলোও পোড়া চিনির বর্জ্যে মারা পড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিনির দাহ্য পদার্থ যখন ৩৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে থাকে তখন বিষাক্ত কেমিক্যালে রূপ নেয়। আর সেখানে পানি ছাড়া হলে অঙিজেন ও হাইড্রোজেন কার্বন তৈরি হয়। যে কারণে কারখানায় পোড়া চিনি বিষাক্ত কেমিক্যালে রূপ নিয়ে নদী দূষণ করছে। যার কারণে নদীর মাছসহ সব ধরনের জলজ প্রাণী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
নদী গবেষক অধ্যাপক ড. মঞ্জুরুল কিবরিয়া গতরাতে বলেন, শুধু মাছ নয়, যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তাতে কোন জলজপ্রাণীই সেখানে থাকতে পারছে না। কাঁটাজাতীয় মাছ যেগুলো খুবই স্বল্প অঙিজেনে থাকতে পারে সেগুলোও ভেসে উঠছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পোড়া চিনির যে দ্রবণ নদীতে ফেলা হচ্ছে তাতে পানির অঙিজেনের পরিমাণ শূন্য হয়ে যাচ্ছে। যা জীববৈচিত্র্যের বেঁচে থাকার পথে বড় ধরনের অন্তরায়। তিনি বলেন, নদীর পানিতে কেমিকেল পড়ার কারণে পানি ঘোলা হয়ে গেছে। এতে পানিতে অঙিজেন উৎপাদনের যে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া তাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বর্জ্যের কারণে নদীর পানিতে একটি সেপটিক পরিবেশ তৈরি করেছে বলে মন্তব্য করে অধ্যাপক মঞ্জুরুল কিবরিয়া বলেন, এই আবহে কোন জলজ প্রাণী বেঁচে থাকতে পারবে না। তবে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, আর যদি বর্জ্য ফেলা না হয় তাহলে প্রতিদিনের দুবারের জোয়ার ভাটার কারণে পরিস্থিতি কয়েকদিনের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ বেলাল হায়দার পারভেজ বলেন, চিনিতে তাপ দেয়া হলে এর অঙিজেন, কার্বন ও হাইড্রোজেন তাপের সাথে বিক্রিয়া করে তরলে পরিণত হয়। এ তরল নদীর পানিতে মিশলে নদীর পানির স্বাভাবিক গুনাগুনের উপর বিরুপ প্রভাব পড়ে। কর্ণফুলী নদী এই বিরূপ প্রভাবের শিকার বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, বর্জ্যের তরল নদীর লবণাক্ত পানির সংস্পর্শে আসার ফলে পানির বিভিন্ন অজৈব পদার্থের সাথে বিক্রিয়া করে পানিকে মারাত্মকভাবে দূষিত করেছে। এতে পানির দ্রবিভূত অঙিজেন হ্রাস পেয়ে মাছসহ অপরাপর সামুদ্রিক প্রাণীর বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, দ্রবিভূত অঙিজেনের অভাবে মাছসহ অপরাপর জলজ প্রাণীর মৃত্যু ঘটছে। বেলাল হায়দার পারভেজ আরও বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতি নদীর সার্বিক ইকোসিস্টেমের মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। এই বিপর্যয় দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে বলেও তিনি আশংকা প্রকাশ করেন।
এদিকে এস আলম গ্রুপের একজন কর্মকর্তা নদীতে কিছু বর্জ্য পড়ার কথা স্বীকার করে বলেন, আমরা আগুন নিভানোর কাজে ব্যস্ত। যাতে অন্যান্য গুদামে আগুন ছড়িয়ে না পড়ে। তিনি বলেন, এটি একটি বড় ধরণের দুর্ঘটনা। এই ধরণের ঘটনার জন্য আমরা মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আমাদের ৩০টি ডাম্পট্রাক রাতে দিনে গলিত র সুগার আমাদের নিজস্ব জায়গায় ডাম্পিং করছে। বর্জ্য যাতে নদীতে না পড়ে সে জন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। এর পরও ফায়ার সার্ভিসের ছিটানো কিছু পানি গড়িয়ে নদীতে পড়েছে। এতে আমাদের দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই বলেও তিনি উল্লেখ করেন। আজাদী