বদিউল আলম মজুমদার:- গত ৭ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোট ভোটার ছিলেন ১১ কোটি ৯৬ লাখ ১৬ হাজার ৬৩৩ জন। আর মোট ভোটকেন্দ্র ছিল ৪২ হাজার ২৪টি।
এই নির্বাচনে ২৮টি রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে। নির্দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন আয়োজনের দাবিতে নির্বাচন বর্জন করে বিএনপিসহ ১৬টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল। এতে মোট প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৯৬৩। এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাতীয় পার্টিকে (জেপি) ৩২টি আসন ছেড়ে দেয়।
এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তাদের দলীয় গঠনতন্ত্রের ৪৭ (ঠ) ধারা (‘নির্বাচনে কেহ দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রার্থী হইলে দল হইতে সরাসরি বহিষ্কার’) বিবেচনায় না নিয়ে দলের অন্য নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ দেয়। সুজনের হিসাবমতে যার সংখ্যা ছিল ৩১৭। আর তাঁরাই নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন। মূলত একই দলের ও জোটের প্রার্থী হলেও পরাজিতদের অনেকেই নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলেছেন।
নির্বাচনী মাঠে বিএনপি ও তার শরিকদের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত দুই মাসে নির্বাচনী সহিংসতায় অন্তত ১৫ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ২ হাজার ২০০ জনের বেশি (প্রথম আলো, ২১ জানুয়ারি ২০২৪)।
এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২২৪টি, জাতীয় পার্টি ১১, জাসদ ১, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ১ এবং বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি ১টি। এ ছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্য থেকে ৬২ জন জয়লাভ করেন, যাঁদের মধ্যে ৫৯ জনই আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। এঁদের কয়েকজন রয়েছেন একাদশ সংসদের সদস্য। এই নির্বাচনে তথাকথিত কিংস পার্টিগুলোর ভরাডুবি ঘটেছে। নির্বাচিত ৩৩ জনের মধ্যে পরিবারতান্ত্রিক যোগসূত্র রয়েছে।
মোট ১০১ জন নারী এবং ২ জন তৃতীয় লিঙ্গের প্রার্থী এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, যার মধ্যে ২০ জন নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন নৌকা প্রতীকের ১৬ এবং স্বতন্ত্র ৪ জন। আর ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু থেকে ৮১ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হয়েছেন ১৪ জন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন নৌকা প্রতীকের ১২ এবং স্বতন্ত্র ২ জন।
অংশগ্রহণমূলক না হওয়ায় ও অধিকাংশ দল নির্বাচন বর্জন করায় দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনটি গণতান্ত্রিক নির্বাচন বলা যায় না। ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার কারণে এর মাধ্যমে জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলো, তা–ও বলা যাবে না। এর ফলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। তা ছাড়া এ সংসদে সত্যিকারের বিরোধী দল না থাকায় সরকারের ‘সমান্তরাল’ দায়বদ্ধতার কাঠামো ভেঙে পড়ল।
নির্বাচন কমিশন ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে দাবি করলেও অনেক বিশ্লেষকের মতে বাস্তবে এটি ছিল অনেক কম। নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল যে ভোটার উপস্থিতির হারের ওপরই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করবে, যার ফলে এ নির্বাচন অনেকটা গণভোটে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু সর্বশক্তি নিয়োগ করা সত্ত্বেও দৃশ্যত ভোটার উপস্থিতির হার কম হওয়ার কারণে এ গণভোটে ক্ষমতাসীনদের উত্তরণ ঘটেনি।
বিজয়ী প্রার্থীদের হলফনামা ও আয়করের তথ্যের বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যের মধ্যে ৮২ দশমিক ৬৬ শতাংশের (২৪৮ জন) শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক বা স্নাতকোত্তর। অর্থাৎ ভোটাররা উচ্চশিক্ষিতদের অধিক হারে গ্রহণ করেছেন, যা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক।
নির্বাচিত প্রার্থীদের মধ্যে বার্ষিক ৫ লাখ টাকা বা তার চেয়ে কম আয় করেন মাত্র ১৫ জন (৫.০১ শতাংশ), ১ কোটি টাকার বেশি আয় করেন ১১১ জন (৩৭.১২ শতাংশ)। অর্থাৎ কম আয়কারীদের চেয়ে বেশি আয়কারীদের নির্বাচিত হওয়ার হার তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি।
নির্বাচিত প্রার্থীর মধ্যে ২৭০ জনের (৯০ শতাংশ) সম্পদ কোটি টাকার ওপরে। ২৫ লাখ টাকার কম সম্পদের মালিক রয়েছেন মাত্র ৯ জন (৩ শতাংশ) অর্থাৎ অধিক সম্পদশালীরাই নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। এ ছাড়া লক্ষণীয় ক্ষমতাসীনদের হু হু করে সম্পদ ও নিট সম্পদ বাড়ার বিষয়টি। যেমন ২০১৪ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে বিজয়ী ১২৫ জন সংসদ সদস্যের গড় সম্পদ বেড়েছে ১২৫ শতাংশ, নিট সম্পদ বেড়েছে ৩৩৮ শতাংশ।
প্রসঙ্গত, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের গড় আয় ১৯ দশমিক ৮১ লাখ টাকা হলেও বিএনপির প্রার্থীদের গড় আয় ছিল ৩২ দশমিক ৫১ লাখ টাকা। পক্ষান্তরে ২০১৪ সালে যেখানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের গড় আয় ছিল ১ দশমিক ৪১ কোটি টাকা, সেখানে বিএনপির প্রার্থীদের গড় আয় ছিল মাত্র ৫৪ দশমিক শূন্য ৩ লাখ টাকা। তাই এটা সুস্পষ্ট যে ক্ষমতার সঙ্গে অর্থনীতির জাদুর কাঠি জড়িয়ে আছে।
নবনির্বাচিত সদস্যদের অধিকাংশের পেশাই (৬৬.৬৭ শতাংশ বা ২০০ জন) ব্যবসা। উল্লেখ্য, ১৯৫৪ সালে সংসদে ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্ব মাত্র ৪ শতাংশ হলেও ১৯৭৩ সালে তা এসে দাঁড়ায় ১৮ শতাংশ, ১৯৭৯ সালে ২৪ শতাংশ, ১৯৯৬ সালে ৪৩ শতাংশ, ২০০১ সালে ৫৮ শতাংশ, ২০০৮ সালে ৫২ শতাংশ, ২০১৪ সালে ৬২ শতাংশ, ২০১৮ সালে ৬৫.৩৩ শতাংশে, যা ক্রমবর্ধমান বিরাজনৈতিকীকরণেরই প্রতিফলন। রাজনীতির এমন ব্যবসায়ীকরণের কারণে চরম স্বার্থের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয় এবং রাষ্ট্র পরিচালিত হয় মূলত ব্যবসায়ীদের স্বার্থে।
উল্লেখ্য, হলফনামায় আয় ও সম্পদের যে তথ্য উপস্থাপিত হয়, তাতে প্রকৃত চিত্র ওঠে আসে না। কারণ সম্পদের ক্ষেত্রে বাজারমূল্যের পরিবর্তে ক্রয়মূল্য প্রদর্শন করা হয়। আর সম্পদ ও আয় উভয় ক্ষেত্রেই তথ্য গোপনের বিষয়টি সর্বজনবিদিত। অথচ হলফ করে মিথ্যা তথ্য দেওয়া বা তথ্য গোপন করা ১৮৬০ সালের ১৮১ ধারা দণ্ডবিধি অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যের মধ্যে মাত্র ১৩৫ জনের (৪৫ শতাংশ) ঋণ ও দায়দেনা রয়েছে। আর করদাতার হার ৭৭ শতাংশ (২৩১ জন), যা পূর্ববতী সংসদের তুলনায় ১৩.৯২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে ৭৫ (২৫ শতাংশ) প্রার্থী আয়কর বিবরণীর তথ্য না দিয়ে শুধু আয়কর প্রদানের রসিদ বা প্রত্যয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
অথচ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৪৪কক ধারা অনুযায়ী প্রার্থীদের মনোনয়নপত্রের সঙ্গে ‘সর্বশেষ দাখিলকৃত আয়কর রিটার্নের অনুলিপি সংযুক্ত করিতে হইবে।’ ফলে যেসব প্রার্থী মনোনয়নপত্রের সঙ্গে আয়কর বিবরণী জমা দেননি, তাঁদের মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়া উচিত ছিল, যা না করা হলো নির্বাচন কমিশনের একটা বড় ব্যর্থতা।
পরিশেষে, অংশগ্রহণমূলক না হওয়ায় ও অধিকাংশ দল নির্বাচন বর্জন করায় দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনটি গণতান্ত্রিক নির্বাচন বলা যায় না। ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার কারণে এর মাধ্যমে জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলো, তা–ও বলা যাবে না। এর ফলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। তা ছাড়া এ সংসদে সত্যিকারের বিরোধী দল না থাকায় সরকারের ‘সমান্তরাল’ দায়বদ্ধতার কাঠামো ভেঙে পড়ল।
ফলে সরকারের স্বচ্ছ-জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন রোধ এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ রুদ্ধ হয়ে যেতে পারে। এমনই পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি প্রকাশিত ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রকাশিত দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের অবনতি আমাদের শঙ্কিত না করে পারে না।
এ ছাড়া একতরফাভাবে অনুষ্ঠিত হওয়ায় কারণে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ, যা মাননীয় প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিজেই স্বীকার করেছেন। এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পরিবেশ তৈরি এবং এর মাধ্যমে একটি সমঝোতায় পৌঁছানোর উদ্যোগ নেওয়া দেশ ও গণতন্ত্রের স্বার্থে জরুরি।
● বদিউল আলম মজুমদার সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)