শিরোনাম

বেগমপাড়া ও সেকেন্ড হোম: পাচার করা অর্থে ‘অবৈধ স্বর্গ’

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় শনিবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪
  • ১৮৪ দেখা হয়েছে

‘বেগমপাড়া’র বেগম সাহেবাদের জন্য কারও কোনো সমবেদনা জাগে না, কারণ তাঁরা স্বেচ্ছায় এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বিদেশে ‘হিজরত’ করেছেন অর্থ পাচারের
সক্রিয় সহযোগী হিসেবে।
ড. মইনুল ইসলাম:- সাম্প্রতিককালে টরন্টোর ‘বেগমপাড়া’ সাধারণ বাংলাদেশি জনগণের কাছে ভুলভাবে বহুল পরিচিতি পেয়েছে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অবৈধভাবে পাচার করা অর্থে গড়ে তোলা প্রাসাদসম বাড়ির একটি পাড়া হিসেবে। অনেকেই শুনে অবাক হবেন যে ‘বেগমপাড়া’ বলে কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থান টরন্টো বা এর আশপাশের শহরগুলোর কোথাও নেই। এই ‘বেগমপাড়া’ শব্দটি নেওয়া হয়েছে একজন ভারতীয় ডকুমেন্টারি ফিল্মমেকারের একটি ফিল্ম ‘বেগমপুরা: দ্য ওয়াইভস’ কলোনি’ থেকে। ওই ফিল্মমেকার এই সাড়াজাগানো ফিল্মটি নির্মাণ করেছিলেন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কর্মরত ভারতীয় ক্রমবর্ধমানসংখ্যক পেশাজীবীর একটি বিনিয়োগের ওপর আলোকপাতের জন্য।

এসব উচ্চ বেতনের পেশাজীবী মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত থাকলেও তাঁরা তাঁদের স্ত্রী ও সন্তানদের মধ্যপ্রাচ্যে বসবাসের জন্য নিতে পারতেন না, কিংবা আগ্রহী ছিলেন না। তাই তাঁরা কানাডার অভিবাসন নিয়ে টরন্টোর বিভিন্ন স্থানে এবং এর আশপাশের শহরগুলোয় বাড়িঘর কিনে স্ত্রী ও সন্তানদের আবাসস্থল গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করেছিলেন বিংশ শতাব্দীর আশির দশক থেকে। এভাবে গড়ে উঠেছিল ‘বেগমপুরা’গুলো, যেখানে পুরুষ অভিভাবকের পরিবর্তে নারী অভিভাবকেরাই সন্তানদের নিয়ে বসবাস শুরু করেছিলেন। এভাবে খণ্ডিত পরিবারের জীবনযাত্রা নিশ্চয়ই বঞ্চনা ও বেদনায় ভারাক্রান্ত হওয়ার কথা। তাঁদের এহেন বঞ্চনা, একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতাকে হাইলাইট করার জন্যই ‘বেগমপুরা’ ফিল্মটি নির্মিত হয়েছিল।

কিন্তু বাংলাদেশিদের গড়ে তোলা ‘বেগমপাড়া’ এর চেয়ে একেবারেই আলাদা বৈশিষ্ট্য ধারণ করছে। টরন্টো নগরীর বিভিন্ন এলাকা ড্যানফোর্থ, নর্থ ইয়র্ক, রিচমন্ড হিল এবং টরন্টোর আশপাশের ছোট ছোট শহর মিসিসওগা, হ্যামিল্টন, গুয়েল্ফ ও ওন্টারিও লেকের পাড়ঘেঁষা উপশহরগুলোর প্রাসাদসম অট্টালিকা বা ‘লেকশোর অ্যাপার্টমেন্ট’ কিনে গড়ে তোলা হয়েছে বাংলাদেশি ধনাঢ্য ব্যক্তিদের ‘বেগমপাড়া’। কোনো সুনির্দিষ্ট এলাকার নাম ‘বেগমপাড়া’ দেওয়া হয়নি, টরন্টো নগরীর আওতাভুক্তও নয় এসব বাড়িঘরের বেশির ভাগের অবস্থান। এসব বাড়ি কিংবা অ্যাপার্টমেন্ট সাধারণ কানাডীয় নাগরিক কিংবা কানাডায় বসবাসরত বাংলাদেশি অভিবাসীদের ক্রয়ক্ষমতার আওতায় থাকা বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট নয়, এগুলোর দাম প্রায় এক মিলিয়ন ডলার (১০ কোটি টাকার সমমূল্যের) থেকে শুরু করে দুই-তিন মিলিয়ন ডলার (২০-৩০ কোটি টাকার সমমূল্যের) হয়ে থাকে। কানাডায় বসবাসকারী ও কর্মরত বাংলাদেশি অভিবাসীরা সাধারণত তিন লাখ ডলার থেকে ছয় লাখ ডলার দামের বাড়ি কানাডার মর্টগেজ সিস্টেমের সুবিধা নিয়ে সহজেই কিনতে পারেন। এ জন্য যেসব শর্ত পালন করতে হয়, সেগুলো অত্যন্ত সহজ, বিশেষ করে স্বামী-স্ত্রী উভয়েই চাকরিজীবী হলে ভাড়াবাড়িতে বা অ্যাপার্টমেন্টে থাকার জন্য যে মাসিক ভাড়া গুনতে হয়, তার চেয়েও সহজ শর্তে এবং কম মাসিক মর্টগেজ-কিস্তিতে কানাডায় বাড়ি কিংবা অ্যাপার্টমেন্ট কেনা সম্ভব হওয়ায় বেশির ভাগ বাংলাদেশি অভিবাসী যত দ্রুত সম্ভব বাড়ি কিংবা অ্যাপার্টমেন্ট কেনাকেই অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী ব্যবস্থা বিবেচনা করে থাকেন। এসব বাড়ির ‘ডাউন পেমেন্ট’ বাড়ির দামের ৫ থেকে ১৫ শতাংশ হয়ে থাকে, মর্টগেজের সুদের হারও ৩-৫ শতাংশের বেশি হয় না। এসব বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্টের মালিকেরা ‘বেগমপাড়া’র ধনাঢ্য বাসিন্দা নন, কানাডায় বসবাসকারী সাধারণ অভিবাসীরা বরং ‘বেগমপাড়া’কে ঘৃণা করে থাকেন। কারণ পুঁজি পাচারকারী ধনাঢ্য বাংলাদেশিরা টরন্টোর রিয়েল এস্টেটের বাজারে অসহনীয় মূল্যস্ফীতির তাণ্ডব সৃষ্টির জন্য দায়ী। এই ধনাঢ্য মালিকেরা সরাসরি নগদ অর্থে বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট কিনে থাকেন, তাঁরা মর্টগেজ সিস্টেমের সহায়তা নেন না। এক দশকে টরন্টো নগরী ও আশপাশের শহরগুলোয় বাড়ি ও অ্যাপার্টমেন্টের দাম দ্বিগুণের বেশি বেড়ে গেছে ‘বেগমপাড়া’র মালিকদের অর্থের তাণ্ডবে, যে জন্য সম্প্রতি কানাডীয় সরকার এভাবে বাড়ি কেনার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। বাংলাদেশের আমদানির ওভারইনভয়েসিং, রপ্তানির আন্ডারইনভয়েসিং এবং রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না এনে বিদেশে বাড়িঘর কেনার পাশাপাশি সাম্প্রতিককালে বহুল-ব্যবহৃত হুন্ডি পদ্ধতিতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের রেমিট্যান্সের অর্থ (বৈদেশিক মুদ্রা) যাঁরা হুন্ডিওয়ালাদের কাছ থেকে কিনে বিদেশে পুঁজি পাচারের সক্ষমতা রাখেন, তাঁরাই ‘বেগমপাড়া’র বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট কিনে থাকেন। ‘বেগমপাড়া’র বেগম সাহেবাদের জন্য কারও কোনো সমবেদনা জাগে না, কারণ তাঁরা স্বেচ্ছায় এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বিদেশে ‘হিজরত’ করেছেন অর্থ পাচারের সক্রিয় সহযোগী হিসেবে। অদূর ভবিষ্যতে সাহেবও হয়তো বিদেশে পালিয়ে যাবেন।

মালয়েশিয়ার ‘সেকেন্ড হোম’ কর্মসূচিও গৃহীত হয়েছে ধনাঢ্য বিদেশিদের বিনিয়োগকে আকর্ষণ করার উদ্দেশ্যে। ইতিমধ্যেই প্রায় পাঁচ হাজার বাংলাদেশি ওখানে পুঁজি পাচার করে বাড়িঘর ও ব্যবসাপাতি গড়ে তুলেছেন। এসব বাড়িতে বেগম সাহেবারা ছেলেমেয়ে নিয়ে বসবাস করেন, মাঝে মাঝে সাহেব গিয়ে বেড়িয়ে আসেন। মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে অল্প দূরত্বে অবস্থিত হওয়ায় যাতায়াত খরচ তেমন বেশি পড়ে না, এটাই সেকেন্ড হোমের বিশেষ আকর্ষণ।

কয়েক বছর আগে একজন বাংলাদেশি ধনকুবেরের পুত্রের জন্মদিন পালনের অনুষ্ঠানে প্লেন ভর্তি করে অতিথিদের মালয়েশিয়ায় যাতায়াতের বন্দোবস্ত করার খবরটি ফলাও করে সংবাদপত্রে ছাপা হওয়ায় প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। বলা হচ্ছে, সেকেন্ড হোম কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারী বিদেশিদের মধ্যে বাংলাদেশিরাই ‘চ্যাম্পিয়ন’। এসব ধনাঢ্য ব্যক্তির দেশে প্রাসাদসম বাড়ি, একাধিক গাড়ি এবং ব্যবসাপাতি থাকা সত্ত্বেও দেশ থেকে তাঁরা পুঁজি পাচার করেছেন।

বিশ্বের নানা দেশে প্রায় ১ কোটি ৫৫ লাখ বাংলাদেশি অভিবাসী বসবাস করছেন বলে পত্র-পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। তাঁদের কতজন কর্মরত রয়েছেন, সেটা জানা খুবই কঠিন। তাঁদের মধ্যে মাত্র কয়েক লাখ ‘সপরিবার অভিবাসী’ হিসেবে বিদেশে বসবাস করছেন, যাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইউরোপের অন্যান্য দেশে এবং মালয়েশিয়ায় বসবাস করছেন বলে ধারণা করা হয়। আমি যখন আমার গবেষণায় ‘পুঁজি পাচার’কে ফোকাসে নিয়ে আসি, তখন এই আনুমানিক ১ কোটি ৫৫ লাখ বাংলাদেশি অভিবাসীর অতিক্ষুদ্র অংশকে টার্গেট করে আমার অনুসন্ধান পরিচালিত হয়। সংখ্যায় এসব পুঁজি পাচারকারী কয়েক হাজারের বেশি হবে না। দুর্নীতিবাজ সিভিল আমলা, প্রকৌশলী, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিক, বিত্তবান ব্যবসায়ী কিংবা মার্জিনখোর রাজনীতিবিদ হিসেবে বাংলাদেশের সমাজের উচ্চ-মধ্যবিত্ত, উচ্চ-বিত্তশালী ও ‘এলিট’ অংশে তাঁদের অবস্থান।

অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে তাঁরা দেশ থেকে বিদেশে অভিবাসী হতে বাধ্য হচ্ছেন বলা যাবে না। ‘এলিট’ গোষ্ঠীর মধ্যে অবস্থান সত্ত্বেও আরও বেশি সুখ-শান্তির (কল্পনার স্বর্গীয় সুখের) আশায় তাঁরা বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন, হয়তো বাংলাদেশেও তাঁদের প্রাসাদসম অট্টালিকা রয়েছে। আগেই বলেছি, তাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠই দুর্নীতিবাজ আমলা, ব্যবসায়ী-শিল্পপতি (উল্লেখযোগ্যসংখ্যক গার্মেন্টসের মালিক), প্রকৌশলী ও রাজনৈতিক নেতা। তাঁদের বেশির ভাগের বৈশিষ্ট্যগত ‘কমন ফ্যাক্টর’ হলো তাঁদের সিংহভাগ ‘কালোটাকার মালিক’, ভালো মানের শহুরে সম্পত্তির মালিক কিংবা শিল্প-কারখানা-ব্যবসায়ের মালিক হওয়ায় তাঁরা দেশের ব্যাংকঋণ পাওয়ার ক্ষমতা রাখেন। আমি আমার কলামগুলোয় তাঁদের ‘জাতির এক নম্বর দুশমন’ আখ্যায়িত করে চলেছি।

তাঁরা যদি নিজেদের বাপ-দাদার সূত্রে প্রাপ্ত এ দেশীয় সম্পদ-সম্পত্তি বিক্রি করে বিদেশি নাগরিকত্বের আশায় অভিবাসন-প্রক্রিয়ায় শামিল হন, তাহলে তাঁদের ‘জাতির দুশমন’ আখ্যায়িত করা যৌক্তিক হতো না। অথবা নিজেদের সারা জীবনের বৈধ উপার্জনের মাধ্যমে প্রাপ্ত আয় থেকে উদ্ভূত সঞ্চয় ও বিনিয়োগের সূত্রে প্রাপ্ত অর্থ-সম্পদ বা সম্পত্তি বিক্রি করে যদি কেউ অভিবাসনের মাধ্যমে পরে বিদেশে সপরিবার বসবাসের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করেন, তাঁকেও গালমন্দ করা সঠিক হবে না। কিন্তু আমার গবেষণার টার্গেট তাঁরা নন। আমি যাঁদের ‘জাতীয় দুশমন’ অভিহিত করছি, তাঁরা দেশের ব্যাংকিং সিস্টেমকে অপব্যবহার করে ব্যাংকঋণ নিয়ে তা বছরের পর বছর ফেরত না দিয়ে বিদেশে পাচার করে চলেছেন। তাঁরা ব্যাংকগুলোর ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ হিসেবে ঋণ-লুটপাটকারীর ভূমিকা পালন করছেন। তাঁরা রাজনীতিক পরিচয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন করে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী।

তাঁরা ৫৩ বছরের স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ‘এক নম্বর সমস্যা’ দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের মাধ্যমে অর্থ-বিত্তের মালিক হয়ে তাঁদের অবৈধ অর্থ বিদেশে পাচার করে কানাডার টরন্টোর ‘বেগমপাড়া’, অস্ট্রেলিয়ার সিডনির ফ্রেটারনিটি এবং মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম বানাচ্ছেন। তাই ‘বেগমপাড়া’ ও ‘সেকেন্ড হোম’কে বাংলাদেশ থেকে ‘পলাতক পুঁজির প্রধান গন্তব্য’ হিসেবে চিহ্নিত করে দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের প্রধান অনুঘটক কিংবা ‘প্রতীক’ বলাই সমীচীন।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ।

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.com
Website Design By Kidarkar It solutions