ডেস্ক রির্পোট:- স্থানীয় বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণে চট্টগ্রামের পাহাড়ি মাটির চাহিদা বরাবরই বেশি। তাই একের পর এক পাহাড় কেটে সেই মাটি দিয়ে তৈরি হচ্ছে নির্মাণ উপকরণসামগ্রী। ইটভাটায় সে মাটি পোড়াতে ব্যবহার হচ্ছে সংরক্ষিত বন থেকে পাচার করে আনা কাঠ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রামে ইটভাটা রয়েছে প্রায় ৪১০টি। এর মধ্যে ৭৫-৮০ শতাংশই অবৈধ বলে জানিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। এদিকে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী অবৈধ এসব ইটভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা থাকলেও তা বাস্তবায়ন হয় না। কেননা চট্টগ্রামের গহিন এলাকায় সরকারি খাসভুক্ত বা বেসরকারি মালিকানাধীন পাহাড়ের মাটি কেটে বিক্রির সঙ্গে জড়িত মূলত স্থানীয় প্রভাবশালীরা। মাঝে মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালালেও কেবল জরিমানাতেই সীমাবদ্ধ প্রশাসন।
পরিবেশসংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রামের পাহাড় ও সংরক্ষিত বন হলো দেশের ঐতিহ্য ও ঐশ্বর্যের প্রতীক, যা এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। নানা উন্নয়নকাজে কৃষিজমির টপ সয়েল থেকে শুরু করে পাহাড়ের মাটি ও বনের গাছ সবই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এগুলো রক্ষায় যাদের দায়িত্বশীল ভূমিকা নেয়ার কথা তারা প্রতি বছর কেবল আশ্বাসই দিয়ে যাচ্ছেন। অথচ বন-পাহাড়কে সংরক্ষণের উদ্যোগ না নিলে চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রাণ-প্রকৃতি অচিরেই নষ্ট হয়ে যাবে।
এ বিষয়ে পরিবেশবিদ ইদ্রিশ আলী বলেন, ‘নির্মাণকাজে কৃষিজমির টপ সয়েল থেকে শুরু করে পাহাড়ের পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ মাটির ব্যবহার বাড়ছে। ইটভাটায় ভালো মানের ইট তৈরিতে এ মাটির চাহিদা বেশি, দামও ভালো পাওয়া যায়। অথচ একটা জমির এক ফুট টপ সয়েল তৈরি হতে সময় লেগে যায় ১৫-২০ বছর। আবার পাহাড়ি মাটি এতটাই ভালো যে এখন সেখানে ফলের চাষ হচ্ছে। সে মাটিতে আবার ভালো মানের ইট তৈরি হয় বলে ব্যবসায়ীদের কাছে এর বেশ চাহিদা। ইটভাটায় পাহাড়ের মাটির পাশাপাশি সংরক্ষিত বনের কাঠ ব্যবহারও বাড়ছে। এতে চট্টগ্রামের পাহাড়ের ঐতিহ্যের সঙ্গে ঐশ্বর্যের ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।’
জানা গেছে, চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, ফটিকছড়িসহ অনান্য এলাকায় সড়ক নির্মাণ ও ইটভাটায় যে মাটি ব্যবহার করা হয় তার বেশির ভাগই পাহাড় বা টিলা থেকে কেটে আনা। এর মধ্যে ফটিকছড়িতে সড়ক নির্মাণে সংরক্ষিত বনের মাটি ব্যবহার করা হয়েছে, এমন প্রমাণও পাওয়া গেছে। তাছাড়া সাতাকানিয়া ও লোহাগাড়া এলাকায় থাকা পাহাড়ের মাটি গুণে-মানে ভালো হওয়ায় ইটভাটায় এর বেশ চাহিদা। এ অঞ্চলের টিলা বা পাহাড়গুলো সরকারি খাসজমি হওয়ায় প্রভাবশালীরা সহজেই কেটে এনে মাটি বিক্রি করছে। এসব এলাকার সংরক্ষিত বনের গাছও ইটভাটায় লাকড়ি হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (জেলা) মো. ফেরদৌস আনোয়ার বলেন, ‘চট্টগ্রামের বিভিন্ন উন্নয়ন অবকাঠামো কিংবা ইটভাটায় পাহাড় বা টিলার মাটি ব্যবহার হচ্ছে। সম্প্রতি আমরা বেশ কয়েকটি অভিযানে ইটভাটা, সড়ক নির্মাণসহ বিভিন্ন কনস্ট্রাকশনকাজে পাহাড় বা টিলার মাটি ব্যবহারের প্রমাণ পেয়েছি। জড়িতদের জরিমানাও করেছি।’ তবে কাঠের বিষয়টি যেহেতু বন বিভাগের আওতাধীন তাই এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি পরিবেশ অধিদপ্তরের এ কর্মকর্তা।
পরিবেশ অধিদপ্তরের সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম জেলায় মোট ইটভাটা আছে ৪১০টি, যার মধ্যে ফিক্সড চিমনির ইটভাটা আছে ২৭০টি, জিগজ্যাগ ১৩০ এবং হাইব্রিড ও অটো টানেল আছে প্রায় ১০টি। এসব ইটভাটার মধ্যে ৭০-৮০ শতাংশই অবৈধ বলে জানিয়েছে সরকারে এ সংস্থাটি।
এদিকে ইটভাটার বিকল্প হিসেবে ব্লক ব্যবহারের নির্দেশনা দিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। তবে চট্টগ্রাম জেলায় ব্লকের ইট কারখানা আছে কেবল সাতটি, যার মধ্যে মিরসরাইয়ে প্রিয়া ব্রিকস, সীতাকুণ্ডে ফকরিস ব্লক এবং কর্ণফুলী উপজেলায় দুটি, সাতকানিয়া ও চন্দনাইশ উপজেলায় আরো তিনটি গড়ে উঠেছে।
এদিকে ফটিকছড়িতে গত দেড় মাসে সংরক্ষিত বনের গাছ কাটার অপরাধে স্থানীয় প্রশাসন বেশ কয়েকটি মামলা করেছে। এমনকি বনের কাঠ পাচারের সময় গত কয়েক মাসে পাঁচ-ছয়টি চালান আটক করেছে বন বিভাগ। এ বিষয়ে বন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, সংরক্ষিত বন এলাকা পাহারার পাশাপাশি অবৈধভাবে অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চলছে। বন সংরক্ষকরা চেষ্টা করছেন যাতে বনের কাঠ কোনোভাবে কেউ পাচার করতে না পারে। তবে সীমিত লোকবল দিয়ে এত বড় বন তদারক করা কঠিন বলেও জানান তারা।বণিক বার্তা