ডেস্ক রির্পোট:- ‘ওটিতে ঢোকার আগে আয়হাম আমাকে বলছিল- একটু ভয় লাগছে। আমি বলেছিলাম, বাবা কোনো সমস্যা নেই, আল্লাহ ভরসা। এরপর ওটিতে ঢুকলো, আর সব শেষ। আমার ছেলে খুব উৎফুল্লভাবে ওটিতে ঢুকেছিল, আর ফিরে এলো না।’ গতকাল সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গের সামনে ছেলের লাশের জন্য অপেক্ষারত বাবা ফখরুল আলম এসব কথা বলে বার বার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। মঙ্গলবার রাতে মালিবাগের জে এস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে খতনা করাতে এসে মারা যায় মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী আহনাফ তাহমিন আয়হাম (১০)। শিশুটিকে পুরো অজ্ঞান করে খতনা করার পর তার মৃত্যু হয়।
হাসপাতাল মর্গের সামনে অপেক্ষারত শিশুটির বাবা ফখরুল আলম বলেন, ‘আমরা চিকিৎসককে বলেছিলাম যেন ফুল অ্যানেস্থেসিয়া না দেয়া হয়। তারপরও আমার ছেলের শরীরে ফুল অ্যানেস্থেসিয়া পুশ করেন ডা. মুক্তাদির। আমি বারবার তাদের পায়ে ধরেছি। এরপরও আমার সন্তানকে অ্যানেস্থেসিয়া দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এই মৃত্যুর দায় মুক্তাদিরসহ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সবারই।
আমি তাদের কঠোর শাস্তি চাই।’ তিনি বলেন, আমার ছেলের মৃত্যু হয়েছে তবুও আমি চাইনি মামলা করার জন্য। মামলার দরকার নেই। লাভ কী হবে? এ দেশে কোনো বিচার আছে? পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে মামলা করতে হবে, তারা পদক্ষেপ নেবেন। তাই মামলা করেছি।’ ক্ষোভ প্রকাশ করে ফখরুল আলম বলেন, আয়হাম অসুস্থ ছিল, হেঁটে যেতে পারেনি, ওর মৃত্যুর পর এখন এসব বিভিন্ন ধরনের কথা ছড়ানো হচ্ছে। আমার সুস্থ ছেলে। সপ্তাহে পাঁচ দিন স্কুলে যেত। তারপর স্কাউটেও জয়েন করেছে, সে ক্লাস ক্যাপ্টেন। সে যদি অসুস্থ হতো, তাহলে তো এগুলোতে জয়েন করতো না।’
এর আগে মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর রাজধানীর মালিবাগের জে এস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে তাহমিন আয়হামের (১০) সুন্নতে খতনা করাতে যান বাবা ফখরুল আলম ও মা খায়কুন নাহার চুমকি। রাত আটটার দিকে অর্থোপেডিক ও ট্রমা সার্জন ডা. এস এম মুক্তাদিরের তত্ত্বাবধানে শিশু আয়হামের খতনা করানোর জন্য অ্যানেস্থেসিয়া দেয়া হয়। এরপর আর ঘুম ভাঙেনি আয়হামের। ঘণ্টাখানেক পর হাসপাতালটির পক্ষ থেকে শিশুটিকে মৃত ঘোষণা করা হয়। পরে পুলিশ গিয়ে লাশ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠায়।
অশ্রুসিক্ত হয়ে নিহত আয়হামের চাচা ফয়সাল জানান, আমার ভাতিজাকে মঙ্গলবার রাত আটটার দিকে অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হয়। বেশ কিছুক্ষণ যাওয়ার পরে তার জ্ঞান ফিরছিল না। আমরা বার বার জানতে চাচ্ছিলাম কেন আইহামের জ্ঞান ফিরছে না। ডাক্তার আমাদেরকে প্রতিবারই বলেছেন- কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরে আসবে। তারপরে আমরা থানায় খবর দিই। থানা থেকে পুলিশ এসে আমার ভাতিজার নিথর মরদেহ উদ্ধার করে। চাচা ফয়সাল বলেন, আমার ভাতিজা মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, আমাদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা জেলার চান্দিনা থানার আলোকের চর গ্রামে। বর্তমানে খিলগাঁও রেলগেট এলাকার ২৯০/১-এ নম্বর বাসায় পরিবার নিয়ে থাকেন। ঘটনাস্থলে গিয়ে আহনাফের লাশ উদ্ধারকারী হাতিরঝিল থানার পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এস আই) মোহাম্মদ রুহুল আমিন জানান, আমরা মঙ্গলবার রাত সাড়ে নয়টার পর খবর পেয়ে মালিবাগ ডিআইটি রোডের জে এস হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটার থেকে আয়হামের মরদেহ উদ্ধার করি। আইনি প্রক্রিয়া শেষে মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়। তিনি জানান, আমরা যখন শিশুটির লাশ দেখি তখন তার বাম হাতের তালুর উল্টো পাশে ক্যানোলা করা ছিল। সুন্নতে খতনা করানো অবস্থায় তাকে দেখা গেছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের রিপোর্ট পেলে মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যাবে।
এ বিষয়ে হাতিরঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আওলাদ হোসেন বলেন, খতনা করাতে গিয়ে আয়হামের মৃত্যুর ঘটনায় তার বাবা মোহাম্মদ ফখরুল আলম বাদী হয়ে থানায় মামলা করেছেন। ডা. এস এম মুক্তাদিরসহ তিন জনের নাম উল্লেখসহ আরও ৫ জন অজ্ঞাতনামার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন তিনি। ইতিমধ্যেই জে এস হাসপাতালের পরিচালক চিকিৎসক এস এম মুক্তাদির ও চিকিৎসক মাহাবুব মোরশেদকে গ্রেপ্তার করে সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করা হয়েছে। বুধবার তাদেরকে আদালতে হাজির করে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হাতিরঝিল থানার উপ-পরিদর্শক রুহুল আমিন রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের পরই বিস্তারিত জানা যাবে। এর আগেই জে এস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বলেও জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা। অভিযুক্ত চিকিৎসক মুক্তাদির বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অর্থোপেডিক বিভাগের বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচয় দিয়ে চিকিৎসা দিতেন।
এদিকে আয়হামের মৃত্যুর ঘটনায় বুধবার দুপুরে অভিযান চালিয়ে জেএস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টার সিলগালা করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ঘটনাস্থলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আবু হোসেন মো. মইনুল আহসান জানান, অ্যানেস্থেসিয়া দেয়ার জন্য হাসপাতালের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। কিন্তু এই হাসপাতালের শুধুমাত্র ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনুমোদন আছে। তাদের অ্যানেস্থেসিয়া দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে শিশু আয়হামের মৃত্যুর ঘটনায় শোক ও দুঃখ প্রকাশ করছি। আমরা জেনেছি, ডা. ইশতিয়াক নামক একজন এই খতনার সার্জন ছিলেন, আর ডা. মাহবুব মুর্শেদ শিশুটির অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট ছিলেন। অভিযোগ অনুসারে অ্যানেস্থেসিয়া দেয়ার সময় শিশুটিকে অজ্ঞান করার পর আর তার জ্ঞান ফিরেনি। পরবর্তীতে আজ (গতকাল) অভিযান চালিয়ে প্রতিষ্ঠানটি সিলগালা করা হয়েছে। ডা. মইনুল বলেন, হাসপাতালটির সমস্ত তথ্য আমাদের হাতে এসেছে। আমরা সেগুলো পর্যবেক্ষণ-পর্যালোচনা করছি। যতটুকু পেয়েছি, প্রতিষ্ঠানটির হাসপাতাল কার্যক্রম চালানোর কোনো অনুমোদন ছিল না। তবে তাদের ডায়াগনস্টিক কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদন রয়েছে। সুতরাং তারা যদি কোনো রোগীকে অ্যানেস্থেসিয়া দিয়ে থাকে, সেটি অন্যায় করেছে। আমরা আরও তদন্তের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেব। আর যিনি অপারেশন করেছেন, তার বিরুদ্ধে আমরা আইন অনুযায়ী বিভাগীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি। তিনি বলেন, ময়নাতদন্তের পর বিশেষজ্ঞদের কাছে জেনে তারপর বলা যাবে আসলে কেন এই ঘটনা ঘটলো, কী ভুল হয়েছে। কঠোর ব্যবস্থা না নেয়ায় বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি- এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. মইনুল বলেন, ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ঘটনার পর আমরা হাসপাতালটি বন্ধ করেছি। মামলা চলমান আছে। এই ঘটনার পর আমরা সারা দেশে এক হাজার ২৭টি ক্লিনিক বন্ধ করেছি। ইউনাইটেডের যদি কোনো প্রকার গাফিলতি থাকে অবশ্যই মামলার মাধ্যমে বিচার হবে। এসময় ল্যাবএইড হাসপাতালের ঘটনার বিষয়ে তিনি বলেন, গত পরশুদিন ল্যাবএইড হাসপাতালে এন্ডোস্কোপি করতে গিয়ে একজন রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এটা আমরা অবগত আছি। গত মঙ্গলবার রাতে আমাদের একটি দল হাসপাতালটি পরিদর্শন করেছে। আমরা সকল তথ্য- উপাত্ত সংগ্রহ করেছি। আরও তথ্য চাওয়া হয়েছে। সেগুলো বৃহস্পতিবার পাওয়া যাবে। সেক্ষেত্রেও যদি কোনো ভুল থেকে থাকে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
অপরদিকে আয়হামের মৃত্যুর ঘটনায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী প্রফেসর ডা. সামন্ত লাল সেন এক বিশেষ বিবৃতিতে জানিয়েছেন, ‘এই ঘটনায় আমি অত্যন্ত মর্মাহত। কিছুদিন আগেও এমন একটি ঘটনা আমরা লক্ষ্য করেছি। সে ঘটনায় আমরা উপযুক্ত ব্যবস্থাও নিয়েছি। এরকম আর কারও কোনোরকম দায়িত্বে অবহেলা বা গাফিলতি কোনোভাবেই মেনে নেয়া হবে না। দোষী প্রমাণিত হলে স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির বিরুদ্ধে শুধু কঠোর ব্যবস্থা নয়, ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলাকারী দোষীদেরও কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হবে; যাতে পরবর্তীতে আর কোনো প্রতিষ্ঠান এরকম গুরুদায়িত্বে অবহেলা করতে সাহস না পায়। চিকিৎসায় অবহেলা পাওয়া গেলে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ ল্যাবএইড হাসপাতালের বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘ল্যাবএইড হাসপাতালে এন্ডোস্কপি করাতে একজনের মৃত্যুর ঘটনায় মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পরিদর্শন করা হয়েছে। যার রিপোর্ট বৃহস্পতিবার হাতে আসবে। রিপোর্ট দেখে সে বিষয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
নিহত আয়হামের পরিবার সূত্র জানায় গতকাল বিকালে কুমিল্লার চান্দিনায় তার দাফন সম্পন্ন হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত ৮ই জানুয়ারি রাজধানীর বাড্ডা সাতারকুলে ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সুন্নতে খতনা করাতে গিয়ে লাইফ সাপোর্টে থাকা শিশু আয়ান মারা যায়। টানা সাত দিন লাইফ সাপোর্টে ছিল আয়ান। এ ঘটনায় উচ্চ আদালতের নির্দেশে তদন্ত চলছে।হাসিখুশি আয়হাম ওটিতে ঢুকেছিল, বের হলো লাশ হয়ে। মানবজমিন