ডেস্ক রির্পোট:- মায়ের ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে ৭২ বছর আগে আন্দোলন করে জীবন দেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ নাম না জানা অনেক বাঙালি। সেই আন্দোলনে শহীদদের স্মৃতি স্মরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গড়ে তোলা হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। ভাষার জন্য বাঙালির প্রাণদানের এই অনন্য ঘটনাকে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ। সংস্থাটির উদ্যোগে ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে বিশ্বব্যাপী ১৯৯৯ সাল থেকে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। তবে ভাষা শহীদদের তালিকা তৈরি আর ভাষা জাদুঘর স্থাপনের দাবিতে ২০০৯ সালে হাইকোর্টে রিট করে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইআরপিবি) নামে একটি মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন। ২০১০ সালে এ বিষয়ে রায় দেন হাইকোর্ট। এরপর ১৪ বছর হতে চলল। কিন্তু কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সংরক্ষণ ও ভাষাশহীদ স্মরণে এখন পর্যন্ত নির্মিত হয়নি গ্রন্থাগারসহ ‘ভাষাশহীদ জাদুঘর’। প্রণীত হয়নি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ভাষাসংগ্রামীদের চূড়ান্ত তালিকাও।
এ বিষয়ে রিটকারী প্রতিষ্ঠানের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ভাষাসংগ্রামীর তালিকা ও ভাষা জাদুঘরের রায় বাস্তবায়নে পদক্ষেপ না নেওয়ায় দুবার আদালত অবমাননার আবেদন করেছি। তখনকার সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব ব্যক্তিগত হাজিরা দিয়ে রায় বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন; কিন্তু এখনো তা বাস্তবায়ন হয়নি।
তৎকালীন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ১৯৫২ সালের ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ভাষা আন্দোলন চলাকালে সরকারি বাহিনীর নির্বিচার গুলিতে বহু লোক নিহত হন। ওই আন্দোলনে পাঁচজন শহীদের নাম জানা যায়। তারা হলেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও শফিউর। তাদের মধ্যে বরকত ও জব্বার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। রফিক বাদামতলী কমার্শিয়াল প্রেসের মালিকের ছেলে। এই তিনজন নিহত হন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে মারা যান রিকশাচালক সালাম এবং হাইকোর্টের কর্মচারী শফিউর রহমান। এ পাঁচজন ভাষাশহীদ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছেন। ২০০০ সালে তাদের সবাইকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। তবে প্রকৃত ভাষা শহীদের সংখ্যা আরও অনেক বেশি বলে জানা যায়।
২০১০ সালের ২৫ আগস্ট হাইকোর্টের রায়ে শহীদ মিনারের পাশে গ্রন্থাগারসহ জাদুঘর প্রতিষ্ঠা এবং জাদুঘরে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস-সমৃদ্ধ তথ্যপঞ্জিকা রাখা, ভাষা সংগ্রামীদের প্রকৃত তালিকা তৈরি ও প্রকাশ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণ, মর্যাদা রক্ষাসহ আটটি নির্দেশনা দেওয়া হয়। কয়েক দফা সময় নিয়েও ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করেনি কর্তৃপক্ষ।
জানা গেছে, ২০১১ সালের ২০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভায় ভাষাসংগ্রামীদের তালিকা করার জন্য চার সদস্যের কমিটি করা হয়। ওই কমিটি এক বছর পরে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেওয়া ১৪ নারীসহ জীবিত ৬৮ জনকে ভাষাসংগ্রামী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সরকারি গেজেট প্রকাশ করে; কিন্তু ওই তালিকা নিয়ে বিতর্ক হয়। এরপর ২০১২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ওই কমিটির বৈঠকের সুপারিশে বলা হয়, প্রকৃতপক্ষে ওই সময় ৫ কোটি জনগণই ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শরিক হয়েছিল। তাই প্রকৃত ভাষাসংগ্রামীদের সংজ্ঞায়িত করা যায় না। ৬৪ বছর পরে প্রকৃত ভাষাসংগ্রামীদের তালিকা প্রণয়ন কষ্টসাধ্য। দীর্ঘকাল অতিবাহিত হওয়ায় নির্ভুল তালিকা প্রণয়ন করা দুরূহ হবে। তবে সেই সময়ে আন্দোলনের অগ্রগামীদের তালিকা বিভিন্ন স্মৃতিকথা, স্মরণিকা এবং ইতিহাস থেকে জানা সম্ভব।
সুপারিশে আরও বলা হয়, তালিকা প্রণয়ন দুরূহ এবং মামলা-মোকদ্দমা উদ্ভূত হবে বিবেচনায় কমিটি নতুন করে ভাষা সংগ্রামীদের সংশোধিত তালিকা গেজেট রূপে প্রকাশ না করার পক্ষে মত দেন। একই কারণে ইতোপূর্বে জারিকৃত গেজেটটি বাতিলের পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ জানান। এ ছাড়া ভাষাসংগ্রামীদের তালিকা করার নির্দেশনাটি পুনর্বিবেচনা চেয়ে আবেদন করতে পরামর্শ দেওয়া হয়। কমিটির ওই সুপারিশের পর আর কোনো অগ্রগতি জানা যায়নি।
আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, হাইকোর্ট যেহেতু আদেশ দিয়েছেন, তা পালন করতেই হবে। ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিকের নেতৃত্বাধীন কমিটি তালিকা করতে অপরাগতা প্রকাশ করলে অন্য কমিটিকে দায়িত্ব দিতে হবে। এখন নতুন মন্ত্রী, নতুন সচিব দায়িত্ব নিয়েছেন। আমরা রায় বাস্তবায়নে তাদের সঙ্গে আলোচনা করব। না হলে আবারও হাইকোর্টে যাব।কালবেলা