পিয়াস সরকার:- দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একটা প্রচ্ছন্ন অস্থিরতা চলছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের দায়ী করে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা। আবার অভিযোগ তুলছেন যৌন হয়রানিরও। প্রায়শই উঠে আসছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরদের নিয়োগ দুর্নীতির খবর। কিন্তু শাস্তির মুখে পড়ছেন না কেউই। আবার ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনগুলোকে নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে প্রায়শই উঠছে প্রশ্ন। অছাত্ররা নিয়ন্ত্রণ করছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হল। এহেন নানাবিধ কারণে বারংবার কাঠগড়ায় দাঁড়াচ্ছেন শিক্ষকরা। ভবিষ্যৎ তৈরির কারিগর শিক্ষকরা নানাবিধ অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত হওয়ায় ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সাম্প্রতিক সময়ে এই বিষয়গুলো আরও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উত্তাল ছিল বেশ ক’দিন।
গত ১০ই ফেব্রুয়ারি গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক নাদির জুনাইদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ আনেন বিভাগের এক নারী শিক্ষার্থী। দেড় বছর ধরে এই শিক্ষকের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে ওই শিক্ষার্থী প্রক্টর বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন। এরপরই এই শিক্ষকের বিচারের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন ব্যাপক আন্দোলন-বিক্ষোভে নামে। মানববন্ধন, মশাল মিছিল, অভিযুক্ত শিক্ষকের রুমে তালা দেয়ার পর সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থীরা তার শাস্তি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ক্লাস বর্জনের সিদ্ধান্ত নেন। গত ১২ই ফেব্রুয়ারি শিক্ষার্থীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে নাদির জুনাইদকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় প্রায় দুু’সপ্তাহ থেকে উত্তাল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিদিনই কর্মসূচি পালন করছে ‘নিপীড়ন বিরোধী মঞ্চ’। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা প্রধান ফটকসহ অন্যান্য ফটকও তালাবদ্ধ করে রাখে। শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো হচ্ছে- ধর্ষক ও তার সহায়তাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা, মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের হল থেকে বের করে গণরুম বিলুপ্তপূর্বক নিয়মিত শিক্ষার্থীদের আবাসন নিশ্চিত করা, র্যাগিং সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে, নিপীড়ক শিক্ষক মাহমুদুর রহমান জনির বিচার নিষ্পত্তি করাসহ ক্যাম্পাসে বিভিন্ন সময়ে নানাবিধ অপরাধে অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় আনা, নিপীড়কদের সহায়তাকারী প্রক্টর ও মীর মশাররফ হলের প্রাধ্যক্ষের অপরাধ তদন্ত করা, সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তাদেরকে তদন্ত চলাকালে প্রশাসনিক পদ থেকে অব্যাহতি প্রদান করা এবং মাদকের সিন্ডিকেট চিহ্নিত করে জড়িতদের ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণাপূর্বক তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এই কর্মসূচিতে যোগ দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একাংশও।
এক নারী শিক্ষার্থীকে বিবস্ত্র করে র্যাগিংয়ের ঘটনায় বেশ সমালোচনার মুখে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি)। এর বছর না ঘুরতেই গত ৭ই ফেব্রুয়ারি আরেক শিক্ষার্থীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের অভিযোগ মিললো। এ ঘটনায় গঠন করা হয়েছে দুটি তদন্ত কমিটি। ঘটনার পর বিষয়টি ধামাচাপা দিতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তৎপর রয়েছেন। পরপর দুটি একই ধরনের ঘটনায় প্রশ্ন উঠছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দিকে।
এদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষ যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় রূপ নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মতে, এই প্রশাসনের পক্ষে এই সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। দুই গ্রুপের শিক্ষকরাই নেপথ্যে তাদের স্বার্থে নানাভাবে ব্যবহার করে আসছে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শিক্ষার্থী যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলেছেন এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে। গত ৩১শে জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় ভাইস চ্যান্সেলর বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের এক শিক্ষার্থী একই বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মাহবুবুল মতিনের বিরুদ্ধে। এতে তিনি লেখেন, থিসিস চলাকালীন আমার সুপারভাইজার কর্তৃক যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের শিকার হই। থিসিস শুরুর পর থেকে তিনি আমার সঙ্গে বিভিন্ন যৌন হয়রানিমূলক; যেমন- জোর করে হাত চেপে ধরা, শরীরের বিভিন্ন অংশে স্পর্শ করা, অসঙ্গত ও অনুপযুক্ত শব্দের ব্যবহার করা। কেমিক্যাল আনাসহ আরও বিভিন্ন বাহানায় তিনি আমাকে তার রুমে ডেকে নিয়ে জোরপূর্বক জাপটে ধরতেন। এরমধ্যে গত ১৩ই জানুয়ারি আনুমানিক ১২টা নাগাদ কেমিক্যাল দেয়ার কথা বলে রুমে ডেকে নিয়ে দরজা বন্ধ করে ধর্ষণের চেষ্টা করেন। এমতাবস্থায় তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তার পক্ষে দৈনন্দিন ও প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে।
আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে বিতর্কিত নিয়োগ বোর্ড বাতিলের দাবিতে গত বছরের ১৭ই ডিসেম্বর অবস্থান কর্মসূচি পালন করে আসছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। ভাইস চ্যান্সেলর অবৈধ নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন তারা। পরবর্তীতে এ আন্দোলন ভাইস চ্যান্সেলরের পদত্যাগের একদফা দাবিতে রূপ নেয়।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সম্মানী সিন্ডিকেট’র অন্যতম হোতা ও আর্থিক খাতে অনিয়মের জন্য নানা সময়ে আলোচনায় আসেন অধ্যাপক ড. কাজী নাসির উদ্দিন। গত ২রা জানুয়ারি তাকে অর্থ ও হিসাব দপ্তরের পরিচালক পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (পবিপ্রবি) অনুমোদনহীন নিয়োগ, বিশ্ববিদ্যালয় নীতিমালা ভঙ্গ করে নিয়োগ, পদবিহীন নিয়োগ, সংশ্লিষ্ট পদে আবেদন না করেও নিয়োগ ও নিয়োগের মানদ-সহ নানাবিধ অভিযোগ খতিয়ে দেখতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। ২০২২ সালের ১৬ই নভেম্বর প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুসারে কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ মোট ৩৯ জনের নিয়োগের কথা থাকলেও গত ২রা ডিসেম্বর রিজেন্ট বোর্ডে সর্বমোট ৫৮ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়। মূলত, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের ছেলেসহ অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের পরিবারের সদস্যদের নিয়োগ দেয়া হয়।
ভাইস চ্যান্সেলরদের স্বজনপ্রীতি যেন ওপেন সিক্রেট। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা নিয়োগ দিচ্ছেন নিজের আত্মীয় স্বজনদের। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইস চ্যান্সেলর মেয়াদকালে কোনো না কোনো আত্মীয়কে নিয়োগ দিয়েছেন। সর্বশেষ গত ১৮ই ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সেকশন অফিসার হিসেবে চাকরি পেয়েছেন ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. মো. শহীদুর রশীদ ভূঁইয়ার ছোট ছেলে হামিম আল রশীদ। গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বশেমুরবিপ্রবি) ২০২২ সালে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শর্ত পূরণ না করে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে নিয়োগ দেয়া হয়।
শিক্ষকরা নানবিধ কারণে বারংবার আসছেন কাঠগড়ায়। এটাকে খুব খারাপ সংকেত বলে চিহ্নিত করছেন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর আআমস আরেফীন সিদ্দিক বলেন, আমাদের সকলের শতর্ক থাকা উচিত। বিভিন্ন সময় ভাইস চ্যান্সেলররা দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত থাকছেন। একজন ভাইস চ্যান্সেলর যদি দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত থাকেন তখন শিক্ষক সমাজের উপর পরোক্ষ প্রভাব চলে আসে। এর প্রভাব শিক্ষার্থীদের ওপরও পড়ে। শিক্ষক যখন দুর্নীতি করেন তখন শিক্ষার্থীদের মাঝে স্বার্থের সংঘাত দেখা দেয়। শিক্ষকদের বিরুদ্ধে যাওয়া সহজ কারণ শিক্ষার্থীরা সংখ্যায় বেশি থাকে। আবার অনেক নেতৃত্ব স্থানীয় শিক্ষার্থী দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকে।
শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে যে নিয়ম চলছে এটাই যথেষ্ট। কিন্তু আমাদের সৎ ইচ্ছা থাকতে হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কিছুটা পরিবর্তন করা যেতেই পারে। কারণ অনেকেইতো সৎ ইচ্ছা রাখছেন না।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আজাদ চৌধুরী বলেন, মূল্যবোধের যখন অবক্ষয় হয় তখন সব জায়গাতেই হয়। শিক্ষক বা বিশ্ববিদ্যালয়তো আইসোলেটেড আইল্যান্ড না। আমাদের মূল্যবোধের বিষদ ধ্বস নেমেছে। কিন্তু এটা বেশি চোখে লাগে কারণ শিক্ষকরাইতো আদর্শের বাতিঘর হবেন। শিক্ষক নতুন আশার আলো জাগাবেন। শিক্ষকদের যদি এই অবস্থা হয় তবে সমাজে আশার আলো আসবে কোথা থেকে? এটা নিন্দনীয়, দ-নীয় শাস্তি হওয়া উচিত। আর শিক্ষক নিয়োগের সময় তার স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, ন্যায়নিষ্ঠা ক্যারিয়ারের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা জরুরি। এগুলো যদি না থাকে তাহলে তো আর শিক্ষকতার চাকরি হওয়া উচিত নয়।
তিনি আরও বলেন, পুরো সমাজ যদি কলুষিত হয়ে যায় তাহলে শিক্ষকরা বাদ যাবেন কীভাবে? আমার কথা, সব পচে যাক কিন্তু আদর্শের জায়গাটা ঠিক থাকুক। এজন্য দায়ী সবাই। শিক্ষকদের অধপতন আমাকে ভিষণভাবে পীড়া দেয়। মানবজমিন