ডেস্ক রির্পোট:- ধারাবাহিকভাবে পরিবর্তন হচ্ছে দেশের প্রধানতম নদী পদ্মার আকার ও গতিপথ। স্যাটেলাইট ছবি বিশ্লেষণের ভিত্তিতে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৮৮ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে পদ্মা তুলনামূলকভাবে সংকীর্ণ হয়েছে। সোজা অবস্থান থেকে পরিবর্তিত হয়ে আঁকাবাঁকা হয়েছে নদীর গতিপথ। বেড়েছে ‘ব্রেইডিং’ বা পরস্পরছেদী প্রবণতা। প্রমত্তা পদ্মায় এখন সেতু আছে দুটি। একটি শতবর্ষী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, আরেকটি ২০২২ সালে চালু হওয়া পদ্মা সেতু। বর্তমানে এ নদীতে নতুন করে আরো ছয়টি সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করছে সরকারের সেতু বিভাগ।
নাসার প্রতিবেদনে পদ্মার আকার ও গতিপথ পরিবর্তন প্রবণতার দুটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। একটি হলো মুক্তভাবে প্রবাহিত এ নদীর পাড় সুরক্ষায় কোনো ব্যবস্থা নেই। দ্বিতীয়টি হলো পদ্মার তীরবর্তী বালুচর। এ দুয়ের প্রভাবে ধারাবাহিকভাবে আকার ও গতিপথ পরিবর্তনের প্রবণতা বেড়েছে। এর মধ্যেই আবার নতুন করে ছয়টি সেতু নির্মিত হলে সেগুলো নদীর অস্তিত্বকে সংকটের মুখে ফেলে দিতে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
এ বিষয়ে নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ‘পদ্মায় আর যদি কোনো সেতু নির্মাণ করা হয় তাহলে নদীর পানিপ্রবাহের আরো ক্ষতি হবে। এরই মধ্যে পদ্মার পানিপ্রবাহ কমে গেছে। বাংলাদেশ অংশে ২৪ ফুট পর্যন্ত পলি জমেছে। রাজশাহী থেকে শুরু করে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ হয়ে গোয়ালন্দ পর্যন্ত একই অবস্থা। এ নদীতে আর কোনো প্রকল্প নিলে নদীর পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যাবে বা ক্ষীণ হয়ে পড়বে। এর ফলে নদীর অস্তিত্বই সংকটে পড়ে যাবে।’
বর্তমানে সেতু বিভাগ ৩০ বছর মেয়াদি একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ করছে, যা শেষ হবে আগামী জুনে। বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মহাপরিকল্পনায় সেতু, টানেল ও এক্সপ্রেসওয়ে মিলিয়ে প্রায় ৮০টি বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণের প্রস্তাব করা হচ্ছে। এর মধ্যে পদ্মায় সেতু নির্মাণের প্রস্তাব আছে ছয়টি। প্রাথমিকভাবে পাবনা-রাজবাড়ী, পাটুরিয়া-গোয়ালন্দ, হরিরামপুর-ফরিদপুর, দোহার-বড়গ্রাম, সুজানগর-পাংশা ও কুষ্টিয়া-পাবনার মধ্যে সেতুগুলো নির্মাণের কথা বলা হয়েছে।
নদী ও পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পদ্মায় নতুন করে আরো সেতু নির্মাণ হলে নদীর বোঝা বাড়বে। বিঘ্নিত হবে পানিপ্রবাহ। পানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, ‘নদীর ওপর সেতু নির্মাণ তো প্রকৌশলগত বিষয়। চাইলেই বানানো সম্ভব। কিন্তু এতে নদীর বোঝা আরো ভারী হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাছাড়া পদ্মা নদীতে আর কোনো সেতুর আপাতত প্রয়োজনও নেই। ভবিষ্যতে প্রয়োজন আছে কিনা, সেটা সময় এলে দেখা যাবে। সেতু মানেই তো ব্যয়। অপ্রয়োজনে সেতু বানিয়ে দেশের মানুষের চেয়ে ঠিকাদার ও বিদেশীদের লাভবান করার কোনো যুক্তি নেই।’
যদিও সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, মহাপরিকল্পনা হচ্ছে, তার মানে এ নয় যে প্রস্তাবিত সব অবকাঠামোই বাস্তবায়ন হবে। বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত নয়। বাংলাদেশে এসব অবকাঠামো কতটা প্রয়োজন, কোন কোন জায়গায় এগুলোর সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে; মহাপরিকল্পনায় মূলত সেসব বিষয়ই উঠে আসবে।
দেশের দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী পদ্মার দৈর্ঘ্য ৩৬৬ কিলোমিটার। নাসার তথ্য অনুযায়ী, গত তিন দশকে পদ্মা আকার ও গতিপথ পরিবর্তন করেছে ধারাবাহিকভাবে। আর বাংলাদেশ নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের আরেক গবেষণায় উঠে এসেছে, ভাটি অঞ্চলের পাশাপাশি ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে পদ্মার উজানেও বেড়েছে ভাঙনপ্রবণতা। ভাঙনের পাশাপাশি পদ্মায় জেগে উঠছে নতুন নতুন চর।
সরজমিনে পদ্মা সেতু এলাকা ঘুরে পলি জমে নতুন করে জেগে ওঠা একাধিক চর, বালুচর দেখা গেছে। বিশেষ করে এ সেতুর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের আশপাশে একাধিক বালুচর জেগে উঠেছে, যেগুলোর কোথাও কোথাও পানিপ্রবাহ সরু নালার রূপ নিয়েছে। সব মিলিয়ে পদ্মা সেতু এলাকায় চারটি চর দেখা গেছে, যার প্রথমটি জাজিরা প্রান্তের ১১ নম্বর পিলার থেকে ১৭ নম্বর পিলার পর্যন্ত। ২৪ নম্বর পিলার থেকে ৩১ নম্বর পিলার পর্যন্ত জেগে উঠেছে আরেকটি বালুচর। আরেকটি চর জেগে উঠেছে ৩৩ থেকে ৩৭ নম্বর পিলারের মাঝে। স্থানীয়দের অভিযোগ, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর থেকে দীর্ঘদিন নদী খনন কার্যক্রম বন্ধ রাখায় এসব চর জেগে উঠেছে। এসব চরের কারণে নদীর পানিপ্রবাহ বিঘ্নিত হওয়ার পাশাপাশি স্থানীয়দের জীবনমানেও বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার মেদিনীমণ্ডল ইউনিয়নের মৎস্যজীবী শিবু দাস। পদ্মা সেতু হওয়ার আগে নদীতে মাছ ধরতে ১৫-১৬টি নৌকা ব্যবহার করতেন তিনি। মূলত ইলিশ মাছই ধরা হতো বেশি। পদ্মা সেতু চালুর পর মাছ সংকটের কারণে বাধ্য হয়ে নৌকার সংখ্যা ছয়টিতে নামিয়ে এনেছেন। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার সকাল ৬টার দিকে একটি মাছ ধরার নৌকা নিয়ে নিজেই মাছ ধরতে বের হন শিবু দাস। নৌকার ইঞ্জিনে জ্বালানি তেল ভরেছেন আট লিটার। ৩৫০ টাকা মজুরিতে সঙ্গে নিয়েছেন আরেক জেলেকে। কিন্তু সারা বেলা পরিশ্রম করে তারা যে মাছ ধরতে পেরেছেন, তা দিয়ে নৌকার তেল খরচই ওঠানো যায়নি।
পদ্মা সেতু চালুর পর আশপাশের এলাকায় ইলিশ পরের কথা, অন্যান্য মাছও পাওয়া যায় না জানিয়ে শিবু দাস বলেন, ‘আমরা এখন খুব অসুবিধায় আছি। নদী একেবারে শেষ। আমার পূর্বপুরুষরাও এ জায়গায় মাছ ধরেছেন। আমাদের এখানে ছয়-সাত হাজার জেলে আছে। সবাই এখানেই মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। এখন একেকজনের ঘরে খোঁজ নিলে দেখা যায়, তারা বেশ কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। কেউ মাছ পায় না। ট্রলার নিয়ে চাঁদপুরের দিকে গেলে সেখানে কিছু মাছ পাওয়া যায়। কিন্তু ওই এলাকার জেলেরা আমাদের বাধা দেয়। মাছ ধরতে দেয় না।’
বাংলাদেশে পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেলসহ এ ধরনের নতুন যেসব অবকাঠামো এরই মধ্যে তৈরি হয়েছে, সেগুলো মানুষের জীবনযাত্রায় কী ধরনের প্রভাব ফেলছে এবং পরিবেশ-প্রতিবেশের ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব ফেলছে কিনা, সেসব বিষয় মূল্যায়নের পর নদীতে নতুন করে অবকাঠামো নির্মাণের পরামর্শ দিয়েছেন পরিবেশবিদরা। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘দেশের নদ-নদীর ওপর মেগা প্রকল্প নেয়ার আগে আমাদের সুপারিশ থাকবে এর মধ্যে যেসব মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে, সেগুলো বিশ্লেষণ করা। কোনোভাবে এসব অবকাঠামো নদী-পরিবেশ-পাহাড়-বনে প্রভাব ফেলছে কিনা, এটা স্টাডি করে নতুন প্রকল্প নিতে হবে। আমরা অনেক সড়ক বানাতে পারব, কিন্তু একটা নদী-পাহাড়-বন ধ্বংস হয়ে গেলে, সেটা আর ফিরিয়ে আনতে পারব না। পাহাড়-নদী এগুলো সংরক্ষিত রেখেই যেন নতুন অবকাঠামো হয়। নতুবা একসময় অবকাঠামোর ভারে দেশই হয়তো ডুবে যাবে।’
‘অহেতুক সেতু বানিয়ে নদীর গতিপ্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত করা হবে না’ উল্লেখ করে সেতু বিভাগের সচিব মনজুর হোসেন বলেন, ‘আমরা তো অহেতুক সেতু বানিয়ে নদী নষ্ট করতে পারি না। আর আমরা কিন্তু এখনই সেতুগুলো তৈরি করছি না। এখন ফরোয়ার্ড-ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজগুলো চিহ্নিত করা হচ্ছে। অংশীজনদের এ পরিকল্পনার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে। কী কী প্রকল্প নেয়া যেতে পারে, কী কী বাদ দেয়া যেতে পারে এগুলো সবার সঙ্গে আলোচনা করেই ঠিক করা হবে। সেতু-টানেলের মতো অবকাঠামো নির্মাণের একটা বিরূপ প্রভাব নদ-নদীর ওপর সব সময়ই পড়ে। প্রাকৃতিক যেকোনো কিছুতেই আপনি যদি আটকে দেন তার বিরূপ প্রভাব তো পড়বেই। নদীর ওপরে বাঁধ করলে কি প্রভাব পড়ে না? আপনি একদিকে বাঁধ করবেন তো আরেক দিকে ভাঙবে। তবে এ ক্ষতিকে কমিয়ে আনারও কিন্তু ব্যবস্থা রয়েছে। পদ্মায় আমরা যে সেতু করেছি, এখন কিন্তু নিয়মিত নদীশাসন করে যাচ্ছি। যমুনায় আমরা সব সময় মনিটর করে যাচ্ছি। আমাদের নদীগুলো প্রচুর পলি নিয়ে আসে। পলিপ্রবাহ, পানিপ্রবাহসহ নদীর গতি-প্রকৃতি আমরা সব সময় পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছি।’
অন্যদিকে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোস্তফা কামাল মনে করেন নিয়মনীতি মেনে অবকাঠামো তৈরি করলে তা নদীর ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব ফেলে না। তিনি বলেন, ‘দক্ষিণ কোরিয়ার হাং নদীতে ২০১৬ সালে আমি ২৭টা সড়ক ও রেল সেতু দেখেছি। নিয়মনীতি মেনে যদি অবকাঠামো বানানো হয়, পিলারের সংখ্যা ঠিক রাখা হয়, তাহলে তো সমস্যা হওয়ার কারণ দেখি না।’
নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পদ্মা নদী প্রাকৃতিকভাবে কখনো আড়াই কিলোমিটারের বেশি জায়গা নেয় না। পদ্মা সেতু এলাকায় বর্তমানে এ নদী মাওয়ার দিক থেকে ক্রমেই জাজিরার দিকে সরে যাচ্ছে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট রিসার্চ বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাতের আশঙ্কা, আগামী পাঁচ-ছয় বছর ধরে এ প্রবণতা অব্যাহত থাকতে পারে এবং মাওয়া থেকে নদী ক্রমেই ৮ নম্বর পিলার পর্যন্ত চলে যেতে পারে। পদ্মায় নতুন করে সেতু নির্মাণ করার আগে নদীর এ গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ সবচেয়ে জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
ড. আইনুন নিশাত বলেন, ‘বাংলাদেশে অবকাঠামো বানানোর সময় সাধারণত সেতুর প্রকৌশলীরা এগুলো নিয়ে মাথা ঘামান না। বিষয়টি তারা বোঝেনই না।’
পদ্মা সেতু চালুর পর থেকে ঢাকার সঙ্গে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যাতায়াতের সময় কমেছে। যদিও সেতু ও ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করে যানবাহন দ্রুত রাজধানীর উপকণ্ঠ পর্যন্ত পৌঁছতে পারলেও রাজধানীতে প্রবেশ করতে গিয়ে দীর্ঘ যানজটে পড়ছে। যোগাযোগ অবকাঠামো বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পদ্মা সেতু থেকে আসা যানবাহনের চাপই রাজধানীতে সামাল দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এমন অবস্থায় পদ্মায় নতুন করে আরো সেতু নির্মাণ করা হলে তা ঢাকার ওপর চাপ আরো বাড়িয়ে দেবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, ‘সেতুগুলোর সঙ্গে সংযোগ ও ভূমি ব্যবহার সুষ্ঠুভাবে করা না হলে সামগ্রিকভাবে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায়ও এটা বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। মাস্টারপ্ল্যান কিন্তু শুধু অবকাঠামো উন্নয়ন না। যে উদ্দেশ্যে এ সরাসরি সংযোগ দেয়া, সেটাকে যদি সমন্বয় না করি তাহলে প্রকল্প হবে কিন্তু তার উদ্দেশ্য পূরণ হবে না।’বণিক বার্তা