ডেস্ক রির্পোট:- সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরোয়ার-মেহেরুন রুনি ১২ বছর আগে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে ভাড়া বাসায় খুন হয়েছিলেন। আলোড়ন সৃষ্টি করা এই জোড়া খুনের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। আর ঘটনার পরের দিন ওই সময়ের আইজিপি বলেছিলেন, ‘তদন্তে প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি এ বিষয়ে ইতিবাচক তথ্য দিতে পারব বলে আশা করছি।’
৪৮ ঘণ্টার সেই নির্দেশনার ১২ বছর পার হচ্ছে ১২ ফেব্রুয়ারি, সোমবার। খুনি গ্রেপ্তার হয়নি, দেশের এই দুই সাংবাদিক কেন খুন হলেন, তা-ও জানা গেল না এই একযুগে। ‘তদন্তে প্রণিধানযোগ্য সেই অগ্রগতি’ আটকে আছে আদালতে তদন্ত কর্মকর্তার সময় চাওয়ার আবেদনেই। ‘খুব তাড়াতাড়ি ইতিবাচক তথ্য দেওয়ার আশা’ এখন রূপ নিয়েছে মরীচিকায়।
বেসরকারি টিভি চ্যানেল মাছরাঙার বার্তা সম্পাদক ছিলেন সাগর সরোয়ার এবং তার স্ত্রী মেহেরুন রুনি ছিলেন এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক। খুনের সময় ঘটনাস্থলে ছিল এই দম্পতির একমাত্র সন্তান মিহির সরোয়ার মেঘ। তখন তার বয়স ছিল পাঁচ বছর, এখন ১৭ বছরের উঠতি তরুণ সে। কিন্তু বাসার ভেতর বাবা-মাকে কেন খুন হতে হলো, আজও সেই প্রশ্নের জবাব পায়নি শিশু থেকে কৈশোর পার হয়ে তারুণ্যে পা দেওয়া মেঘও।
থানা পুলিশ থেকে ডিবি, এরপর আদালতের নির্দেশে চাঞ্চল্যকর মামলাটির তদন্ত করছে র্যাব। তদন্তের ফল আলোতে না এলেও বারবারই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য আদালতের কাছে সময় নিচ্ছেন কর্মকর্তা। সেই সময়ও বাড়ানো হয়েছে এ পর্যন্ত ১০৫ বার! এমন পরিস্থিতিতে সময় নেওয়ার নামে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে কি না, সেই প্রশ্নও তুলেছেন সাংবাদিক দম্পতির স্বজনরা। আদালতের কাছ থেকে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য বারবার সময় নেওয়াই তদন্ত কর্মকর্তার কাজ বলে মন্তব্য করেছেন মামলার বাদী ও রুনির ভাই নওশের আলম রোমান। এর বাইরে অন্য কোনো কাজ করছে না বলে মনে করেন তিনি।
তদন্ত কার্যক্রম নিয়ে নিজের হতাশার কথা জানিয়ে নওশের আলম বলেন, মামলাটি ধামাচাপা দেওয়া হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। তদন্ত সংস্থা কোনো রুলই প্লে করছে না। এক তদন্ত কর্মকর্তা যান, আরেক তদন্ত কর্মকর্তা আসেন। বারবার সময় নেওয়াই যেন তদন্তের অংশ হয়ে গেছে। তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে যারা ছিলেন, তাদের একাধিকজনের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, তারা কেস হিস্ট্রিই জানেন না।
তিনি বলেন, ডিবি তদন্ত শেষ করতে না পেরে আদালতে ক্ষমা চেয়েছে। পরে র্যাব তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছে। তারা বারবার সময় চাচ্ছে। কিন্তু তারা যে কিছু করতে পারছে না, তা-ও বলছে না, ব্যর্থতার দায়ও নিচ্ছে না, তদন্তও শেষ হচ্ছে না। দিনশেষে আমরা বিচার চাই। আমরা চাই হত্যাকারীরা শনাক্ত হোক, আইনের আওতায় আসুক, বিচার হোক। এর বাইরে কিছু চাওয়া নেই।
মামলার নথি থেকে দেখা যায়, শেরেবাংলা নগর থানায় দায়ের মামলাটি প্রথমে তদন্ত করে থানা পুলিশই। চার দিন পর তদন্তভার যায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগে (ডিবি)। তদন্তে ‘কিছু না পেয়ে’ ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল হাইকোর্টে ব্যর্থতা স্বীকার তারা। এরপর আদালত মামলাটি তদন্তের জন্য র্যাবকে দায়িত্ব দেয়। তখন থেকে মামলাটির তদন্ত করছে র্যাব।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, তদন্ত সংস্থাগুলো এ পর্যন্ত ১০৫ বার সময় নিয়েছে। র্যাবের তদন্ত কর্মকর্তা এ পর্যন্ত ১০টি অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য আগামী ২৭ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করেছেন আদালত।
তদন্ত সূত্র জানিয়েছে, সাগর-রুনির বাসা থেকে জব্দ করা আলামতের ডিএনএ বিশ্লেষণ করে দুজন পুরুষের উপস্থিতি মিলেছে। অজ্ঞাতপরিচয়ে সেই দুই পুরুষকে শনাক্ত করতে যুক্তরাষ্ট্রের ইনডিপেনডেন্ট ফরেনসিক সার্ভিসেস (আইএফএস) ল্যাবে ডিএনএ পাঠিয়েছিল র্যাব। ল্যাবের ফল পাওয়া গেলেও তা থেকে জড়িতদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
মামলার তদন্তের বিষয়ে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘এখন পর্যন্ত প্রকৃত হত্যাকারীকে শনাক্ত করতে পারিনি এবং হত্যার যে মোটিভ, তা-ও বের করতে পারিনি। এজন্যই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে সময় লাগছে।’
ডিএনএ নমুনার ফল বিষয়ে র্যাব মুখপাত্র বলেন, ‘যেসব আলামত পাঠানো হয়েছিল, সেখান থেকে তারা সুনির্দিষ্টভাবে কিছু দিতে পারেনি।’ তদন্তের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মামলার তদন্তভার পাওয়ার পর আমরা যেসব আপডেট পেয়েছি, তা বিজ্ঞ আদালতে উপস্থাপন করেছি।’
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, খুনি কে বা কারা এবং খুনের মোটিভ কি, তা নিশ্চিত না হলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ওই জোড়া খুনে এ পর্যন্ত সন্দেহভাজন আটজনকে গ্রেপ্তার করে। তারা হলো রুনির বন্ধু তানভীর রহমান, বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী এনাম আহমেদ ওরফে হুমায়ুন কবির, রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মিন্টু ওরফে বারগিরা মিন্টু ওরফে মাসুম মিন্টু, কামরুল হাসান অরুণ, পলাশ রুদ্র পাল, তানভীর ও আবু সাঈদ।