ড. এ এন এম মাসউদুর রহমান :- মিরাজের রাতে মহানবী (সা.) বিশেষ বাহনে চড়ে পবিত্র মক্কা থেকে বায়তুল মোকাদ্দাসে ভ্রমণ করেন। মিরাজের রাতে মহানবী (সা.) বিশেষ বাহনে চড়ে পবিত্র মক্কা থেকে বায়তুল মোকাদ্দাসে ভ্রমণ করেন। ছবি: পিক্সাবে
মিরাজ রাসুল (সা.)-এর জীবনে অলৌকিক ঘটনা হিসেবে সংঘটিত হলেও এর মধ্যে মানবজীবনে অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় অগণিত শিক্ষা রয়েছে। এখানে কয়েকটি শিক্ষা তুলে ধরা হলো।
সান্ত্বনা দেওয়া: মহানবী (সা.)-এর মিরাজ সংঘটিত হয় তাঁর চরম দুঃখের বছরে। কারণ সে বছর তাঁর অভিভাবক চাচা আবু তালেব ও সহধর্মিণী খাদিজা (রা.) ইন্তেকাল করেন। মহানবী (সা.) তাঁদের বিয়োগে যখন চিন্তাকাতর, ঠিক সে সময়ই আল্লাহ তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য মিরাজের আয়োজন করেন।
সাবধানতা অবলম্বন: মহানবী (সা.) মিরাজের রাতে বায়তুল মোকাদ্দাসে গিয়ে তাঁর বাহন বোরাককে বেঁধে রাখেন। তিনি না বাঁধলেও পারতেন, বরং ভাবতে পারতেন আল্লাহ আমাকে এনেছেন, তিনিই সংরক্ষণ করবেন। এ থেকে বলা যায়, এর মাধ্যমে তিনি সাবধানতা শিখিয়েছেন। কারণ আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসার পাশাপাশি উপায় অবলম্বন করা তাওয়াক্কুল পরিপন্থী নয়।
ঘরে প্রবেশে অনুমতি নেওয়া: কারও ঘরে প্রবেশের আগে সালামের মাধ্যমে গৃহকর্তার অনুমতি নেওয়া ইসলামের বিধান। মিরাজের ঘটনায় হজরত জিবরাইল (আ.)সহ মহানবী (সা.) এ কাজটিই করেছেন এবং প্রতিটি আসমানের দরজায় গিয়ে অনুমতি প্রার্থনা করেছেন।
নিজের পরিচয় দেওয়া: মহানবী (সা.)কে নিয়ে জিবরাইল (আ.) যখনই কোনো আসমানের দরজায় গিয়ে অনুমতি প্রার্থনা করেছেন, তখনই প্রশ্ন করা হয়েছে—কে? উত্তরে জিবরাইল (আ.) ‘আমি’ না বলে বলেছেন, ‘আমি জিবরাইল’। এ থেকে প্রমাণিত হয়, প্রশ্নকারীর উত্তরে কেবল ‘আমি’ না বলে নামসহ ‘আমি’ বলা উচিত।
নামাজের গুরুত্ব: মহানবী (সা.) মিরাজের রাতে ফরজ নামাজ পরিত্যাগকারীদের দেখেন, তাদের মাথা পাথর দ্বারা চূর্ণবিচূর্ণ করা হচ্ছে। সুতরাং নামাজ ত্যাগ করা যাবে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তুমি ইচ্ছাকৃত সালাত পরিত্যাগ করবে না। যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত তা করে, সে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের দায়িত্ব থেকে মুক্ত।’ (আহমাদ)
জাকাতের গুরুত্ব: এই রাতে মহানবী (সা.) এমন জাতিকে দেখেন, যারা জাকাত আদায় করত না। তাদের গুপ্তাঙ্গের সামনে-পেছনে লেংটি মোড়ানো এক খণ্ড কাপড়। মনে হয় তারা অভাবের কারণে এমন কাপড় পরিধান করেছে। আর তারা পশুর মতো চরছিল এবং জাক্কুম ও জাহান্নামের পাথর খাচ্ছিল।
মানুষকে গুমরাহ করার পরিণাম: মিরাজের রাতে মহানবী (সা.) এমন কিছু বক্তাকে দেখেন, যারা মানুষকে পথভ্রষ্ট করার ওয়াজ করত, তাদের জিহ্বা ও ঠোঁট ধারালো কাঁচি দিয়ে কাটা হচ্ছে এবং তা সঙ্গে সঙ্গে আগের মতো ভালো হয়ে যাচ্ছে।
মা-বাবার খুশি-অখুশি: প্রত্যেক মা-বাবা সন্তানের কল্যাণের জন্য কাজ করেন। সন্তানের ভালো কিছু হলে যেমন তাঁরা খুশি হন, তেমনি মন্দ হলে তাঁরা অখুশি হন। মিরাজের ঘটনায় দেখা যায়, হজরত আদম (আ.) তাঁর ডান দিকে জান্নাতি সন্তানদের দেখে আনন্দে আবেগাপ্লুত হয়ে হাসছেন। অন্যদিকে যখন তিনি বাঁ দিকে তাকিয়ে জাহান্নামিদের অবস্থা দেখছেন, তখন কাঁদছেন।
সুদের ভয়ংকর পরিণতি: সুদ এমন একটি ব্যাধি, যা ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলার পাশাপাশি আখিরাতে বান্দার জাহান্নাম নিশ্চিত করে। তাই আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় হাবিবকে সুদখোরদের পরিণতি প্রত্যক্ষ করান, যাতে তাঁর উম্মত এই ব্যাধি থেকে মুক্ত থাকতে পারে।
ব্যভিচারের পরিণাম: ব্যভিচার এমন একটি সামাজিক ব্যাধি, যা থেকে ক্রমশ বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে। মিরাজের রাতে আল্লাহ তাঁর রাসুলকে ব্যভিচারীদের পরিণাম প্রত্যক্ষ করান। তাই তো আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না, নিশ্চয় তা অশ্লীল কাজ ও নিকৃষ্ট পথ।’ (সুরা বনি ইসরাইল: ৩২)
তাহিয়্যাতুল মসজিদ: মসজিদে প্রবেশ করে বসার আগে দুই রাকাত নামাজ আদায় করা সুন্নত। এই নামাজকে তাহিয়্যাতুল মসজিদ বলা হয়। মহানবী (সা.) বায়তুল মোকাদ্দাসে প্রবেশ করে এই সালাতই আদায় করেছিলেন। মহানবী (সা.) বলেন, ‘যদি তোমাদের কেউ মসজিদে প্রবেশ করে, সে যেন বসার আগে দুই রাকাত নামাজ আদায় করে।’ (বুখারি)
ইমামের বৈশিষ্ট্য: মহানবী (সা.) বায়তুল মোকাদ্দাসে সব নবীর ইমাম হয়ে সালাত আদায় করেছেন। সুতরাং দলের মধ্যে যিনি উত্তম, তিনি ইমাম হওয়ার অধিক হকদার, তা এখান থেকে বোঝা যায়। মহানবী (সা.) বলেন, ‘যে সর্বাপেক্ষা বেশি কোরআনের পাঠক এবং কোরআনি জ্ঞানের অধিকারী, সে-ই মানুষের ইমামতি করবে।’ (মুসলিম)
সৎ পরামর্শ দেওয়া: মিরাজের রাতে যখন মহানবী (সা.)-এর উম্মতের জন্য ৫০ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করা হয়, তখন হজরত মুসা (আ.) তা কমানোর জন্য আল্লাহ তাআলার কাছে আবেদন করতে বলেন। তাঁর পরামর্শেই মহানবী (সা.) বারবার আবেদন করলে নামাজের সংখ্যা পাঁচ ওয়াক্তে উপনীত হয়। এ থেকে প্রমাণিত হয়, কারও কল্যাণ কামনায় সৎ পরামর্শ প্রদান করা উচিত।
উপাধি দেওয়ার বিধান: কোনো কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ কাউকে কোনো উপাধি দিয়ে সম্মানিত করা ইসলাম বৈধ মনে করে। এতে করে উপাধিপ্রাপ্ত ব্যক্তি আরও আগ্রহ নিয়ে কাজ সম্পাদন করতে পারে। ফলে সামাজিক উন্নতি ত্বরান্বিত হয়। যেমন মিরাজের ঘটনাকে সত্যায়ন করার কারণে হজরত
আবু বকর (রা.)কে ‘সিদ্দিক’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
লেখক: অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়