তিন মাসে কারাগারে মৃত্যু বিএনপির ১২ নেতাকর্মীর ‘সুচিকিৎসা’ না দেওয়ার অভিযোগ

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪
  • ১৭০ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- গত তিন মাসে কারাবন্দি অবস্থায় মারা গেছেন বিএনপির ১২ নেতাকর্মী। কারাগারে যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা না করায় একের পর এক মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে বলে দাবি বিএনপি ও নিহতদের পরিবারের। তবে যে কোনো বন্দি অসুস্থ হলে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয় বলে জানিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ।

জানা গেছে, সরকারের পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলন কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে দল ও অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠনের যেসব নেতাকর্মী নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন—তাদের তালিকা করছে বিএনপি। দলটির অভিযোগ, মূলত ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ, হরতাল, অবরোধসহ একদফা আন্দোলনের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হামলায় অসংখ্য নেতাকর্মী হতাহত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য তারিকুল আলম তেনজিং।

কারাগারে বন্দি বিএনপি নেতাকর্মীদের স্বজনদের অভিযোগ, গ্রেপ্তারের পর অনেকের সঙ্গে চরম অমানবিক আচরণ করা হয়েছে। কারাগারে কেউ অসুস্থ হলে তাকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাও দেওয়া হয় না। বিনা চিকিৎসায় এবং অবহেলায় অনেকেই মারা গেছেন। কেউ কেউ গুরুতর অসুস্থ হয়ে কারাগারেই ধুঁকছেন। এসব কারণে কারাবন্দি অনেক নেতার পরিবারের সদস্যরা উদ্বিগ্ন বলে এই প্রতিবেদককে জানান।

অন্যদিকে চলমান আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে সারা দেশে আরও ১৮ জন নেতাকর্মী মৃত্যুবরণ করেছেন বলে জানিয়েছে বিএনপি।

সুচিকিৎসা না দেওয়ার অভিযোগ:

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ও ঢাকা মহানগর উত্তরের সদস্য সচিব আমিনুল হকসহ কয়েকজন নেতা দীর্ঘদিন ধরে কাশিমপুর কারাগারে বন্দি আছেন। তাদের মধ্যে আলালের একটি কিডনি অকেজো। আরেকটির উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। কিন্তু কারাগারে থাকায় সেই সুযোগ পাননি তিনি।

মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের সহকারী জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘কিডনির গুরুতর সমস্যার কারণে তিনি (আলাল) প্রায়ই কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হয় না। শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় তাকে মুক্ত করার জরুরি।’

জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক বিএনপি নেতা আমিনুল হকেরও কিডনিতে পাথর ধরা পড়েছে। তার বড় ভাই মাইনুল হক জানান, ‘সম্প্রতি হাতিরঝিল থানার মামলায় ডিবিতে রিমান্ডে থাকা অবস্থায় ব্যথা অনুভব করলে আমিনুলকে রাজারবাগে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে শারীরিক বিভিন্ন পরীক্ষায় তার কিডনিতে পাথর ধরা পড়ে। প্রয়োজনীয় ওষুধ দিয়ে ব্যথা নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছে। কিন্তু দ্রুত সময়ের মধ্যে সার্জারি না করালে বড় ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে।’

কারাগারে তাকে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে না অভিযোগ তুলে অবিলম্বে আমিনুল হকের মুক্তি দাবি করেন তিনি।

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারের সিনিয়র জেলসুপার সুব্রত কুমার বালার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

তবে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, কেরানীগঞ্জের সিনিয়র জেলসুপার সুভাষ কুমার ঘোষ বলেন, ‘কারাগারে বন্দিদের কেউ অসুস্থ হলে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’

৩ মাসে মারা গেছেন ১২ জন:

বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী এখন পর্যন্ত কারাগারে তাদের ১২ নেতাকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। সর্বশেষ গত ২৮ জানুয়ারি রাতে সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলা বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুস সাত্তার জেলা কারাগারে মারা গেছেন। বিএনপির দাবি, মিথ্যা মামলায় দীর্ঘদিন ধরে কারাগারের ভেতরে পুলিশি নির্যাতনে অসুস্থ হলে ওইদিন রাত ৮টা ২০ মিনিটে তিনি মারা যান।

এ ছাড়া গত বছরের ১ নভেম্বর গ্রেপ্তারের সময় মারা যান কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার মোকাম ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি মো. জাকির হোসেন। ২৬ অক্টোবর চট্টগ্রাম মহানগরের চাঁদগাঁও থানার ৫নং মোহরা ওয়ার্ড বিএনপির সহসভাপতি গোলাপুর রহমানকে (গোলাপ কন্ডাক্টর) ঢাকায় বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে ২৫ নভেম্বর তিনি কারাগারে মারা যান। ২৪ নভেম্বর ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ৩৯নং ওয়ার্ড বিএনপি নেতা ইমতিয়াজ আহমেদ বুলবুলকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। ৩০ নভেম্বর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এই নেতাকে অসুস্থ অবস্থায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল বলে দাবি তার পরিবারের।

গত বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ শেষে গাজীপুরের শ্রীপুর রেলস্টেশন এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় কাওরাইদ ইউনিয়ন বিএনপি নেতা আসাদুজ্জামান খান হিরোকে। ১ ডিসেম্বর কাশিমপুর কারাগারে তার মৃত্যু হয়। ১১ ডিসেম্বর রাজশাহী কারাগারে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন রাজশাহী পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ড বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মনিরুল ইসলাম (৫২)।

বিএনপি মিডিয়া সেলের ডিজিটাল বিভাগের মাহবুব মানিককে গত ৩০ অক্টোবর বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয় থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে গুরুতর অসুস্থ হলে ২০ নভেম্বর তিনি মুক্তি পান। এরপর গত ১৫ ডিসেম্বর তিনি মারা যান। নওগাঁর নজিরপুর পৌরসভার ২নং ওয়ার্ড বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মতিবুল মণ্ডলকে গত ২৭ নভেম্বর গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে অসুস্থ হয়ে ২০ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

এ ছাড়া গাজীপুরের কাপাসিয়ার দুর্গাপুর ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি মো. শফিউদ্দিন মাস্টারকে গত ২৬ অক্টোবর গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তিনি অসুস্থ হয়ে ২৫ ডিসেম্বর মারা যান। মুগদা থানা শ্রমিক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. ফজলুর রহমান কাজলকে গত ২৬ অক্টোবর গ্রেপ্তার করা হয়। গত ২৬ ডিসেম্বর কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়লে কাশিমপুর কারা কর্তৃপক্ষ কাজলকে হৃদরোগ হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখানে তার মৃত্যু হয়। খুলনা মহানগর মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম দলের সহ-সাধারণ সম্পাদক মো. কামাল হোসেন মিজান দীর্ঘদিন কারাগারে থাকা অবস্থায় চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি বাগেরহাট জেলা কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকার দোহার উপজেলার মাহমুদপুর ইউনিয়ন বিএনপির সহসভাপতি মো. হারুন মেম্বারকে গত ২০ নভেম্বর গ্রেপ্তার করে পুলিশ। অসুস্থ অবস্থায় তিনি ২৪ ডিসেম্বর জামিনে মুক্ত হন। এরপর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১৫ জানুয়ারি মারা যান হারুন।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘কারাগারের ভেতরে ও বাইরে বিরোধী দলের সক্রিয় নেতাকর্মীদের ওপর নানা অমানবিক আচরণ চলছে। কারাবন্দিদের নির্যাতন করা হচ্ছে অবর্ণনীয় ও পৈশাচিক কায়দায়। বন্দিদের চিকিৎসা না দিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। অসুস্থ বন্দিকে হাত-পায়ে শিকল পরিয়ে কারা হাসপাতালে ফেলে রাখা হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘দেশের ৬৮টি কারাগার একেকটি টর্চার সেল। গায়েবি মিথ্যা মামলায় সুস্থ সবল নেতাকর্মীদের ধরে নির্যাতন করে কারাগারে নিক্ষেপের পর লাশ বানিয়ে বের করা হচ্ছে। কারাগার থেকে বেরোচ্ছে লাশের সারি।’

তবে বিএনপির এই বক্তব্যকে রাজনৈতিক আখ্যা দিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, কেরানীগঞ্জের সিনিয়র জেলসুপার সুভাষ কুমার ঘোষ বলেন, ‘বন্দিদের সঙ্গে কারাগারে সর্বোচ্চ মানবিক আচরণ করা হয়। কেউ অসুস্থ হলে ডাক্তারের পরামর্শে বিধি মোতাবেক কারাগারের ভেতরে ও বাইরে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়।’

আন্দোলন চলাকালে মারা গেছেন ১৮ জন:

বিএনপির দাবি, সরকারবিরোধী চলমান আন্দোলনে আরও ১৮ নেতাকর্মী মারা গেছেন। পুলিশের গুলি এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের হামলা ও হয়রানির কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছে।

বিএনপির তথ্যমতে, গত বছরের ২৮ অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত আন্দোলনে মারা যাওয়া নেতাকর্মীরা হলেন—ঢাকা মহানগর যুবদল নেতা শামীম, আদাবর থানার সাবেক যুবদল নেতা মো. আবদুর রশিদ, ফরিদপুরের নগরকান্দা ইউনিয়ন বিএনপি নেতার স্ত্রী রেঞ্জুয়ারা বেগম, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্য ও সচিত্র স্বদেশের সাবেক নির্বাহী সম্পাদক রফিক ভুঁইয়া, কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার ছয়সূতি ইউনিয়ন ছাত্রদল নেতা রেফায়েত উল্লাহ ও ইউনিয়ন কৃষক দলের সভাপতি মো. বিল্লাল মিয়া, সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলা যুবদলের সদস্য দিলু আহমদ জিল্লু, কিশোরগঞ্জের ভৈরব পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ড বিএনপির সদস্য মো. আশিক মিয়া, মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য বিপ্লব হাসান বিপুল, কক্সবাজারের উখিয়ার জালিয়া পালং ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক জাগির হোসেন, মাগুরার মোহাম্মদপুর উপজেলার নহাটা ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য মো. রিয়াজ, ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. স্বপন, নওগাঁ পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সভাপতি কামাল আহমেদ, বগুড়ার শেরপুরের বিশালপুর ইউনিয়ন বিএনপির সদস্য আব্দুল মতিন, বগুড়ার শাহজাহানপুরের খোট্টাপাড়া ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি ফোরকান আলী, খুলনার পাইকগাছা উপজেলা যুবদল নেতা শহিদুর রহমান শহীদের পিতা মো. ইউনুচ আলী গাজী (৭০), চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডু ২নং বারৈয়াঢালা ইউনিয়ন বিএনপির সহসভাপতি নুরুল মোস্তফা বজল এবং ময়মনসিংহের পাগলা থানার পাইথল ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক ডা. হারুনুর রশীদ।কালবেলা

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.net
Website Design By Kidarkar It solutions