ডেস্ক রির্পোট:- গত বছর কারাগারে হাজতি ও কয়েদির মৃত্যু বেড়েছে। ২০২৩ সালে কারা হেফাজতে মারা গেছে ১০৬ জন। এর মধ্যে দণ্ডিত ৪২ জন এবং বিচারাধীন মামলার আসামি ৬৪ জন। গত বছর শুধু ঢাকা বিভাগেই মারা গেছে ৭১ জন। এর মধ্যে ৪২ জনের মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে অন্তত ছয়জন বিএনপি নেতা।
যেখানে ২০২২ সালে কারা হেফাজতে মারা গেছেন ৬৫ জন। এর মধ্যে বিভিন্ন মামলায় দণ্ডিত ছিলেন ২৮ জন এবং বিচারাধীন মামলার আসামি ছিলেন ৩৭ জন।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
সংগঠনটির চেয়ারপারসন জেড আই খান পান্না বলেন, ‘যে সংখ্যা আমরা প্রকাশ করেছি, তা বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত নিউজ সংগ্রহের পর নিজস্ব পদ্ধতিতে যাচাই-বাছাই শেষে প্রকাশ করা হয়েছে। বাস্তবে এই চিত্র আরও অনেক বেশি।’
আসকের তথ্যমতে, গত ৫ বছরের ৩৮৫ জন কারা হেফাজতে মারা গেছেন। ২০২৩ সালে মারা গেছেন ১০৬ জন। এর মধ্যে দণ্ডিত ৪২ জন ও মামলার বিচার এখনো শেষ হয়নি—এমন ৬৪ জন। ২০২২ সালে মারা গেছেন ৬৫ জন, এর মধ্যে দণ্ডিত ২৮ এবং বিচার শেষ হয়নি এমন ৩৭ জন। ২০২১ সালে মারা যান ৮১ জন, দণ্ডিত ৫২ ও বিচার শেষ হয়নি এমন ২৯ জন। ২০২০ সালে মারা যান ৭৫ জন। এর মধ্যে দণ্ডিত ৩০ ও বিচার শেষ হয়নি ৪৫ জন। আর ২০১৯ সালে মারা গেছেন ৫৮ জন, এর মধ্যে দণ্ডিত ৪২ ও বিচার শেষ হয়নি, এমন বন্দী ৩৬ জন।
২০২২ সালের মার্চে মো. সায়েদ হোসেন নামে মাদক মামলার এক আসামি লক্ষ্মীপুর কারা হেফাজতে মারা যান। ওই ঘটনায় তখন ক্ষোভ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছিলেন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) প্রধান সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল। এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তিনি ওই ঘটনায় ক্ষোভ ও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে অভিযোগটির সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিত করে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, লক্ষ্মীপুর জেলা কারাগারের মাদক মামলার অভিযুক্ত হাজতি মো. সায়েদ হোসেন ১৬ মার্চ, ২০২২ বেলা ১১টার দিকে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে অচেতন হয়ে পড়লে লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। পরিবারের দাবি মো. সায়েদ হোসেনকে ষড়যন্ত্রমূলক গ্রেপ্তারের পর পুলিশের দাবিকৃত টাকা দিতে না পারায় থানা হাজতে বেদম মারধর ও নির্যাতন করা হয়। এ কারণেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে সায়েদ মারা যান। পুলিশি নির্যাতন ও কারা হেফাজতে মো. সায়েদ হোসেনের মৃত্যুর ঘটনায় মানবাধিকার এমএসএফে ক্ষোভ ও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে। পাশাপাশি অভিযোগটির সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিত করে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছে।
তখন লক্ষ্মীপুর জেলা কারাগারের জেলার মো. সাখাওয়াত হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, সকালে সায়েদের বুকে ব্যথা শুরু হলে তিনি একপর্যায়ে অচেতন হয়ে পড়েন। তাঁকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয়। তবে সদর হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক জয়নাল আবেদিন জানান, হাসপাতালে আনার আগেই সায়েদের মৃত্যু হয়।
এমএসএফ মনে করে, পুলিশের বিরুদ্ধে আনা নির্যাতনের অভিযোগ ও পরবর্তীকালে মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো এবং পরবর্তী সময় কারা হেফাজতে মৃত্যু কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
সর্বশেষ ১৪ জানুয়ারি চাঁদপুর কারাগারে বিচারাধীন হত্যা মামলার আসামি ব্রজলাল পাটিকর মারা যান। চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে নেওয়ার আগেই ব্রজলাল মারা যান বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
চাঁদপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মুহাম্মদ মুনীর হোসাইন বলেন, ‘গত ২৮ ডিসেম্বর হত্যা মামলার আসামি হিসেবে ব্রজলাল পাটিকরকে কারাগারে নিয়ে আসা হয়। তিনি আগে থেকেই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ছিলেন। সকাল ৬টা ৪০ মিনিটের দিকে তিনি অসুস্থ বোধ করলে কারাগারের স্বাস্থ্য সহকারী প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।’
চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক ওমর ফারুক সবুজ বলেন, ‘হাসপাতালে নিয়ে আসার আগেই মারা যান ব্রজলাল পাটিকর।’
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ বছরের মধ্যে কারা হেফাজতে সবচেয়ে বেশি বন্দী মারা গেছেন ২০২৩ সালে। গত বছর ১০৬ জন মানুষ কারা হেফাজতে মারা যান। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মারা গেছের ঢাকা বিভাগে—৭১ জন।
এ প্রসঙ্গে আসকের চেয়ারপারসন জেড আই খান পান্না বলেন, ‘মৃত্যুর প্রধান কারণ নির্যাতন না। প্রধান কারণ অবহেলা।’ নিজের জেল জীবনের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘ওখানে (কারাগার) সর্ব রোগের ওষুধ প্যারাসিটামল। যাদের ডিভিশন নাই, তারা থাকে ফ্লোরে। একটা রুমের অ্যাকোমোডেশন (স্থান সংকুলান) আছে হয়তো ৫০, থাকে ২৫০। মশার কামড়সহ নানা সমস্যা আছে। খাবার অতি নিম্নমানের। যাদের মামলা বিচারাধীন, কারাগারে আটক—এমন ব্যক্তি এবং যারা দণ্ডিত হয়ে কারাগারে আছে, যে কেউই কারাগারে মারা গেলে তা মানবাধিকার লঙ্ঘন।’
আসক চেয়ারপারসন আরও বলেন, ‘কারাগারে যদি কেউ মারা যান, সরকারকে তার ব্যাখ্যা দিতে হবে। কারাগারে আটক থাকা যাঁদের বিচার হচ্ছে, তাঁরা সবাই তো দণ্ডিত হন না। তাহলে যিনি দণ্ডিত হলেন না, তাঁকে কারাগারে আটক রাখা হয়—এর দায়দায়িত্ব কে বহন করবে? এর দায়দায়িত্ব সরকারের।’ তিনি আরও বলেন, ‘মামলা হলেই জেলে ঢুকাও, এই কনসেপ্ট রং। কারাগারে কেউ বন্দী থাকলে, আর যদি তাঁর টাকাপয়সা থাকে, তাহলে তিনি আরামে থাকতে পারেন!’আজকের পত্রিকা