ডেস্ক রির্পোট:- দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৬২টি আসন পেয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা। এদের কারও কারও বিরোধী দলের নেতা হওয়ার ইচ্ছে থাকলেও তা হচ্ছে না। একাদশ সংসদের বিরোধী দল হচ্ছে জাতীয় পার্টি। ১১টি আসন পেয়ে তৃতীয় অবস্থানে থাকলেও সে দলটিই বসতে যাচ্ছেন দ্বাদশ সংসদের বিরোধী দলের আসনে। গতকাল দুপুরে টুঙ্গিপাড়ায় অনানুষ্ঠানিক মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে প্রসঙ্গক্রমে বিরোধী দলের বিষয়টি ওঠে। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিই হবে। আমাদের শক্তিশালী বিরোধী দলের প্রয়োজন আছে। কিন্তু জাতীয় পার্টি পেয়েছে মাত্র ১১টি আসন। আমরা চাই স্বতন্ত্র প্রার্থীরা যেমন সংসদ নির্বাচনকে জমিয়ে রেখেছিল, আগামী পাঁচ বছর সংসদকেও জমিয়ে রাখবে। সে কারণে তারা আলাদা জোট করতে পারে বা জাতীয় পার্টিকে সাপোর্ট দিয়ে শক্তিশালী হতে পারে। বিরোধী দল হচ্ছে আয়নার মতো। তারা সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিতে পারে। আশা করি সঠিকভাবে তারা ভূমিকা রাখতে পারবে। মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্য বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এমন তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মন্ত্রিসভার তিনজন সদস্য জানান, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠক হয় টুঙ্গিপাড়ায়। সেখানে প্রসঙ্গক্রমে বিরোধী দলের বিষয়টি উঠলে সংসদ নেতা জানিয়েছেন, জাতীয় পার্টিই বিরোধী দল হবে। শক্তিশালী বিরোধী দল করার জন্য প্রয়োজনে স্বতন্ত্ররাও আলাদা মোর্চা বা জোট করে জাতীয় পার্টিকে সাপোর্ট দিতে পারে। আমাদের শক্তিশালী বিরোধী দল দরকার।
গত ৭ জানুয়ারি সারা দেশে ২৯৯ আসনে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। বেসরকারি ফলাফলে আওয়ামী লীগ ২২৩টি, জাতীয় পার্টি ১১টি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি একটি করে এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৬২টি আসনে বিজয়ী হয়েছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সংখ্যায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হলেও দল হিসেবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসন পাওয়ায় জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী জাতীয় পার্টিই বিরোধী দল হবে। সে হিসেবে জি এম কাদের হচ্ছেন বিরোধীদলীয় নেতা এবং সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ হচ্ছেন বিরোধীদলীয় উপনেতা।
কার্যপ্রণালি বিধির ২(১) (ট) ধারায় বলা হয়েছে, ‘বিরোধী দলের নেতা অর্থ স্পিকারের বিবেচনা মতে যে সংসদ সদস্য সংসদে সরকারি দলের বিরোধিতাকারী সর্বোচ্চসংখ্যক সদস্য লইয়া গঠিত ক্ষেত্রমতো দল বা অধিসংঘের নেতা।’ সেই হিসেবে জাতীয় পার্টি বিরোধী দল হলেও বিরোধী দলের স্বীকৃতি প্রদানের বিষয়টি স্পিকারের একক এখতিয়ারের বিষয়।
সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার গঠন করতে হলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকতে হবে, এটা সংবিধানে বলা আছে। তবে বিরোধী দলের বিষয়ে বলার কিছু নেই। প্রথা বা রেওয়াজ হচ্ছে, সরকারি দলের পর যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেই দলই বিরোধী দল হবে এবং সেই দলের নেতা বিরোধী দলের নেতা হবেন। সেখানে তাদের কতটি আসন থাকতে হবে, এ রকম কোনো বিষয় নেই। সে কারণে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বিরোধী দল হবেন, কোনো কোনো স্বতন্ত্র এমপি এমনটা বলে আসছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হবে না। জাতীয় পার্টিই বিরোধী দলের আসনে বসতে যাচ্ছে। চলতি মাসের শেষের দিকে জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। সেই অধিবেশনের আগে চূড়ান্ত করা হবে বিরোধী দল কারা হচ্ছে।
সংবিধান বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, স্পিকার স্বীকৃতি না দিলে বিরোধী দল ছাড়াই সংসদ চলতে পারে। এর আগে স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম ও ষষ্ঠ সংসদে কোনো বিরোধী দল ছিল না। আর আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বর্জনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পর গঠিত চতুর্থ সংসদে বিশেষ বিবেচনায় বিরোধী দল করা হয়। ১৯৮৮ সালে বিশেষ বিবেচনায় কয়েকটি দলের সদস্যদের নিয়ে গঠিত সম্মিলিত বিরোধী দলকে বিরোধী দল এবং তাদের নেতা আ স ম আবদুর রবকে বিরোধীদলীয় নেতার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এখানে বিরোধী দলের নির্বাচনের ক্ষেত্রে সরকারি দল জাতীয় পার্টির আগ্রহের বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছিল।
২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী ১৬ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী মিলে হাজী সেলিমের নেতৃত্বে একটি জোট তৈরি করতে দেখা গিয়েছিল। সেই জোটকে আনুপাতিক হারে তিনজন সংরক্ষিত নারী সদস্যের কোটাও দেওয়া হয়েছিল। সাড়ে তিন বছর পর অবশ্য সেই জোটের নেতা হাজী সেলিমসহ বেশির ভাগ স্বতন্ত্র প্রার্থী আবার আওয়ামী লীগে ফিরে যান।
অন্যদিকে স্বতন্ত্র এমপিরা জোট গঠন করবেন বলে জানিয়েছেন ফরিদপুর-৪ আসনের মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন। গত ১০ জানুয়ারি তিনি বলেন, এখনো বিরোধী দল গঠন হয়নি। আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেব। আমরা জোট অবশ্যই করব। তার আগে সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করব।’
ফরিদপুর-৩ আসন থেকে জয়ী স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য এ কে আজাদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘স্বতন্ত্র সবাই একত্রে থাকব, এ রকম একটা প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।’
কুমিল্লা-৪ আসন থেকে জয়ী স্বতন্ত্র সদস্য আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের লোক, শেখ হাসিনার কর্মী। স্বতন্ত্র ভোট করেছি, কারণ নেত্রীর স্বতন্ত্র ভোট করতে বলেছিলেন। এখন আমরা নেত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করব। উনি যদি বলেন, বিরোধী দল হতে তাহলে বিরোধী দলে যাব। না হলে স্বতন্ত্র হয়েই এলাকার মানুষের কথা বলার পাশাপাশি সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলে যাব।’
ঢাকা-১৮ আসনের স্বতন্ত্র এমপি মো. খসরু চৌধুরী বলেন, আমি আওয়ামী লীগ পরিবারের সদস্য। বিরোধী দলে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। আগে নেত্রীর সঙ্গে দেখা করব, তারপর সিদ্ধান্ত নেব আমরা কী করব।’ কারা বিরোধী দল হতে পারবেন এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম কে রহমান বলেন, ‘ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ীরা সরকার গঠন করবেন। আর বাকি যারা থাকবেন তারাই বিরোধী দল হবে। তিনি বলেন, এবার যেহেতু স্বতন্ত্র বেশি বিজয়ী, সে ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরাই প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসতে পারবেন। এ জন্য নিজেদের জোটবদ্ধ হয়ে স্পিকার বরাবরে চিঠি দিতে হবে এবং দলনেতা ঠিক করতে হবে।’বাংলাদেশ প্রতিদিন