ডেস্ক রির্পোট:- কয়েক বছর আগেও ব্যাপক জাগিয়েছিল বরিশালের জাহাজ নির্মাণ শিল্প। দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতিতে বড় প্রভাবক হয়ে উঠছিল এ খাত। কিন্তু বর্তমানে নানা প্রতিবন্ধকতায় শিল্পটি অস্তিত্ব সংকটের মুখে। কাজ না থাকায় সব ডকইয়ার্ডেই ঝুলছে তালা। এর পেছনে দায়ী করা হচ্ছে নৌ-রুটে যাত্রী সংকটকে। পাশাপাশি অনিশ্চিত অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও খাতসংশ্লিষ্টদের বিপদে ফেলেছে।
এ খাতের সঙ্গে জড়িতরা জানান, সম্পূর্ণ বেসরকারি অর্থায়নে বরিশালে গড়ে ওঠা জাহাজ নির্মাণ শিল্পে বিনিয়োগ ৩০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। প্রতি বছর অন্তত পাঁচ-ছয়টি জাহাজ নির্মাণ করা হতো এখানকার প্রত্যেকটি ডকইয়ার্ডে। কিন্তু এখন নির্মাণ শূন্যের কোটায় নেমে গেছে। এমনকি মেরামতের কাজেও ব্যবহার হচ্ছে না ডকইয়ার্ডগুলো।
জাহাজ ও লঞ্চ মালিকরা বলছেন, পদ্মা সেতু চালুর পর এ অঞ্চলে নৌপথে যাত্রী সংকট তীব্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে প্রতি মাসেই বড় ধরনের লোকসান গুনতে হচ্ছে। এমন বাস্তবতায় জেলায় জাহাজ নির্মাণে বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছেন উদ্যোক্তারা।
সুরভী শিপিং লাইনসের পরিচালক রেজিন-উল কবির বলেন, ‘বরিশালে এ ব্যবসার গোড়াপত্তন ছিল অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। তখন বরিশালে দক্ষ কারিগর পাওয়া যেত না। ঢাকা থেকে শ্রমিক এনে বরিশালে জাহাজ নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়েছিল। তাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করে বরিশালের শ্রমিক ও কারিগররা এখন অনেক দক্ষ হয়েছেন। ফলে বাইরে থেকে আর শ্রমিক আনতে হয় না। দেশের যেকোনো স্থানের চেয়ে বরিশালে মজুরিও কম। এ কারণেই বরিশালে জাহাজ নির্মাণ করলে ৩০ শতাংশ ব্যয় সাশ্রয় হতো। কিন্তু বর্তমানে জ্বালানি তেল এবং এমএস প্লেটের মূল্য বৃদ্ধির পাশাপাশি নৌরুটে চরম যাত্রী সংকট এ শিল্পের জন্য অশনিসংকেত বয়ে এনেছে।’ তার মালিকানাধীন ক্রিসেন্ট নেভিগেশন কোম্পানি এক বছর আগেই ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে বলেও জানান তিনি।
১৯৬৪ সালে বরিশাল সদর উপজেলার চরকাউয়া ইউনিয়নের নয়ানী এলাকায় সাহেবের হাট খালের পাশে ছোট পরিসরে একটি ডকইয়ার্ড তৈরি করেন এখানকার লঞ্চ ব্যবসায়ী ও সাবেক পৌর চেয়ারম্যান প্রয়াত গোলাম মাওলা। সেখানে চারটি কাঠের লঞ্চ নির্মাণের মধ্য দিয়ে নৌযান নির্মাণের যাত্রা শুরু। এরপর গত এক দশকে বরিশালের কীর্তনখোলা নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে প্রায় ১০-১২টি ডকইয়ার্ড। এগুলোয় নির্মাণ করা হয় ছোট-বড় লঞ্চ, যাত্রীবাহী ও পণ্যবাহী জাহাজ। তবে এখন ডকইয়ার্ডগুলো নতুন করে কোনো নৌযান তৈরি হচ্ছে না। এর সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের বেশির ভাগই বেকার হয়ে পড়েছেন।
সুন্দরবন নেভিগেশনের স্বত্বাধিকারী সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, ‘একটি শিপইয়ার্ডে অনেক শ্রমিক কাজ করে। প্রত্যেকটি চারতলা লঞ্চ ও কোস্টার নির্মাণ করতে এক থেকে দেড় বছরের বেশি সময় লেগে যায়। এ পুরোটা সময়ই শ্রমিক ও প্রকৌশলীদের বেতন-ভাতা বহন করতে হয়। কিন্তু এখন নানা সংকট চলছে। নৌ-রুটে যাত্রী কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। তার ওপর সব ধরনের ব্যয় বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আমরা ব্যবসা গুটিয়ে বাঁচার পথ খুঁজছি।’
বরিশাল-ঢাকা রুটে চলাচলকারী বেশির ভাগ বিলাসবহুল নৌযানই তৈরি হতো এসব ডকইয়ার্ডে। দেশী-বিদেশী প্রযুক্তির মিশ্রণে স্থানীয় শ্রমিকরাই নির্মাণ করতেন এসব জলযান। এখন বৃহদাকার লঞ্চগুলো মেরামতের জন্যও এ ইয়ার্ডগুলো ব্যবহার হচ্ছে না। লঞ্চ মালিকরা বাইরে থেকে শ্রমিক এনে লঞ্চেই সারছেন মেরামতের কাজ।
এখনো বরিশালের নৌযান নির্মাণ শিল্পে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো বিনিয়োগে তেমন আগ্রহ দেখায়নি। উচ্চ সুদের হারের সঙ্গে ব্যাংক ঋণ পেতে দীর্ঘ কালক্ষেপণসহ অসামঞ্জস্যপূর্ণ শর্তের বেড়াজালের কথাও জানিয়েছেন এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত উদ্যোক্তারা। বনিক বার্তা