ডেস্ক রির্পোট:- দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এই প্রথম কর্মসূচি দিল বিএনপি। সোমবার (৮ জানুয়ারি) গুলশানে দলটির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কর্মসূচির ঘোষণা দেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান।
কর্মসূচি অনুযায়ী, আগামীকাল মঙ্গলবার (৯ জানুয়ারি) ও বুধবার (১০ জানুয়ারি) লিফলেট বিতরণ ও গণসংযোগ করবে দলটি।
মঈন খান বলেন, বাস্তবতার নিরিখে আজ সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অন্তর্বর্তীকালীন স্বাধীন সরকারের মাধ্যেমে নির্বাচন হতে হবে। সত্যিকার অর্থে জনগণ যে ক্ষমতার উৎস, তাদের হাতে ক্ষমতা দিতে হবে। যেন জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। আমরা একটি ইশতেহার চেয়েছি। যেখানে আমাদের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রয়োজনীয় সংস্কার চেয়েছি। আমরা রাজনীতি করি জনগণের সেবা করার জন্য।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ এ সরকারকে বর্জন করেছে। গতকাল জনগণ শুধু ভোট বর্জনই করেনি, তারা আওয়ামী লীগের বিদ্যমান কর্মকাণ্ডকে বর্জন করেছে। জনগণযে ভোট বর্জন করেছে এটাই তার প্রমাণ। বিএনপি জনগণের দল এবং জনগণের শক্তিকে বিশ্বাস করে।
বিএনপির এ নেতা বলেন, আমরা রাজপথে ছিলাম এবং থাকবো যতদিন না জনগণের কাছে ক্ষমতো ফিরিয়ে দিতে না পারব। বিএনপি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বিশ্বাসী। তারই ধারাবাহিকতায় আগামীকাল থেকে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত গণসংযোগ অব্যাহত রাখব। রাজপথে হাটে-মাঠে-ঘাটে মানুষের কাছে যাব। তাদের সঙ্গে কথা বলব। প্রয়োজনে আগামীকাল মঙ্গলবার (৯ জানুয়ারি) ও পরশুদিন বুধবার (১০ জানুয়ারি) তাদের কাছে লিফলেট বিতরণ করব। এ গণসংযোগের মাধ্যেমে গণসচেতনতা সৃষ্টি করব; যা হবে গণমানুষের সচেতনতা, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সচেতনতা।
মঈন খান বলেন, দেশের জনগণ একচেটিয়াভাবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে। ৬৩টি রাজনৈতিক দল এ নির্বাচনে অংশ নেয়নি, আমি সবাইকেই ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আওয়ামী লীগ ডামি নির্বাচন করেছে, ডামি প্রার্থী দিয়েছে, ডামি পর্যবেক্ষক দিয়েছে, তবু ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে নিতে পারেনি। সরকারের প্রতি যদি মানুষের আস্থা থাকত মানুষ নিজেই ভোট দিতে আসত।
৪০ শতাংশ ভোট নিয়ে নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য প্রসঙ্গে মঈন খান বলেন, প্রথমে বলা হলো ২৭.৫ পারসেন্ট ভোট পড়েছে, টেকনোলজির কল্যাণে জানা গেছে, পাশ থেকে এক কর্মকর্তা বলছেন ৪০ পারসেন্ট বলতে হবে। জনগণ ডামি নির্বাচন বর্জন করে প্রমাণ করেছে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন ভুয়া। নির্বাচন কমিশন দুই একটা কেন্দ্র বন্ধ করে প্রমাণ করতে চেয়েছে সুষ্ঠু ভোট হয়েছে। এসব নাটক জনগণ বুঝে গেছে।
ড. মঈন খান আরও বলেন, আগামীতে যে সরকার গঠন করবে তা হবে- ফর দ্যা ডামি, বাই দ্যা ডামি, এমন ডামি সরকার চায় না। দেশের মানুষ এ সরকারের পরিবর্তন চায়, কারণ তারা ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে তারা সৃষ্টি করেছে তা ‘অলিগার্ক’। সুতরাং জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাবে। আন্দোলনের মাধ্যমেই সরকারকে জবাবদিহির আওতায় আনতে চায় বিএনপি।
এর আগে গতকাল রোববার (৭ জানুয়ারি) নানা জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তবে নির্বাচন বর্জন করে এদিন হরতাল পালন করে বিএনপি ও তাদের মিত্র দলগুলো। সাধারণ মানুষকে ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল এসব দল।
বিএনপি ও তাদের মিত্র দলগুলোর শীর্ষ নেতারা বলেন, এ নির্বাচন জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রত্যাখ্যান ও বর্জন করেছে। ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যাননি—এটাই তাদের বড় অর্জন।
এই নির্বাচন দেশের ৬২টি রাজনৈতিক দল প্রত্যাখ্যান করেছে। ‘একতরফা’ ও ‘ডামি’ আখ্যা দিয়ে তারা বলেন, যারা স্বতন্ত্র ও ভিন্ন দলের প্রার্থী, তারাও ঘুরেফিরে নৌকারই লোক। একতরফা নির্বাচনেও যেখানে ৫ শতাংশ ভোট পড়েনি, সেখানে নির্বাচন কমিশন জোর করে সেটাকে ৪০ শতাংশ দেখিয়েছে। জনগণ ও বিশ্ববাসী বুঝে গেছে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনটি পাতানো ও প্রহসনমূলক।
ভোটের পরিস্থিতি সম্পর্কে গতকাল রোববার দুপুরে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, ‘একতরফা’ ভোট বর্জনের ডাক সফল হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও সবাই ভোটকেন্দ্রে যাননি।’
এজন্য ভোটারদের ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দেশ-বিদেশের মানুষ দেখছে, এই নির্বাচন বাংলাদেশের মানুষ বর্জন করেছে। শুধু বিএনপির পক্ষে নয়, নির্বাচন বর্জনকারী ৬২টি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের মানুষকে স্যালুট জানাই যে, তারা গণতন্ত্রের প্রশ্নে কোনো দিন আপস করেনি, এবারও করবে না।’
তিনি বলেন, ‘ক্যামেরার ছবি কথা বলে। হাজার হাজার, লাখ লাখ ছবি এরই মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় আপনারা দেখতে পারছেন… কুকুরের ছবি দেখতে পারছেন ভোটকেন্দ্রের সামনে দাঁড়িয়ে, শুয়ে রোদ পোহাচ্ছে। সেই ভোটকেন্দ্রের নাম হচ্ছে ঢাকার মেরাদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই যে পরিস্থিতি… সিংহভাগ ভোটকেন্দ্র প্রায় ভোটারশূন্য অবস্থায়।’
ভোট বর্জনের আন্দোলন সফল হয়েছে দাবি করে মঈন খান বলেন, ‘রাস্তায় দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগের মতো লগি-বৈঠার আন্দোলন আমরা করি না। অনেকে বলেছেন, আপনারা এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে আওয়ামী লীগকে সরাতে পারবেন না। কারণ, তারা এমন একটি রাজনৈতিক দল যে, তাদের যে কার্যপদ্ধতি, তাদের যে বিভিন্ন প্রক্রিয়া… আজ ১৫ বছরে বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ১ লাখ বানোয়াট গায়েবি মামলা দেওয়া হয়েছে। ৫০ লাখের বেশি বিএনপির নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। বিশ্বের ২০০টি দেশে আপনারা কি দেখাতে পারবেন, যেখানে এ রকম ঘটনা ঘটেছে?’
তিনি বলেন, ‘সরকার এই নির্বাচনের আগে ভেবেছিল, বিএনপি থেকে ১০০ বা ১৫০ নামিদামি নেতা নিয়ে যাবে এবং তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাবে। তারা কয়জনকে নিতে পেরেছে? একজনকে নিলেও… আমি এর ব্যাখ্যা করতে চাই না। তাহলে সরকারের এ উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। তা ছাড়া সরকার ২৮ অক্টোবর আমাদের শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশে ক্র্যাকডাউন করেও কি আন্দোলন বন্ধ করতে পেরেছে? পারেনি। তারা একটা ভুয়া নাটক সাজিয়েছে, ২০১৪ সালেও নাটক সাজিয়েছিল বিএনপি নাকি আইএস বা তালেবান হয়ে গেছে! কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এটা তাদের একটা অপপ্রচার ছিল বিদেশিদের বোঝাতে, সেটাতেও সরকার ব্যর্থ হয়েছে। বিগত এক সপ্তাহে বিশ্বের খ্যাতিমান গণমাধ্যমে স্পষ্টভাষায় বলা হয়েছে যে, এই নির্বাচনে একটিমাত্র সরকারি দল, নিজেরা অথবা তাদের ডামি প্রার্থী দিয়ে তারা এখানে নির্বাচনটি করছে। এটি একটি ভুয়া ও প্রহসনের নির্বাচন।’
ড. মঈন খান আরও বলেন, ‘হরতাল না হলেও তো ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি এমন হতো না। কোন কেন্দ্রে কত ভোট পড়ল, সেটা কনসার্ন না। কেননা ২০১৪ সালের নির্বাচনের মতো একটি কেন্দ্রে ১০৫ শতাংশও বলতে পারে। কী ভোট হচ্ছে, সেটা সারা বিশ্ব ও বাংলাদেশের মানুষ দেখছে।’
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নির্মম নির্যাতন চালিয়ে ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতেই সাজানো নির্বাচন করেছে। সিইসি নিজেই বলেছেন, নৌকার এজেন্ট ছাড়া আর কোনো প্রার্থীর এজেন্ট দেখতে পাননি।’
তিনি বলেন, ‘দেশের সব মানুষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট বর্জন করেছে। কোনো ভোটার কিংবা সাধারণ মানুষও কেন্দ্রে যায়নি।’
গত ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর ২৯ অক্টোবর থেকে দলটি চার দফা হরতাল ও ১৩ দফা অবরোধ কর্মসূচি পালন করে। এরপর লিফলেট বিতরণ ও গণসংযোগ কর্মসূচি দিয়ে আসছে দলটি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরেও কর্মসূচি দিয়েছিল দলটি। নির্বাচনের আগে ঢাকাসহ সারা দেশে মিছিল ও গণসংযোগ করে বিএনপি। এরই ধারাবাহিকতায় এবার নির্বাচনের পর নতুন করে এই কর্মসূচির ঘোষণা দিল বিএনপি।