ডেস্ক রির্পোট:- দেশের চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে আবারও নীতি সুদহার দশমিক ৫০ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন সিদ্ধান্তের ফলে এখন থেকে রেপো রেট হবে ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এতদিন নীতি সুদহার ছিল ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। এর ফলে বাড়বে আমানত ও ঋণের সুদহারও।
রোববার (২৬ নভেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, গত ২২ নভেম্বর পুনর্গঠিত মনিটারি পলিসি কমিটির (এমপিসি) অনুষ্ঠিত প্রথম সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সভাপতিত্বে ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান, প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মো. হাবিবুর রহমান, অর্থনীতিবিদ ড. সাদিক আহমেদ, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মাসুদা ইয়াসমিন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ড. মো. এজাজুল ইসলাম।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জারিকৃত এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে নামিয়ে আনতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য সব ধরনের নীতি সুদহার আবারও বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে বাড়বে আমানত ও ঋণের সুদহারও। নীতি সুদহার বাড়ানোর এ সিদ্ধান্ত আগামীকাল সোমবার থেকে কার্যকর হবে বলে জানানো হয়েছে। এর আগে সর্বশেষ গত অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছিল।
নীতি সুদহার বাড়ানোসহ মুদ্রানীতি কমিটির সভায় নতুন চারটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রথমত, রেপো রেট একবারে দশমিক ৫০ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়ানো হবে। এখন নীতি সুদহার ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ, তা বৃদ্ধি করে ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলো যে টাকা ধার করে, তার সুদহার বাড়বে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোতে রাখা আমানত ও ব্যাংকঋণের সুদহারও বাড়বে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক গত অক্টোবরে যে সংকুলানমুখী মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছিল, এখন সেটি আরও বেশি সংকোচনমুখী করা হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, রিভার্স রেপো (বর্তমান নাম স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি-এসডিএফ) নিম্নসীমার সুদহার ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ হতে ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ করা হয়েছে। বাজারে উদ্বৃত্ত টাকা থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংক রিভার্স রেপোর সুদ বাড়িয়ে তা তুলে নেয়।
তৃতীয়ত, নীতি সুদহার করিডরের ঊর্ধ্বসীমা স্পেশাল রেপো বা এসএলএফ-স্টান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটির সুদহার ৯ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ করা হয়েছে। এ ব্যবস্থায় সংকটে পড়া ব্যাংক উচ্চ সুদে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ধার করে।
চতুর্থত, যে পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে এখন ঋণের সুদহার নির্ধারিত হচ্ছে, সেই স্মার্ট বা সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিলের সুদ ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়ানো। এখন স্মার্ট রেট ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ, ব্যাংকগুলো এর সঙ্গে সাড়ে ৩ শতাংশ পর্যন্ত সুদ যুক্ত করতে পারে। নতুন সিদ্ধান্তে ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত সুদ যুক্ত করতে পারবে ব্যাংকগুলো। তাতে ব্যাংকঋণের সর্বোচ্চ সুদহার হবে ১১ দশমিক ১৮ শতাংশ।
এ ছাড়া ডলারের বিনিময় হারকে বাজারমুখী করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের চলমান প্রচেষ্টা জোরদার ও ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত রাখা হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির জন্য এতদিন মূলত ডলারের মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করে আসছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তিন মাস ধরেই খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশের ওপরে রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে, গত অক্টোবর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ, যা গত ১১ বছর ৯ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। অক্টোবরে সার্বিক মূল্যস্ফীতিও কিছুটা বেড়ে ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সভায় অভ্যন্তরীণ এবং বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বর্তমান সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যৎ গতি-প্রকৃতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এ ছাড়া বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি, বিনিময় হার, তারল্য ও সুদহার পরিস্থিতি এবং নীতি সুদহারের গতিবিধি নিয়ে বিশদ পর্যালোচনা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ, যেমন নীতি সুদহার বৃদ্ধি, আমানত ও ব্যাংকঋণের সুদহারের সীমা তুলে দিয়ে তা বাজারমুখী করা, টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ প্রদান স্থগিতকরণ, আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ এবং রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বৃদ্ধির কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারকে বাজারমুখী করা, আমদানি মূল্য যাচাইসহ বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে তদারকি বৃদ্ধি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ থেকে অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যের আমদানি ব্যয় মেটানোর ব্যবস্থা ইত্যাদি সম্পর্কে কমিটির সদস্যদের অবহিত করে।
কমিটির সদস্যরা সভায় এসব বিষয়ে তাদের মতামত তুলে ধরেন। বাজারভিত্তিক বিনিময় হার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতে এবং ব্যাংকিং খাতে ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণের সমস্যা মোকাবিলায় বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেওয়ার পক্ষে সভায় গুরুত্বারোপ করা হয়। এ ছাড়াও বর্তমানে বিরাজমান উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ বিনিময় হার এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ প্রশমনে বাংলাদেশ ব্যাংকের চলমান প্রচেষ্টাকে অব্যাহত রাখার ব্যাপারে সভায় ঐকমত্য পোষণ করা হয়।
সভায় সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গৃহীত নীতি পদক্ষেপ, বিশ্ববাজারের পণ্য মূল্যে নিম্নমুখী ধারা, আসন্ন আমন ধানের ফলন ভালো হওয়ার সম্ভাবনা এবং শীতকালীন ফসল সরবরাহ বৃদ্ধি পেলে আগামী দিনে মূল্যস্ফীতি সহনীয় মাত্রায় নেমে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়। আলোচনা ও পর্যালোচনা শেষে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ডিসেম্বরে ৮ শতাংশে এবং আগামী জুন শেষে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ঠিক করা হয়। পাশাপাশি বিনিময় হার ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় নীতি সুদহার বাড়ানোর।