ডেস্ক রির্পোট:- নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে এখনো অনড় বিএনপি। তা সত্ত্বেও ‘সুবিধাবাদী’ কিছু নেতা সরকারের প্রলোভনে পড়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন, এমন শতাধিক নেতা বিএনপি হাইকমান্ডের নজরদারিতে রয়েছেন। দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করলেই তাদের বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দলটির নীতিনির্ধারকরা যে কোনো পরিস্থিতিতে দৃঢ়তার সঙ্গে দলীয় শৃঙ্খলা বজায় রাখতে চান বলে জানা গেছে।
বিএনপি নেতারা বলছেন, সরকারবিরোধী কঠোর আন্দোলনের পাশাপাশি সব পর্যায়ে দলীয় শৃঙ্খলা বজায় রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। সে লক্ষ্যেই গত এক বছরে দলীয় সিদ্ধান্ত ভঙ্গের অভিযোগে সারা দেশে দল ও অঙ্গসংগঠনের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীকে বহিষ্কারসহ নানা ধরনের শাস্তি দেওয়া হয়েছে। বহিষ্কৃতদের বেশিরভাগই দলের প্রাথমিক সদস্যপদসহ সব পর্যায়ের পদ হারিয়েছেন। শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে গতকাল শুক্রবারও রাজশাহী এবং ধামরাইয়ের দুই নেতাকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি। আগামীতেও কেউ দলীয় শৃঙ্খলা ভাঙলে সতর্কতা নোটিশ না দিয়ে সরাসরি বহিষ্কার করা হবে।
বিএনপি নেতারা বলছেন, তারা দলীয় সরকারের অধীনে আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন না। কিন্তু দলের একটি ক্ষুদ্র অংশ, বিশেষ করে এলাকায় জনপ্রিয় হলেও যারা বিগত জাতীয় নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাননি, কিংবা দলের মধ্যে নানাভাবে বঞ্চিত হয়েছেন, তাদের বিভিন্ন প্রলোভন দেখানো হচ্ছে।
বিএনপি নেতারা বলছেন, নির্বাচন সামনে রেখে এবার এরশাদের আমলের মতো নেতাদের বাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। সুবিধাবাদী অনেক নেতাকে টাকা-পয়সার লোভ দেখানো হচ্ছে। এই ফাঁদে পড়ে কেউ কেউ দলের বাইরে গিয়ে আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। ইতোমধ্যে বেশকিছু নেতা বিএনপির হাইকমান্ডকে না জানিয়েই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। কেউ কেউ বিভিন্ন দলের হয়ে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। অনেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেও মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘বর্তমান নির্বাচন কমিশনও আগের দুবারের মতো ভাঁওতাবাজির নির্বাচনের পথেই হাঁটছে। জনগণ তাদের তপশিল প্রত্যাখ্যান করায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারানোর ভয়ে দিশেহারা। তারা তথাকথিত কিংস পার্টি, ভূঁইফোঁড় পার্টি, ছিন্নমূল পার্টি তৈরি করছে। এসব দলকে নিয়ে তামাশার নির্বাচন মঞ্চস্থ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। আওয়ামী সরকারের কিংস পার্টিতে যোগ দিতে দেশপ্রেমিক বহু নেতাকে চাপ, প্রলোভন ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হচ্ছে। ছলেবলে-কৌশলে, টোপ দিয়ে কাউকে কাউকে বাগানো হচ্ছে। কেউ কেউ জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে না গিয়ে বিরোধী দলের লেবাসে সামান্য খুদকুঁড়োর লোভে বিবেক-বিবেচনাহীনভাবে তামাশার নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। এসব রদ্দি মার্কা বেইমান, দলছুটরা ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবেন। এ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই।’
বিএনপির কেউ কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী: জানা যায়, বিএনএম ও তৃণমূল বিএনপিতে এখন পর্যন্ত বিএনপি থেকে গুরুত্বপূর্ণ কোনো নেতা যোগ না দিলেও বিভিন্ন এলাকায় দলটির বহিষ্কৃত ও সুবিধাবঞ্চিত সাবেক নেতাদের কেউ কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছেন। এর মধ্যে কিশোরগঞ্জে বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান, বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাবেক সদস্য ও বগুড়ার আলোচিত ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শোকরানা অন্যতম। শোকরানা বগুড়া-১ (সারিয়াকান্দি-সোনাতলা) আসনে নির্বাচন করার জন্য মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান কিশোরগঞ্জ-২ (কটিয়াটি-পাকুন্দিয়া) আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান। তিনি মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। এ ছাড়া বগুড়া-২ (শিবগঞ্জ) আসনে বিউটি বেগম ও বগুড়া-৭ (গাবতলী-শাজাহানপুর) আসনে সরকার বাদল মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন। বাদল বগুড়া সদর উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি এবং বিউটি বেগম বগুড়া জেলা বিএনপির সাবেক মহিলাবিষয়ক সম্পাদক।
এ বিষয়ে বগুড়া জেলা বিএনপির সভাপতি রেজাউল করিম বাদশা বলেন, ‘বিএনপি বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো প্রহসনের নির্বাচনে অংশ নেবে না। এই মুহূর্তে শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে একদফার আন্দোলন চলছে। এর পরও যারা মনোনয়ন ফরম তুলেছেন বা ভবিষ্যতে তুলবেন, তারা দলের কেউ নন।’
বিএনপির একাধিক নেতা জানান, তারা ‘ওয়ান-ইলেভেন’ থেকে শিক্ষা নিয়ে দলের ভেতরে আর সংস্কারপন্থি বানাতে চান না। এবারও সরকার থেকে বিএনপির একটি বলয়কে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার নীল নকশা করবে—এটি মাথায় রেখেই সন্দেহভাজনদের প্রতি তীক্ষ্ণ নজর রাখছে বিএনপির হাইকমান্ড। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনকে বার্তা দেওয়া হয়েছে। তাদের ভবিষ্যৎ বিবেচনা করে ‘তামাশার পাত্র’ না হওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, ‘নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে যে কোনো মূল্যে দলের মধ্যে শৃঙ্খলা ধরে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে নেতাকর্মীদের মধ্যে সেই বার্তা দিতেই শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
শৃঙ্খলা ভাঙলেই বহিষ্কার
এদিকে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিচ্ছে বিএনপির হাইকমান্ড। ইতোমধ্যে তপশিল ঘোষণার পর অন্তত ৭ জন কেন্দ্রীয় নেতাকে বহিষ্কার করেছে দলটি। গত ১৫ নভেম্বর দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার দিনই ‘স্বতন্ত্র গণতন্ত্র মঞ্চ’ নামে নতুন একটি জোট গঠন ও নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য খন্দকার আহসান হাবিব ও ফখরুল ইসলাম। এরপরই তাদের ‘দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থি কর্মকাণ্ডে’ জড়িত থাকার অভিযোগে বহিষ্কার করে বিএনপি। সর্বশেষ গতকাল দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থি কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার সুষ্পষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও রাজশাহী জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান মন্টু এবং ঢাকা জেলাধীন ধামরাই পৌর বিএনপির সভাপতি দেওয়ান নাজিম উদ্দিন মঞ্জুকে দলের প্রাথমিক সদস্য পদসহ সব পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দলটির কেন্দ্রীয় সহ-দপ্তর সম্পাদক মুহাম্মদ মুনির হোসেন স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
এর আগে ২০২২ সালের ৬ এপ্রিল দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ভাইস চেয়ারম্যান শওকত মাহমুদকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় বিএনপি। সন্তোষজনক জবাব না পাওয়া এবং দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করায় চলতি বছরের ২১ মার্চ তাকে দলের সব ধরনের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। ২০১৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর দলীয় শৃঙ্খলা ভঙের অভিযোগে আরেক ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদকেও শোকজ করা হয়েছিল। দল এবং দলের শীর্ষ নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলায় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে বিএনপির খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম মঞ্জুকেও পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে বিএনপি। তারও আগে দলীয় কর্মকাণ্ডে অংশ না নেওয়া, সরকারি দলের সঙ্গে আঁতাত করে চলাসহ বিভিন্ন অভিযোগে ২০২১ সালের ১৪ ডিসেম্বর কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কুকে বহিষ্কার করে দলটি।
বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর সূত্র জানায়, দলীয় শৃঙ্খলা অমান্যের কারণে এই পর্যন্ত সবমিলিয়ে প্রায় ৩ শতাধিক নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। অনেকেই আবার বহিষ্কারাদেশ ফেরাতে দলের চেয়ারম্যান বরাবর আবেদনও করেছেন। অনেকের ব্যাপারে ইতিবাচক হলেও আসন্ন দ্বাদশ নির্বাচনকে ঘিরে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের বিষয়টি পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। নতুনভাবে কেউ দলীয় শৃঙ্খলা ভেঙে সরকারের প্রলোভনে পড়ে নির্বাচনে যায় কি না, সেটি বিবেচনায় রাখা হয়েছে।
বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু বলেন, ‘আসন্ন নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য বিএনপির কোনো কোনো নেতাকে চাপ প্রয়োগের পাশাপাশি প্রলোভনও দেওয়া হচ্ছে। মুষ্টিমেয় যারা নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন, তারা প্রকৃতপক্ষে বিএনপির নীতি আদর্শে বিশ্বাসী নন। তারা বিএনপির নামে সুবিধাবাদী। সত্যিকার অর্থে বিএনপি করেন, এমন নেতা বা তার পরিবারের কেউ কিন্তু বিএনপি ছাড়েনি।’
রাজশাহী জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান মন্টু বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে (বিএনএম) যোগ দিয়ে দলটির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান হয়েছেন। এরপরই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনে তিনি নির্বাচনের ঘোষণা দেন। এর পরই তাকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তিনি বিএনপির রাজশাহী জেলার সাধারণ সম্পাদক থাকার আগে যুবদলের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি ছিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।
এ বিষয়ে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু বলেন, ‘সে দল থেকে চলে যাওয়ার খবর অনেক আগের। সে নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছুই বোঝে না। সংগঠনবিরোধী কার্যকলাপে যুক্ত থাকায় তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।’
তবে মতিউর রহমান মন্টু জানান, বিএনপির জন্য তিনি অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন; কিন্তু বিএনপি তাকে মনোনয়ন দেয়নি, মূল্যায়ন করেনি। বিএনপিতে এখন টাকার বিনিময়ে পদ বিক্রি হচ্ছে। এখন তিনি বিএনএমের কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান হয়েছেন এবং রাজশাহী-৩ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান।
এ ছাড়াও বিএনপি, জাতীয় পার্টি এমনকি আওয়ামী লীগ থেকে বিএনএম যোগ দিয়ে রাজশাহীর কয়েকটি আসনে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন অনেকেই। জাতীয় পার্টি থেকে বিএনএমে যোগ দেওয়া সাইফুল ইসলাম (রায়হান) রাজশাহী-৬ (বাঘা-চারঘাট), আওয়ামী লীগ নেতা শহিদুল ইসলাম রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনে বিএনএম থেকে প্রার্থী হচ্ছেন।
বিএনএমের রাজশাহী জেলার সাধারণ সম্পাদক শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘রাজশাহীর ছয়টি আসনেই বিএনএম নির্বাচনে অংশ নেবে। দু-এক দিনের মধ্যে প্রার্থী চূড়ান্ত সম্পন্ন হবে।’ কালবেলা