ডেস্ক রির্পোট:-ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন না করে পুরোপুরি বাতিলের পক্ষে মত দিয়েছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। গতকাল আইনমন্ত্রী এডভোকেট আনিসুল হকের সঙ্গে বৈঠকে তারা বলেছেন, ডিজিটাল আইনের মাধ্যমে নাগরিকের বাকস্বাধীনতাকে হরণ করা হচ্ছে। আইনটিকে বিরোধী মত দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। গত কয়েক বছরে এই আইনে দায়েরকৃত মামলাগুলো পর্যালোচনা করলে বিষয়টি পরিষ্কার। তাই আইনটি সংশোধন না করে পুরোপুরি বাতিল করতে হবে। বৈঠকে আইনমন্ত্রী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যহারের বিষয়টি স্বীকার করে বলেছেন, যেসব ধারার বিষয়ে আপত্তি রয়েছে সেগুলো সংশোধনের জন্য উদ্যোগ রয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োজন রয়েছে তাই এটি বাতিল সম্ভব নয়। প্রায় তিন ঘণ্টাব্যাপী সভায় উপাত্ত সুরক্ষা আইনের খসড়া নিয়েও আলোচনার কথা ছিল। কিন্তু সময় স্বল্পতার কারণে তা সম্ভব হয়নি। আগামী ৬ই এপ্রিল এ খসড়া নিয়ে নাগরিক সমাজের সঙ্গে পুনরায় বৈঠক করবেন আইনমন্ত্রী।
বিজ্ঞাপন
মঙ্গলবারের বৈঠকে নাগরিক সমাজের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক সি আর আবরাব, আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, রেজাউর রহমান লেনিন, সাইমুম রেজা তালুকদার ও শারমীন খান।
বৈঠক শেষে আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট নিয়ে নাগরিক সমাজ তাদের প্রস্তাবনার আলোকে যুক্তি পেশ করেছেন। আমরা তাদের কথা মূলত শুনেছি। আইনের যেখানে সমস্যা আছে সেই সমস্যা দূর করার জন্য অনেকগুলো পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। সময় স্বল্পতার কারণে কোনটা কোনটা পরিবর্তন দরকার এবং কোনটা কোনটা সঠিক সেটা আমরা তুলে ধরিনি। আমরা আবারো ৩০শে মার্চ ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট নিয়ে আলোচনা কন্টিনিউ করবো। বাতিলের সিদ্ধান্ত হবে কিনা? মন্ত্রী বলেন, এখন আলোচনা হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি, সব পক্ষের কথা শোনার। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সাইবার ক্রাইমের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করা হয়েছে, সেইখানে আমরা থাকতে চাই। এ আইনের প্রয়োজনীয়তার কথা সবাই বলেছেন। এটি যদি ভালো করা যায়, যে সমালোচনা হচ্ছে, তা যদি দূর করা যায়, সেটা চেষ্টা করছি। সেই দিন আলোচনার সমাপ্তি হবে বলে আমার মনে হয়।
এসময় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সম্পর্কে গণমাধ্যমসহ দেশের সব নাগরিকের একটা বড় ধরনের উদ্বেগ আছে। মন্ত্রীও তার আলোচনায় বলেছেন এটার অপব্যবহার হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে, সেটা সরকার অবহিত আছেন। টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক বলেন, অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে অনেকগুলো যুক্তি উপস্থাপন করে আমরা বলেছি, আমরা মনে করি এ আইন বাতিল করা দরকার। মৌলিক যে বিচ্যুতিগুলো আছে এবং উদ্বেগের জায়গাগুলো আছে, পাশাপাশি অপব্যবহারের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে আইনটিতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে। সেটার প্রেক্ষিতে আমরা মনে করি যদি আইনটি ঢেলে সাজানোও হয়, তাহলেও হয়তো সেটা গ্রহণযোগ্য হবে না সবার কাছে। জনকল্যাণমুখী হবে না বলে আমাদের উদ্বেগ আছে। সে কারণে আমরা মনে করি আইনটি বাতিল করা দরকার। তার প্রেক্ষিতেই আমরা আলোচনাটা করেছি বলে জনান ইফতেখারুজ্জামান। মন্ত্রী এটি বিবেচনায় নেবেন তার সঙ্গে যারা ছিলেন তারা আমাদের বলেছেন। পরে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া মানবজমিনকে বলেন, বৈঠকে আমরা বিস্তারিত সমস্যা তুলে ধরেছি। প্রতিটি বিতর্কিত ধারার ত্রুটি তুলে ধরা হয়েছে। আইনটি বাতিলের ব্যাপারে আমরা যুক্তি তুলে ধরেছি। তারা আমাদের বক্তব্য শুনেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. সি আর আবরার বলেন, একটা জিনিসের গোড়ায় গলদ থাকলে বাইরে থেকে শত চেষ্টা করেও তা দিয়ে ভালো কিছু করা সম্ভব না। এই আইন দেশে-বিদেশে কোথাও গ্রহণযোগ্য হয়নি। তাই এই আইন বহাল রাখার কোনো সুযোগ নেই। এটি বাতিল করতে হবে। গতকালের বৈঠকে সরকারের পক্ষে আইনমন্ত্রী ছাড়াও তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ, লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের সচিব মো. মইনুল কবির, আইন ও বিচার বিভাগের সচিব মো. গোলাম সারওয়ার, আইসিটি বিভাগের সচিব মো. সামসুল আরেফিনসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এদিকে উপাত্ত সুরক্ষা আইন ২০২৩ এর খসড়ায় বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি বিভাগ)। গতকাল মন্ত্রণালয়েরও ওয়েবসাইটে আইনটির সংশোধিত খসড়া প্রকাশ করা হয়েছে। এর আগে উপাত্ত সুরক্ষা আইন ২০২২ এর খসড়া মতামতের জন্য উন্মুক্ত করেছিল আইসিটি বিভাগ। সংশোধিত খসড়ায় বিতর্কিত কিছু বিষয় বাদ দেয়া হয়েছে।
এর মধ্যে আইনটি কর্তৃপক্ষ হিসেবে ডিজিটাল সিকিউরিটি এজেন্সির পরিবর্তে উপাত্ত সুরক্ষা এজেন্সি নামে পৃথক একটি সংস্থা গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। সংস্থাটিতে একজন মহাপরিচালক ও ৪ জন পরিচালক রাখার কথা বলা হয়েছে। নতুন খসড়ায় আন্তর্জাতিকভাবে তথ্য সংরক্ষণ ও স্থানান্তরের বিধান যুক্ত করা হয়েছে। আগের খসড়ার সংজ্ঞার্থে ব্যক্তিগত তথ্য এবং উপাত্তের মধ্যে পার্থক্য রাখা ছিল না। নতুন খসড়ায় বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে। গতকালের বৈঠকে এই খসড়ার ওপর আলোচনা হওয়ার কথা থাকলেও সময় স্বল্পতার কারণে তা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ৬ই এপ্রিল খসড়া আইনটি নিয়ে আলোচনা করা হবে। আইনটি নিয়ে এরই মধ্যে নাগরিক সমাজ, অংশজনদের কাছ থেকে বিভিন্ন মন্তব্য, পরামর্শ এসেছে। এর আগেও উপাত্ত সুরক্ষা আইনের খসড়ার ওপর আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে আইনমন্ত্রী বলেন, আগের মিটিংয়ে যেসব পরামর্শ দেয়া হয়েছিল তার অনেকগুলোই আমলে নেয়া হয়েছে।