শিরোনাম

‘এই হল আমার, আমার কথাতেই চলবে’, প্রাধ্যক্ষকে ছাত্রলীগ নেত্রী

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় রবিবার, ৫ মার্চ, ২০২৩
  • ২৭৪ দেখা হয়েছে

ডেস্ক রির্পোট:- ‘এই হল আমার, আমার কথাতেই হল চলবে। যাকে যেখানে খুশি সিট বরাদ্দ দিব। আপনাকে এই হলের দায়িত্ব কে দিয়েছে?’ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) শেখ হাসিনা হলের প্রভোস্ট সাহেদুর রহমানের উদ্দেশে এসব কথা বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয় হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি কাজী ফাইজা মেহজাবিন।

গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় শেখ হাসিনা হলের এক শিক্ষার্থীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে হল পরিদর্শনে এসে কথা বলতে গেলে ছাত্রলীগের সভাপতি ফাইজা এমন আচরণ করেন।
এ বিষয়ে হল প্রভোস্ট সাহেদুর রহমান বলেন, ‘হলে কোন শিক্ষার্থী উঠবে আর কোন শিক্ষার্থী উঠবে না, এই এখতিয়ার সম্পূর্ণ হল প্রশাসনের। একজন শিক্ষার্থী তো এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যে হল সংস্কৃতি আমরা তৈরি করতে চাচ্ছি, তা শুধু ফাইজার জন্য সম্ভব হচ্ছে না।’

তবে এ ধরনের কথা অস্বীকার করেছে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি কাজী ফাইজা মেহজাবিন। তিনি বলেন, ‘স্যারকে এ ধরনের কোনো কথা বলিনি। কথা প্রসঙ্গে বলেছিলাম—এই হল তো আমারও।’

প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে জানা যায়, শেখ হাসিনা হলের ২১৪ নম্বর কক্ষের আবাসিক শিক্ষার্থী আইসিটি বিভাগের ১২তম আবর্তনের প্রেয়সী সানা অন্য কক্ষে স্থানান্তর হওয়ার জন্য হল প্রভোস্ট বরাবর আবেদন করেন। তাঁকে ২১৬ নম্বর কক্ষের একটি সিট বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রেয়সী তাঁর বরাদ্দ পাওয়া সিটে উঠতে গিয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ১১ তম আবর্তনের রায়হানা আনজুম মিমকে অবস্থান করতে দেখেন। সমাধানের জন্য হল প্রভোস্টকে ফোন দিলে প্রভোস্ট সাহেদুর রহমান এসে মিমকে এখানে অবস্থানের কারণ জানতে চান। কাজী ফাইজা মেহজাবিন এখানে তাঁকে থাকতে বলেছেন বলে জানান। পরে এ নিয়ে লোক প্রশাসন বিভাগের স্নাতকোত্তরের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ও হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি কাজী ফাইজা মেহজাবিনকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি প্রভোস্টকে উদ্দেশ ওপরে উল্লিখিত কথাগুলো বলেন।

ঘটনার সময় হলে অবস্থারত শিক্ষার্থীদের মধ্যে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘ফাইজার এমন আচরণ নতুন কিছু না। সে একজন শিক্ষক সম্পর্কে এমন মন্তব্য করতে পারে তাহলে ভাবুন আমাদের সাথে কী ধরনের আচরণ করে থাকে! প্রতিদিন সকাল বেলা তার চিল্লাচিল্লিতে আমাদের ঘুম ভাঙে। হলে অবস্থানরত সব শিক্ষার্থী তার প্রতি বিরক্ত। কিন্তু ভয়ে কেউ মুখ খুলতে পারে না।’

ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা ওই হলের হাউস টিউটর মো. আল আমিন বলেন, ‘হল প্রভোস্টের সাথে ফাইজার আচরণ শিক্ষার্থী সুলভ নয়।’

এ ব্যাপারে হল প্রভোস্ট সাহেদুর রহমান বলেন, ‘হলে কোন শিক্ষার্থী উঠবে আর কোন শিক্ষার্থী উঠবে না, এই এখতিয়ার সম্পূর্ণ হল প্রশাসনের। একজন শিক্ষার্থী তো এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যে হল সংস্কৃতি আমরা তৈরি করতে চাচ্ছি তা শুধু ফাইজার কারণে সম্ভব হচ্ছে না।’

অবশ্য শেখ হাসিনা হল শাখা ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ নতুন নয়। এর আগেও নানা ইস্যুতে সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন ওই ছাত্রলীগ নেত্রী।

গত বছরের ৩১ জুলাই শেখ হাসিনা হলের উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনের আগে হলে উঠতে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের সাক্ষাৎকার নিয়ে সিটে ওঠানো হয়। কিন্তু হল উদ্বোধনের পর থেকেই ছাত্রলীগ নেত্রী ফাইজা নিজের মতো সিট বদল করতে থাকেন। এ ছাড়া বরাদ্দকৃত সিটে না উঠতে হুমকি দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। তিনি তাঁর মতো শিক্ষার্থীদের সিটে তোলেন। শুধু তাই নয়, রাত ৯টার পর হলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলা যাবে না, হল গেটে শিক্ষার্থীদের কেউ এগিয়ে দিতে পারবে না—এমন নানা নিয়ম তৈরি করেছেন ফাইজা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমাদের হল প্রশাসন সিট দিয়েছে। কিন্তু ফাইজার কথা হচ্ছে, সেই সিট বাঁচিয়ে রাখতে গেলে নাকি ছাত্রলীগ করতে হবে! যারা রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত না তাদের সিট নিয়ে সে বরাবর ঝামেলা করে।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬ তম আবর্তনের কোনো শিক্ষার্থীকে শেখ হাসিনা হল প্রশাসন সিট বরাদ্দ দেয়নি। কিন্তু কাজী ফাইজা মেহজাবিন হলে সিঙ্গেল সিটে থাকা শিক্ষার্থীদের ১৬ তম আবর্তনের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে থাকতে বাধ্য করছেন। এ ছাড়া কোনো শিক্ষার্থী পাঁচ থেকে দশ দিনের জন্য বাড়ি গেলেই তাঁর সিটে অন্য কাউকে তুলে দেওয়ার ঘটনাও তিনি ঘটিয়েছেন। পরবর্তীতে হল প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে শিক্ষার্থীরা সিট বাঁচিয়েছেন।

এখন পর্যন্ত কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে একমাত্র শেখ হাসিনা হলে কোনো গণরুম নেই। তবে ক্ষমতা সংহত করতে নবীন শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক উদ্দেশে ব্যবহার করতে হলের গেম রুমকে গণরুম বানানোর পরিকল্পনাও করছেন ফাইজা—এমন তথ্যও পাওয়া গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক আবাসিক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমি চার থেকে পাঁচ দিনের জন্য বাড়ি গিয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ আমাকে ফোন দিয়ে বলে হলে না আসলে নাকি আমার সিট বাতিল করে দিবে। আমার সিট বাতিল করার সে কে? সেও শিক্ষার্থী, আমিও শিক্ষার্থী। পরবর্তীতে হল প্রশাসনের সাথে কথা বলে আমি আমার সিট বহাল রেখেছি।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শেখ হাসিনা হল শাখা ছাত্রলীগের সংক্ষিপ্ত কমিটির একজন বলেন, ‘গেমরুমকে গণরুম বানাবে বলে শুনেছি। এই বিষয়ে প্রভোস্ট স্যারের সাথে ফাইজার কথা-কাটাকাটিও হয়েছে যতদূর জানি।’

এসব ব্যাপারে জানতে চাইলে কাজী ফাইজা মেহজাবিন বলেন, ‘আমি এ রকম কিছুই করি নাই। হলের সিটে এলোটমেন্ট তো আমি দেই না। হলে প্রশাসন দেয়। আমাদের হলে অবৈধ কিছু হয় না।’

হল প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, শেখ হাসিনা হল উদ্বোধনের সাত মাস পেরিয়ে গেলেও প্রথম আসন বরাদ্দের লিস্টে নাম আসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে শুধু কাজী ফাইজা মেহজাবিনই ফির ১ হাজার ২৫০ টাকা হল প্রশাসনকে বুঝিয়ে দেননি। বিষয়টি হল প্রশাসনের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছেন।

এ ব্যাপারে হল প্রভোস্ট মো. সাহেদুর রহমান বলেন, ‘সবাই দিলেও সে হল প্রশাসনকে এই টাকা বুঝিয়ে দেয়নি। আমি বেশ কয়েকবার বলেছি কিন্তু সে নানা অজুহাতে দেখায়। নিয়ম অনুযায়ী তার সিট বাতিল হওয়ার কথা। আমি তার সাথে এই ব্যাপারে সামনে কথা বলব। হল প্রশাসনকে টাকা বুঝিয়ে না দিলে আমি তার সিট বাতিল করার প্রক্রিয়ার দিকে আগাব।’

এ ব্যাপারে ফাইজা বলেন, ‘আমার টাকা কিছু বাকি ছিল। সেটা আমি দিয়ে দিয়েছি। স্যার সম্ভবত এখনো বিষয়টি পাননি।’

সার্বিক অভিযোগের ব্যাপারে হল প্রভোস্ট মো. সাহেদুর রহমান বলেন, ‘অনেক মেয়ে নানা সময় তাকে নিয়ে আমাকে অভিযোগ করেছে। তখন মেয়েদের আমি বুঝিয়েছি লিখিত ডকুমেন্ট দিলে আমার ব্যবস্থা নিতে সুবিধা হয়। কিন্তু মেয়েরা এখানে পড়তে এসেছে। তাদের পরবর্তী সময়ে অসুবিধার কথা চিন্তা করে আর কোনো অভিযোগ করেনি। তাই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও ব্যবস্থা নিতে পারিনি।’

এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সবুজ বলেন, ‘এখানে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য আছে। প্রভোস্ট স্যারও নাকি ছাত্রলীগ সম্পর্কে বাজে কথা বলেছে। এখানে দুইজনের দুই রকমের বক্তব্য শুনছি। আমরা তদন্ত করে দেখব এবং যদি ফাইজা এমন কিছু বলে থাকে তাহলে আমরা সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিব। হল ছাত্রলীগের না, হল প্রশাসনের প্রশাসন চালাবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যেহেতু প্রগতিশীল রাজনীতি করি, এখন কয়েকটা মেয়ে হলে ছাত্রলীগের ব্যানারে উঠুক আমরাও চাই। যেহেতু হলে সিট সংকট এখন যদি কোনো মেয়ে হলে উঠতে চায়, সেহেতু গণরুমকে আমরা সাংগঠনিকভাবে পজিটিভ ভাবেই দেখি।’

এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএফএম আবদুল মঈন বলেন, ‘হল চালাবে প্রশাসন। শিক্ষার্থীরা এখানে আসবে কেন? আমি বিষয়টা অবগত হয়েছি। বিষয়টা আলোচনা করে দেখব।’

উল্লেখ্য, শেখ হাসিনা হলের বাইরে অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও খারাপ ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে কাজী ফাইজা মেহজাবিনের বিরুদ্ধে। বাসে থাপ্পড় মারার ঘটনাও রয়েছে। গত বছরের ৯ নভেম্বর বাসে সিট রাখাকে কেন্দ্র করে এক ছেলে শিক্ষার্থীকে থাপ্পড় দিয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীতে সেই শিক্ষার্থীর কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন।আজকের পত্রিকা

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো
© All rights reserved © 2023 Chtnews24.net
Website Design By Kidarkar It solutions