কক্সবাজার:- জাহাজ থেকে নেমে জেটি পার হতেই চোখে পড়ে একদল কুকুর। আট বর্গকিলোমিটার প্রবালদ্বীপের সবখানেই কুকুর কিংবা ফুটফুটে কুকুরছানা। সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য খোরশেদ আলম বলেন, ‘পর্যটকসহ স্থানীয় মানুষের আতঙ্কের কারণ এসব বেওয়ারিশ কুকুর। শিশুসহ অনেক মানুষ প্রায়ই কুকুরের আক্রমণের শিকার হচ্ছে। আমরা চাইলেও কিছু করতে পারছি না।’
জানা যায়, কোভিড মহামারির আগে সেন্ট মার্টিনে হোটেল ও রিসোর্ট ছিল ১৪৪টি; বর্তমানে ১৯০টির বেশি। গত বছর মেরিন প্রোটেক্টেড এরিয়া (এমপিএ) ঘোষণার পর প্রভাবশালীরা দ্রুত রিসোর্ট, হোটেল নির্মাণ শুরু করেন। গত শনি ও রোববার ঘুরে দ্বীপে অন্তত ১৫টি নতুন ভবনের নির্মাণকাজ চলতে দেখা যায়। নির্মাণসামগ্রী কোথায় পান, সেই প্রশ্নের জবাব মেলেনি কর্মরত শ্রমিকদের কাছ থেকে। কয়েকজন জানান, মালিকপক্ষের কেউ সাধারণত সামনে আসেন না। রাতে ইট, বালু, সিমেন্ট আনা হয়; দিনে কাজ চলে। বেশ কয়েকটি ভবনে দেখা যায়, কংক্রিটের কাঠামোর ওপর কাদামাটির প্রলেপ কিংবা বাঁশের আবরণ দেওয়া হচ্ছে। ছাদে কংক্রিটের ঢালাই কিংবা টিনের চালার ওপর লাগানো হচ্ছে শণ। ইকো রিসোর্ট হিসেবে প্রচার করতেই এমন কৌশল।
জানা যায়, জানুয়ারি মাসেই তিন দফা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছে জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর। ওই সময় নির্মাণাধীন ১৮টি হোটেল ও রিসোর্টের বর্ধন এবং নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে সরেজমিনে সব স্থাপনারই নির্মাণকাজ চলতে দেখা যায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আজহারুল ইসলাম বলেন, ‘স্যাররা এলে অভিযান হয়। এরপর তো আমার কিছু করার থাকে না। আমি একা এখানে থাকি। সেই প্রশাসনিক শক্তিও নেই যে কাজ বন্ধ করে দেব। ঘুরে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ ছাড়া আর কিছু করা সম্ভব হয় না। চালার ওপরে শণ দিয়ে ইকো রিসোর্ট তৈরি হয় এখানে। দেখে তথ্য নেওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই।’
কুকুরের উপদ্রবে কচ্ছপ উধাও
শুক্র ও শনিবার ছাড়া প্রতিদিন গড়ে প্রায় সাড়ে তিন হাজার পর্যটকের আগমন ঘটে এখানে। দ্বীপে কুকুরের সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। স্থানীয় কয়েকজন জানান, ২০১৪ সালে কুকুর নিধন কার্যক্রম শুরু করার কথা উঠলেও পরিবেশবাদী সংগঠনের আপত্তির মুখে তা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আসে বন্ধ্যাকরণ প্রকল্প। সেটিরও খোঁজ নেই। গত বছরের মার্চে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের ঘোলার চরে দুই হাজার কুকুর পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ৩৬টি কুকুর আটক করার পর একটি সংগঠনের দাবির মুখে সেই উদ্যোগও থেমে যায়।
পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সেন্ট মার্টিনে ২০০৬ সালে স্থাপিত কার্যালয় মেরিন পার্কে প্রতি মৌসুমে (নভেম্বর-মার্চ) একজন সহকারী পরিচালক অবস্থান করেন। দুই মৌসুম ধরে আছেন আজহারুল ইসলাম। রোববার নিজ কার্যালয়ে তিনি বলেন, ‘দ্বীপজুড়ে দূরদূরান্ত থেকে মা কচ্ছপেরা ডিম পাড়তে আসত। সৈকতজুড়ে কচ্ছপের ডিম থাকত অসংখ্য। কিন্তু এখন আর কচ্ছপ আসে না। কারণ, মা কচ্ছপ ডাঙায় উঠলেই কুকুর আক্রমণ করে। এমনকি কোথাও ডিম পাড়লে বালু খুঁড়ে সেই ডিম খেয়ে ফেলে। আমাদের পাঁচজন নৈশপ্রহরীর এখন দায়িত্ব, রাতে বিভিন্ন বিচে পাহারা দিয়ে কচ্ছপের ডিম সংরক্ষণ করে তা নিরাপদে মাটির নিচে পুঁতে রাখা।’
পিপল ফর অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান রাকিবুল হক বলেন, ২০১৯ সালের প্রাণিকল্যাণ আইন অনুযায়ী কোনো মালিকবিহীন প্রাণী হত্যা বা অপসারণ করা দণ্ডনীয় অপরাধ। এই আইনের কারণে রাষ্ট্রের কোনো নাগরিক তো নয়ই, প্রশাসনও কুকুর নিধন বা অপসারণ করতে পারে না।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, ‘আমাদের কাছে সেন্ট মার্টিনের কুকুর নিয়ে বিভিন্ন সময় নানা অভিযোগ আসে। প্রশাসন তাদের পুনর্বাসনের জন্য চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু উচ্চ আদালতে বেওয়ারিশ কুকুর নিধনের বিষয়ে পরিবেশবাদী সংগঠনের একটি রিট রয়েছে। মানুষের দাবির মুখে উদ্যোগ নেওয়া হলে নতুন করে পরিবেশবাদীরা বাধা দেন। এ কারণে আপাতত কিছু করা যাচ্ছে না।’
নিয়ম মানার বালাই নেই
একসময়ের নারিকেল জিঞ্জিরার হাল দেখতে জেটি এলাকা থেকে দক্ষিণপাড়ার শাহপরীর দ্বীপ পর্যন্ত ঘুরে সব ক্ষেত্রে অনিয়মই চোখে পড়ে। অন্তত ২০০ মোটরসাইকেল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সৈকত এলাকা। দ্বীপে টমটম বা ইজিবাইক চলছে প্রায় ৩৫০। দ্বীপের মূল সড়ক দিয়ে তেমন কিছুই চলে না। শুধু জেটি থেকে কিছু হোটেল ও রিসোর্টে যাওয়া ছাড়া সৈকত ধরেই চলছে মোটরসাইকেল ও ইজিবাইক। তাদের হর্ন আর যান্ত্রিক আওয়াজে সমুদ্রপাড়ে কোনো প্রাণী কিংবা প্রবালের টিকে থাকা সম্ভব নয়।
জানা যায়, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনকে হাত করেই ব্যবসা চলছে এসব মোটরযানের। দুর্ঘটনার আশঙ্কার পাশাপাশি জীববৈচিত্র্যও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে মোটরযানের কারণে।
যদিও ঢালাওভাবে মোটরযানের অনুমোদন দেওয়া হয়নি বলে দাবি সেন্ট মার্টিন ইউপি চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমানের। তাঁর মতে, অনেকেই চুরি করে মোটরসাইকেল চালাচ্ছে।
গত বছরের জানুয়ারিতে প্রবালদ্বীপ এবং সংলগ্ন প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন বঙ্গোপসাগরের ৭০ মিটার গভীর সমুদ্রের ১ হাজার ৭৪৩ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে এমপিএ ঘোষণা করা হয়। পরের মাসেই দ্বীপের পরিবেশ-প্রতিবেশ, জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা, ইকো ট্যুরিজম উন্নয়নে কর্মপরিকল্পনাসহ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ১৩ দফা সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়নের নির্দেশ দেওয়া হয় সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে। নির্দেশনার মধ্যে আছে, সেন্ট মার্টিনে সব ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ ও সম্প্রসারণ বন্ধ রাখা; দ্বীপের নিস্তব্ধতা ও শান্তি বজায় রাখতে শব্দ ও বায়ুদূষণ রোধ করা; যান চলাচল ব্যবস্থাপনা ঠিক করা ইত্যাদি।
টেকনাফের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. এরফানুল হক চৌধুরী বলেন, সৈকতে সাইকেল, মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ করাসহ জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কাজ করছেন তাঁরা। স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ এবং অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে নিয়মিত অভিযান চলছে। সরকারের নির্দেশনা মানতে যা করণীয়, সবই করা হবে। দ্রুততম সময়ে মোটরসাইকেল উচ্ছেদ করা হবে।
দিনরাত নির্মাণকাজ
চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী আকরাম হোসেন সপরিবারে উঠেছেন কোরাল হেজ নামের রিসোর্টে। তিনি বলেন, ‘আমি প্রায় ১৫ বার এখানে এসেছি। প্রতিবার আসি আর অবাক হই। যেখানে পাঁচ-সাত বছর আগেও ঘন কেয়াবন দেখেছি, সেখানে এখন ফাঁকা। আগে একটা শান্ত ভাব ছিল। এখন ইজিবাইক আর মোটরসাইকেলের শব্দে মনে হয় শহরেই আছি। যে রিসোর্টে উঠেছি, এর পাশেই দিনরাত নতুন ভবনের কাজ চলছে। অথচ কোনো স্থাপনা নতুন করে হওয়ার কথা ছিল না।’
ঘুরে দেখা যায়, টিন দিয়ে ঘেরা একটি জায়গায় এরই মধ্যে উঠেছে পাঁচটি ইটের ঘর। পাশেও একটি তিনতলা ভবন। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ভবনটি স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের ভাগনে হেলালের। তাঁকে অবশ্য পাওয়া যায়নি।
চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, ‘সেন্ট মার্টিনে ভবন নির্মাণ করছে প্রশাসন। এ মুহূর্তে পোস্ট অফিস, কোস্ট গার্ড কার্যালয় ও লাইট হাউস নির্মাণ করা হচ্ছে। বাকি সব ইকো সিস্টেমে করা হচ্ছে।’ ভাগনের ভবন নির্মাণ প্রসঙ্গে মুজিবের বক্তব্য, ‘আমার আত্মীয়স্বজন কেউ ভবন বানালে সেটি তার ব্যাপার। এর দায় আমার নয়।’